জরুরি সঠিক মূল্যায়ন।
চুরি, ব্যক্তিগত ভিডিয়ো ভাইরাল করা, মাদকদ্রব্য পাচারের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধবৃত্তে ছোটদের জড়িয়ে পড়ার খবর নতুন নয়। কিন্তু শিশুমনে এই অপরাধপ্রবণতার বীজ বপন কখন হচ্ছে? শিশুটি কি বুঝতে পারছে তার পরিণতি? অভিভাবক কি সচেতন তাঁর সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে? প্রশ্ন অনেক। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক একে একে...
অপরাধ সম্পর্কে ধারণা
জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য (কলকাতা) ড. বিপাশা রায় বললেন, “সাত থেকে আঠেরো বছরের ছেলেমেয়েরা কোনও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়লে আইনত তাকে প্রাথমিক ভাবে ‘ইনোসেন্ট’ ধরে নেওয়া হয়। আইনের ভাষায় তাকে ‘প্রিজ়াম্পশন অফ ইনোসেন্স’ বলে। অপরাধের ধরনের উপরে নির্ভর করে এগোবে বিচারের ব্যবস্থা। জুভেনাইল জাস্টিস (কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন) অ্যাক্ট ২০১৫ অনুযায়ী তিন রকমের অফেন্স হতে পারে— পেটি, সিরিয়াস ও হিনাস। ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনা পড়ে ‘পেটি অফেন্স’-এর মধ্যে। ‘সিরিয়াস অফেন্স’-এর ভাগ আছে। তবে বড় চুরি, বাড়িতে অনুপ্রবেশের ঘটনা এই অফেন্সের মধ্যে পড়ে। আর যৌন নির্যাতন, খুন ইত্যাদি পড়বে ‘হিনাস অফেন্স’-এর মধ্যে। পেটি ও সিরিয়াস অফেন্সের ক্ষেত্রে শিশুটিকে অ্যাপ্রিহেন্ড করা যাবে না। তার নামে শুধু জেনারেল ডায়েরি করা হয়। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে অনেক শিশু একসঙ্গে বা বড়দের সঙ্গে একত্রে সিরিয়াস অফেন্সে জড়িয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে ‘বেস্ট ইন্টারেস্ট অফ দ্য চাইল্ড’ মাথায় রেখে স্পেশ্যাল জুভেনাইল পুলিশ ইউনিট সিদ্ধান্ত নেবে তার নামে জিডি হবে না এফআইআর হবে। আর হিনাস অফেন্সে এফআইআর করা হয় এবং শিশুটিকে অ্যাপ্রিহেন্ড করে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সামনে নিয়ে আসা হয়।”
ঠিক মূল্যায়ন জরুরি
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম বললেন, “ষোলো-সতেরো বছরের বা তার চেয়ে ছোট কেউ যদি গুরুতর অপরাধ করে, তার পরিবার, পড়াশোনা সব দিক খুঁটিয়ে দেখতে হবে। কাউন্সেলিং করে প্রয়োজনে রিহ্যাবিলিটেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। একজন নাবালক অপরাধ করলে তাকে ক্রিমিনাল হিসেবে দাগিয়ে দিলে, বড়দের মতো শাস্তি দিলে, তার মানে আমরা ধরেই নিচ্ছি যে তার পরিবর্তন হবে না। তার বদলে কাউন্সেলিং করে তাকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা অনেক মানবিক।”
জুভেনাইল জাস্টিস সিস্টেমের মধ্যে যখনই একটি শিশু আসবে, তখন থেকেই তাকে মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। জিডি করে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার পুলিশ অফিসারকে, শিশুটির সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড রিপোর্ট জমা দিতে হবে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে। তখন মা-বাবা ও শিশুকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যে শিশুটি অপরাধ করেছে, তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও বিচার্য। প্রোবেশন অফিসারকে পনেরো দিনের মধ্যে সোশ্যাল ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জমা দিতে হয়। ওই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক শিশুর জন্য ইন্ডিভিজুয়াল কেয়ার প্ল্যান তৈরি হয়।
অনেক সময়ে দেখা যায়, শিশুটির বেড়ে ওঠার পরিবেশ ইতিবাচক নয়। আর্থ-সামাজিক পরিবেশ এমন যে, সে না বুঝেই অপরাধের পথে চলে গিয়েছে। ফেরারও উপায় নেই। ড. বিপাশা রায় বললেন, “বিচার অনুযায়ী শিশুটি জামিন পেলে তার মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হয়। হয়তো সে এমন কাজ করেছে যে, ফিরে গেলে তার প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। তখন তার সুরক্ষার স্বার্থে কিছু দিনের জন্য চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউশনে পাঠানো হয়।” তাদের পড়াশোনা, হাতের কাজের ব্যবস্থা করে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
অভিভাবকের দায়িত্ব
ড. বিপাশা রায়ের কথায়, “বীজ থেকে গাছ তৈরি করতে ঠিক যতটা দায়িত্ব নিতে হয়, সন্তানকে বড় করার দায়িত্বও ততটা। সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে মা-বাবাকে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। এ বিষয়ে বাচ্চার কেয়ারগিভার, চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউশন, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার পুলিশ অফিসার প্রত্যেকেরই দায়িত্ব সমান।” কিছু কিছু বিষয় সন্তানের উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই ধরনের বাচ্চাদের বলা হয় ‘চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক’। ডা. জয়রঞ্জন রামের কথায়, “কোনও বাচ্চাকে পাশবিক ভাবে মারধর করা হলে বা গার্হস্থ হিংসা দেখে বড় হলে তার প্রভাব পড়ে। ডিফিকাল্ট বা ডিজ়রাপ্টিভ বিহেভিয়রের ঝুঁকি থাকে তাদের। তবে এ রকম পরিস্থিতিতে যে সব বাচ্চার এমন ঝুঁকি থাকবে, তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যারা অপরাধ করছে, তাদের পরিবারে এমন ঘটনা রয়েছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে। বাচ্চা যদি অহেতুক মিথ্যে বলে, জন্তু-জানোয়ারকে মারে, অসুস্থ মানুষের প্রতি কোনও সমবেদনা না থাকে, তখন কিন্তু সচেতন হতে হবে।”* পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষও এ ব্যাপারে সহমত। তিনি আর-একটি দিকও বললেন, “কিছু বাড়িতে বাচ্চারা দাদু-ঠাকুমার কাছে মানুষ হয়। তারা হয়তো নাতি-নাতনির সামনেই অপরাধমূলক টিভি শো দেখছেন, বাচ্চাটি কিন্তু প্রভাবিত হতে পারে। আমরা ধরে নিই যে, বাচ্চাটা কিছু বুঝবে না। কিন্তু কাউন্সেলিংয়ের সময়ে যখন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সে কেন এমন অপরাধ করেছে, সে বলছে টিভিতে দেখেছে।” সন্তানের সামনে কোনও রকম হিংসাত্মক আচরণের (মা-বাবা একে অপরকে মারধর করার মতো বা টিভি শোয়ে) প্রদর্শন চলবে না।
* সন্তানের অপরাধ চাপা দেবেন না। বন্ধুর পেনসিল, রং ইত্যাদি ছোটখাটো জিনিসও নিয়ে এলে তাকে বোঝাতে হবে সে ভুল করেছে। না বলে কারও জিনিস নেওয়াটা চুরি। তখনই তাকে দিয়ে কাজটা সংশোধন করাতে হবে।
* কিছু শিশু ধ্বংসাত্মক হয়। মোটামুটি সব বাচ্চাই পুতুল বা গাড়ি নিয়ে খেলে। অনেক শিশু পুতুলের হাত, পা, চুল ছিঁড়ে, চোখ উপড়ে ফেলে, অনেকে গাড়ি ভেঙে, টায়ার খুলে ফেলে। তখন জানা জরুরি যে, তারা কেন এমন করছে। গাড়ি বা পুতুলের ভিতরে কী আছে, সেটা জানার জন্য কৌতূহলবশত তা করতে পারে। আবার মনের ভিতরের কোনও রাগ থেকেও সে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তাই কারণটা জানা দরকার।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ
স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এ ধরনের ভিডিয়ো নিয়ে ব্ল্যাকমেলের ঘটনাও দেখা যায়। সেটাও অপরাধ। ডা. রাম বললেন, “সাধারণ জগতে চলার জন্য যেমন মা-বাবা শিক্ষা দেন, ভার্চুয়াল জগতেও সন্তান কী ধরনের ছবি দেবে, কোন ছবি দেবে না... সে বিষয়ে গাইড করা দরকার।” উল্টো দিকে নিজের সন্তান যেন এমন কোনও পদক্ষেপ না করে, তার জন্যও মা-বাবাকে সজাগ থাকতে হবে। তার সঙ্গে ভাল সময় কাটাতে হবে। সন্তানের ছোট থেকে বড় হওয়া অবধি তার গতিবিধির উপরে নজর রাখাও খুব জরুরি।
শুধু অপরাধ করা নয়, অপরাধের শিকার হওয়া থেকেও সন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাথমিক পাঠ দিতে হবে বাড়িতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy