লাল এবং সাদা। ওড়িশার রসগোল্লা ও বাংলার রসগোল্লা।
কৃষ্টে আর খ্রিস্টে ফারাক না-ই থাকতে পারে! কিন্তু রসগোল্লায়-রসগোল্লায় ফারাক আলবত আছে।
রসগোল্লা কার উদ্ভাবন, এই নিয়ে বাংলা বনাম ওড়িশা কাজিয়ায় অবশেষে এটাই সাব্যস্ত হল।
যে কোনও পণ্য ও তার ভৌগোলিক উৎস জরিপ করে ‘ব্র্যান্ডিং’-এর কাজটি করে থাকে এ দেশের ‘ট্রেডমার্ক’ সংক্রান্ত নিয়ামক সংস্থা। তাদের সর্বভারতীয় কন্ট্রোলার জেনারেল ওমপ্রকাশ গুপ্ত সোমবার মুম্বই থেকে কলকাতায় এসে স্পষ্ট বললেন, ‘‘নামের মিলটুকুই সব নয়। রসগোল্লা নানা কিসিমের। বাংলা এবং ওড়িশার রসগোল্লা কখনওই এক না!’’
সল্টলেকে কন্ট্রোলার সাহেবের স্থানীয় অফিসে রসগোল্লার আদি রূপকার হিসেবে বাংলার হয়ে সওয়াল করতে কোমর বেঁধেছিলেন রাজ্য সরকারি আমলা থেকে শুরু করে নামী মিষ্টান্ন-স্রষ্টারা। বিচারকদের সামনে একসঙ্গে পেশ করা হয় কটকের কাছে পাহালের রসগোল্লা ও কলকাতার ‘স্পঞ্জ’ রসগোল্লা। যা দেখেই কন্ট্রোলার জেনারেল বললেন, ‘‘কীসের বিতর্ক! ওড়িশার রসগোল্লা লালচে, বাংলারটা ধবধবে সাদা! দু’টো কী করে এক হবে?’’
জয়নগরের মোয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানার মতো বাংলার রসগোল্লাও নিজের ঘরের সৃষ্টি বলে মনে করে বাঙালি। এই দাবি থেকেই রসগোল্লার জন্য ‘জিওগ্রাফিকাল আইডেন্টিফিকেশন’ বা ‘জি আই’ তকমা আদায় করতে সংশ্লিষ্ট নিয়ামক সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। ওড়িশাও ছাড়বার পাত্র নয়। ‘জি আই’ তকমার আবেদন করে উঠতে না-পারলেও রসগোল্লার হক আদায় করতে তারাও সরকারি কমিটি গড়েছে।
কীসের ভিত্তিতে রসগোল্লার ‘জনক’ হিসেবে পরস্পরের বিরুদ্ধে টক্কর নিচ্ছে দুই রাজ্য?
ওড়িশা প্রধানত জগন্নাথধামের একটি প্রচলিত পরম্পরাকে হাতিয়ার করছে। রথযাত্রা শেষে সাত দিন মাসির বাড়ি কাটিয়ে মন্দিরে ফেরার সময়ে রসগোল্লাই জগন্নাথদেবের ‘পাসওয়ার্ড’। স্ত্রী লক্ষ্মীর রীতিমতো মান-ভঞ্জন করে মন্দিরে ঢুকতে হয় ঈশ্বরকে। তখন হাঁড়ি-ভরা রসগোল্লা দিয়েই বৌয়ের মন গলান তিনি। জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে খাজা-গজার শ্রীক্ষেত্র এখনও একদিনের জন্য রসগোল্লা-নগরী হয়ে ওঠে। দোকানে দোকানে রসগোল্লা-উৎসবের ধুম পড়ে। জগন্নাথ-বিশেষজ্ঞেরা তাই দ্বাদশ শতকীয় মন্দিরের এই প্রথার উদাহরণ দেখিয়েই রসগোল্লা তাদের সৃষ্টি বলে দাবি করছেন।
কিন্তু বাংলার ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, রসগোল্লা ঢের পরের সৃষ্টি। পর্তুগিজ পাদ্রিদের কাছে আঠেরো শতকে পট চিজ তৈরির কসরত শিখেই মিষ্টিতে ছানার ব্যবহার শেখেন বাংলার ময়রারা। তার আগে অবধি দুধ ‘ছিন্ন’ করে সৃষ্টি বলে ছানা বস্তুটাই দেবতার মুখে তোলার যোগ্য বলে ধরা হতো না। ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ প্রমুখ প্রাচীন গ্রন্থের সূত্র ধরেও গবেষকদের দাবি, অতীতে জগন্নাথদেবের ভোগে রসগোল্লার উল্লেখ মেলে না। ক্ষীরমোহন বলে গোলাকার একটি মিষ্টির সঙ্গে রসগোল্লার কিছু মিল থাকলেও তা আদতে রসগোল্লা নয় বলেই তাঁদের মত।
জি আই বিচারকেরা অবশ্য এ সব বিতর্কে ঢুকতে চাননি। এ রাজ্যের রসগোল্লা বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা সেরে ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘ইতিহাসের বিতর্ক এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। বাংলা বা ওড়িশার রসগোল্লার ঘরানা আলাদা। বাংলা বা বাংলার বাইরের কেউ তাদের নিজস্ব রসগোল্লার ব্র্যান্ডিং করাতেই পারেন।’’
রসগোল্লার জন্য ‘জি আই’ আদায় করতে রাজ্যকে এখনও কিছুটা কাঠখড় পোড়াতে হবে বলেও বুঝিয়ে দিয়েছেন ওমপ্রকাশ। রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের অধিকর্তা জয়ন্তকুমার আইকত, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দফতরে অতিরিক্ত মুখ্য সচিব রিনা ভেঙ্কটরামনকে তিনি বলেন, ‘‘রসগোল্লা তো বাংলার বাইরেও তৈরি হয়। বাংলার রসগোল্লা কীসে আলাদা, তা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বোঝাতে হবে।’’ সরকারি সূত্রের খবর, রসগোল্লা কতটা শক্ত বা নরম, তুলতুলে বা খসখসে কিংবা কতটা মিষ্টি বোঝাতে বলা হয়েছে। আমবাঙালির মনে ‘রসগোল্লার কলম্বাস’ বলে পরিচিত নবীনচন্দ্র দাশের উত্তরপুরুষ তথা কেসি দাশের অন্যতম কর্তা ধীমান দাশও এ ভাবেই রসগোল্লার জাত-বিচারে বিশ্বাসী। তাঁর দাবি, ‘‘রসের ঘনত্ব বা ছানার পরিমাণ মেপে রসগোল্লার চরিত্র বোঝানো সহজ। এই মাপজোকেই বাংলার রসগোল্লা কোথায় আলাদা তা মালুম হবে।’’
একটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে বাংলাকে রসগোল্লার হকদার হিসেবে আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছে ‘জি আই’ নিয়ামক সংস্থা। রাজ্য সব নির্দেশ মেনে ফের রসগোল্লা-সংক্রান্ত নথি পাঠালে তা খুঁটিয়ে দেখা হবে। তার পরে বাংলার দাবি প্রকাশ করে কোনও মহলে এ নিয়ে আপত্তি আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হবে। চার মাসের মধ্যে কেউ আপত্তি না-জানালে সমস্যা নেই। বাংলার রসগোল্লার ‘জি আই’ তকমা আদায়ে তখন আর কোনও বাধা থাকবে না।
N4
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy