আলোচনায় (বাঁ দিক থেকে) ফতিমা খানাম, নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ঝুমা বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র
বাবার কি চাকরি চলে গিয়েছে বা কারখানায় মালিকপক্ষ তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন? বাড়িতে খুব অসুস্থ কি কেউ নেই? এর কোনওটাই দাঁড়াচ্ছে না দেখে শেষে ঠিক হয়, বছর দশেকের মেয়েটির বস্তির ঘরটাই তুলে ধরা হবে। গানের রিয়্যালিটি শোয়ে এর পরে দেখানো হয় মেয়েটির বস্তির জীবন। প্রতিযোগিতায় কয়েক ধাপ এগিয়ে তৃতীয় স্থানে শেষ করে মেয়েটি।
পরের তিন বছর তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের ব্যস্ততার শেষ নেই। পুজো হোক বা বড়দিন, শেষ রাত পর্যন্ত শো করে বেড়ায় মেয়ে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লে বাবা-মা চোখেমুখে জল দিয়ে কোনও মতে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দেন। তিন বছর পর থেকে বদলাতে শুরু করে ছবিটা। গান গাওয়ার ডাক আসা কমতে থাকে। যে রিয়্যালিটি শোয়ে মেয়েটি তৃতীয় হয়েছিল, তত দিনে সেখান থেকে নতুন অনেকে উঠে এসেছে। মেয়েকে ডাকার অনুরোধ নিয়ে ছুটে বেড়ান বাবা-মা। কিন্তু ডাক আসে না। তত দিনে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে সেই মেয়ে। ভবিষ্যৎ অজানা! আরও কয়েক বছর বাদে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান করা তো দূর, রিয়্যালিটি শোয়ের বিচারকেরা যাঁকে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এক দিন, সেই মেয়ের আর গান নিয়ে বসাই হয় না!
‘রিয়্যালিটি শোয়ের বিস্ময় দু’দিনেই বিস্মৃত?’— বুধবার আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত ‘শহর কী বলছে’ শীর্ষক আলোচনায় এই প্রশ্নই রাখা হয়েছিল ব্যারাকপুরের সেন্ট অগাস্টিনস ডে স্কুলের পড়ুয়া, অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের সামনে। সেখানে উঠে আসে বিস্ময় থেকে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এমন নানা ছেলে-মেয়ের কথা। স্কুলের প্রেক্ষাগৃহে এই আলোচনায় ছিলেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ফতিমা খানাম। প্রসঙ্গত, আগামী ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটির নতুন সিনেমা ‘হামি ২’। পরিচালকেরা জানান, রিয়্যালিটি শোয়ের এক চরম বাস্তব সিনেমার বিষয়বস্তু।
আলোচনার শুরুতে নন্দিতা বলেন, ‘‘প্রাপ্তবয়স্ক কেউ রিয়্যালিটি শোয়ে অংশ নিলে তিনি স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু যখন বাচ্চাদের রিয়্যালিটি শোয়ে পাঠানো হয়, তখন তা অভিভাবকদের ইচ্ছায় হয়। প্রতিটি শিশুই আসলে তার বাবা-মায়ের কাছে বিশেষ। এই বিশেষত্বটা জানানোর একটা ইচ্ছে তৈরি হয়। রিয়্যালিটি শো-কে পুরোপুরি খারাপও বলতে পারি না। শো থেকে অনেক বড় শিল্পী পরবর্তী কালে নাম করেছেন। আগে গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকা সহজ ছিল না। রিয়্যালিটি শো সেই জায়গাটা করে দিয়েছে। কিন্তু টিআরপিটাই কোথাও যেন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, বাচ্চার এতে আদৌ লাভ হচ্ছে কি না।’’
শিবপ্রসাদ বলেন, ‘‘আমি আর নন্দিতাদি রিয়্যালিটি শোয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এর সমস্ত দিক সম্পর্কে জানি। তা থেকেই এমন একটা বিষয়ে সিনেমা তৈরির ভাবনা। এ ক্ষেত্রে বিস্মৃত কথাটার আলাদা গুরুত্ব আছে। ধীরে ধীরে দেখা যায়, বাচ্চাটাকে কেউ আর চিনতে পারছেন না। কোনও এক চ্যানেল বা রিয়্যালিটি শোয়ের নাম প্রথমে ব্যবহার হচ্ছে তাকে চেনানোর জন্য। অর্থাৎ, ওই চ্যানেল বা রিয়্যালিটি শোয়ের নামের পরে অন্য যে কোনও বাচ্চার নাম বসিয়ে দিলেও কারও কিছু যাবে-আসবে না। দেখা যায়, গুণের বদলে খোঁজা হচ্ছে বাচ্চাটির জীবনে অন্য কোনও গল্প আছে কি না। অর্থাৎ, বাচ্চাটির বাবার চাকরি না গেলে বা বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ না হলে সেলিং পয়েন্ট তৈরি হচ্ছে না। তার উপরে কোনও বাচ্চাকে অনুষ্ঠান থেকে বার করে দেওয়ার সময়ে এমন একটা দৃশ্য তৈরি করা হচ্ছে, যা বাচ্চাদের পক্ষে নেওয়া খুব কঠিন। গত দু’-তিন মাস ধরে তার সঙ্গে কী কী ঘটেছে, সবটা দেখানো হয়। একাধিক জন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, এ রকম রিয়্যালিটি শোয়ের অংশ হওয়া মানেই কিন্তু যে কোনও বাচ্চার মানসিক সমস্যা তৈরি হবে।’’
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ফতিমা বলেন, ‘‘সব বাচ্চার মধ্যেই কিছু না কিছু বিশেষত্ব আছে। কিন্তু সেই বিশেষত্ব তুলে ধরার নামে তাকে বিক্রি করার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। বিস্ময় বিক্রি ছেড়ে গুণের চর্চায় জোর দিন অভিভাবকেরা।’’
শ্রোতারা প্রশ্ন তোলেন, রিয়্যালিটি শোয়ে কেন চটুল জিনিস ব্যবহার করা হয়, কেন বাচ্চার শারীরিক গড়ন তুলে ধরে সেটাই বিক্রির চেষ্টা হয়? এ-ও প্রশ্ন ওঠে, রিয়্যালিটি শোয়ে কি শেখানোর থেকে জেতানোটা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে? সেন্ট অগাস্টিনস ডে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ঝুমা বিশ্বাস বলেন, ‘‘শুধু রিয়্যালিটি শো দিয়ে কখনওই হবে না, চাই কঠোর অনুশীলন। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, বাচ্চার স্বাভাবিক জীবন যেন নষ্ট না হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy