পশ্চিমবঙ্গ মেডিক্যাল কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে ঝুলছে একটি দীর্ঘ তালিকা। যাতে নাম রয়েছে মোট ৩৭৬ জন চিকিৎসকের। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে তালিকাভুক্ত ওই সব চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। কারও কারও ক্ষেত্রে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়েছে অন্তত এক যুগ আগে। কিন্তু অভিযোগকারীরা কেউ এত বছর পরেও সুবিচার পাননি। কারণ অভিযুক্তদের শাস্তি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি কাউন্সিল। তাই এখনও গোটা বিষয়টি ঝুলেই রয়েছে।
তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, তাতে রয়েছে শহরের বেশ কয়েক জন তাবড় চিকিৎসকের নাম। যাঁদের এক বার দেখানোর জন্য হাজার-বারোশো টাকা খরচ করতে হয় রোগীদের। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি শহরের নামী বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের সংখ্যাও নেহাত কম নয় ওই তালিকায়। কোনও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতি বা চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগ জানানোর অন্যতম জায়গা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল। অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক দোষী কিনা, সে ব্যাপারে রায় দেওয়ার কথা কাউন্সিলের। অভিযোগ প্রমাণিত হলে চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত বাতিল হতে পারে। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাছে এমন কয়েকটি অভিযোগ নিষ্পত্তির অভাবে পড়ে রয়েছে, যেগুলিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে প্রায় বছর পাঁচ-ছয় আগে।
কিন্তু এই দীর্ঘ সময় ধরে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না কেন?
চার্জশিটপ্রাপ্তদের তালিকায় শহরের বেশ কয়েক জন নামী চিকিৎসকের নাম থাকার জন্যই কি এই নিষ্ক্রিয়তা, প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। রোগীদের স্বার্থ-রক্ষায় কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের মতে, বাম আমলে মেডিক্যাল কাউন্সিল যেমন ঠুঁটো জগন্নাথ ছিল, তৃণমূলের জমানাতেও ছবিটা একই রকম রয়ে গিয়েছে। শুধুই অভিযোগের পাহাড়, নিষ্পত্তি বা অপরাধীর বিরুদ্ধে শাস্তিগ্রহণের কোনও পরম্পরাই কাউন্সিলে তৈরি হয়নি। এ ব্যাপারে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন।
এমন একটি সংগঠন ‘পিপল ফর বেটার ট্রিটমেন্ট’-এর সভাপতি কুণাল সাহা বললেন, “কাউন্সিলের সব সদস্য চিকিৎসক হলে এমন চলতেই থাকবে। আমরা একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টে এই প্রশ্ন রেখেছিলাম। আমরা চাই বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে তৈরি হোক কাউন্সিল। তা হলেই আশঙ্কা কমবে।”
কেন এত দিন ওই সব অভিযোগ চেপে রাখা হয়েছে, তা জানতে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল রাজ্য কাউন্সিলের সভাপতি নির্মল মাজির সঙ্গে। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসের জবাবও দেননি। কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার দিলীপ ঘোষ বলেন, “এ ব্যাপারে যা বলার কাউন্সিলের সভাপতি বলবেন। আমরা আমাদের মতো করে চেষ্টা করছি, এটুকু বলতে পারি।”
কাউন্সিলের প্রাক্তন সভাপতি অশোক চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, এই বিলম্ব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাঁর যুক্তি, “এক একটা অভিযোগের নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে। প্রাথমিক খোঁজখবর হয়, তার পরে শুনানি, চার্জশিট। এর পরে কাউন্সিলের সদস্যরা বসে একটা সিদ্ধান্তে সহমত হন। সপ্তাহে এক দিন কাউন্সলের সভা বসে। তাই দেরি তো হবেই।” কিন্তু একটি অভিযোগের নিষ্পত্তি হতে এক যুগ সময়টাও কি অস্বাভাবিক নয়? অশোকবাবুর জবাব, “আমার তো অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অভিযোগের ধরনের উপরে নিষ্পত্তির সময় নির্ভর করে। অভিযোগ যত জটিল, সময় তত বেশি লাগবে। সব দিক বিচার না করে তো আর কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।”
রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য এবং মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার এথিক্যাল কমিটির সদস্য সুদীপ্ত রায় বলেন, “জমে থাকা অভিযোগ বেশির ভাগই বাম জমানার। আমরা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একাধিক পেনাল কমিটি তৈরি করেছি। সেখানে যে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তা কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে পাঠানো হচ্ছে। তবে অভিযোগের সংখ্যা এত বেশি যে একটু সময় লাগবে।” চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক শান্তনু সেনও দায় চাপিয়েছেন আগের কাউন্সিলের উপরে। তাঁর মন্তব্য, “দীর্ঘদিন সেখানে নির্বাচন হয়নি। অ্যাড হক কমিটি গড়ে কাজ চলত। নয়া সরকারের আমলে অভিযোগের নিষ্পত্তি শুরু হয়েছে। এত দিনের পাহাড় সরাতে সময় তো লাগবেই। তবে কাজের গতি নিয়ে এখন আর কোনও সমস্যা নেই।”
তবে সুদীপ্তবাবু বা শান্তনুবাবু যে দাবিই করুন, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের কর্মীদের একটা বড় অংশের কিন্তু অভিযোগ, নতুন সরকারের আমলে কাউন্সিলের কাজের গতি আরও শ্লথ হয়েছে। এক আধিকারিক বলেন, “আগের জমানায় সপ্তাহে এক দিন কাউন্সিলের সভা বসত। এখন দু’সপ্তাহে এক দিনও বসে না। কাজ এগোবে কী ভাবে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy