৯ ডিসেম্বর, ২০১১। —ফাইল চিত্র
দু’বছর ছ’মাস পাঁচ দিন। স্মৃতি ফিকে করার জন্য এই ব্যবধানটুকু যথেষ্ট কি না, তা হয়তো তর্কের বিষয়। কিন্তু শনিবার সকালে ঝাঁ চকচকে, আলো ঝলমল আমরি হাসপাতালে পা রেখে মনে হচ্ছিল সময় সত্যিই থেমে থাকে না। বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের অতীত পেরিয়ে এ দিনই ফের রোগী ভর্তি শুরু হল ঢাকুরিয়ার ওই হাসপাতালের সামনের বিল্ডিংয়ে। আর পিছনের পোড়া বিল্ডিংটি ধ্বংসস্তূপের মতো জেগে রইল ৯১ জনের মৃত্যুর স্মৃতি নিয়ে।
২৪ ঘণ্টা আগে থেকেই শহর ছেয়ে গিয়েছিল হাসপাতাল খোলার বার্তাবাহী হোর্ডিংয়ে। ‘ট্রাস্ট ইজ ব্যাক।’ অর্থাৎ বিশ্বাসের পুনর্জন্ম। সত্যিই কি এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস-আস্থা ফেরা সম্ভব? আমরি গ্রুপের সিইও রূপক বড়ুয়া বললেন, “পাঁচ মাস আগে আউটডোর খোলার ছাড়পত্র পেয়েছিলাম। প্রতি দিনই শ’দেড়েক করে রোগী এসেছেন আউটডোরে। বিভিন্ন মহল থেকেই বার বার জানতে চাওয়া হয়েছে, কবে খুলবে হাসপাতাল। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য দফতর এবং দমকলের অনুমোদন পাওয়ার পরে আমরা আর দেরি করতে চাইনি।”
গত মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন আমরি-র কর্তারা। তার পর দ্রুতই একের পর এক জট খুলতে শুরু করে। শেষ জট খোলে মঙ্গলবার, দুষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্রে। তার পরেই হাসপাতাল খোলার তারিখ ঘোষণা করেন কর্তৃপক্ষ। এ দিন সকাল সাড়ে সাতটায় হাসপাতালে ভর্তি হন এই দফার প্রথম রোগী প্রভা ঘোষ (৭০)। সোদপুরের বাসিন্দা প্রভাদেবীর স্নায়ুর কিছু সমস্যা রয়েছে। এখানে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে কোনও ভয়, দ্বিধা কাজ করেনি? তাঁর উত্তর, “দুর্ঘটনা যে কোনও সময়ে যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে। সে নিয়ে ভয় পেলে বেঁচে থাকা যাবে না।” একই বক্তব্য দ্বিতীয় রোগিণী সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। হাতের একটি অস্ত্রোপচারের জন্য আমরি-কেই বেছে নিয়েছেন তিনি।
৫ জুলাই, ২০১৪। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
এ দিন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষও বার বার এই আস্থার উজ্জ্বল ছবিটাই সংবাদ মাধ্যমের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। পুরনো বিল্ডিংয়ের এক তলায় লিফ্টের পাশে দাঁড়িয়ে এক মহিলা কর্মী হাসিমুখে হাসপাতালের নানা নয়া পরিষেবার খতিয়ান দিচ্ছিলেন এক রোগীর পরিবারকে। সে সব শুনতে শুনতে এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল আড়াই বছর আগের সেই সকালটার কথা। এখানেই তো চাদরে মোড়ানো একটা দেহ প্রায় পায়ের উপর এসে পড়েছিল! মুখের চাদর সরিয়ে অজস্র মানুষ দেখে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, ওই দেহ তাঁদেরই কোনও স্বজনের কি না। শেষ পর্যন্ত দুর্গাপুরে শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সনাক্ত করেছিলেন তাঁর বাবা তুষারকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
এ দিন হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী সকলেই বার বার বলছিলেন, তাঁরা অতীতকে ভুলতে চান। কিন্তু অতীতকে ভোলার প্রক্রিয়া যে অত সহজ নয়, তা ফের প্রমাণ হল আউটডোরে আসা এক রোগীর মন্তব্যে। লিফ্টের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি স্ত্রীকে বলছিলেন, “এই জায়গাটাতেই একের পর এক ডেডবডি এনে ফেলছিল, মনে আছে? টিভিতে দেখেছিলাম।” ওঁর কথায় মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এক তলার ঘরের পাশে আধো অন্ধকারে একটা চাদর মোড়া দেহ শোয়ানো ছিল। ছোটাছুটির সময়ে অনেকেই ঠোক্কর খাচ্ছিলেন সেই দেহে। কিন্তু সকলেই এত ব্যস্ত, কারও সময় ছিল না দেহটি সরানোর।
“দুঃস্বপ্নের ওই অতীতকে আঁকড়ে থাকলে আমরা এগোতে পারব না।” বলছিলেন সিইও রূপক বড়ুয়াও। তাঁর কথায়, “এ বার নতুন সফর শুরু।”
ওই বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে পিছনের পোড়া বাড়ির দিকে এগোলাম। সামনেই চেয়ার পেতে বসে কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী। ঢুকতে বাধা দিলেন তাঁরাই। একতলায় ভাঙাচোরা, অন্ধকার ‘সিকিউরিটি রুম’। উপরের ঘরগুলোর প্রায় প্রত্যেকটারই জানলা ভাঙা। সেখান থেকেই সে দিন নামানো হয়েছিল একের পর এক দেহ। কারও নাকে তখনও অক্সিজেনের মাস্ক। কারও হাতে স্যালাইনের নল ঝুলছে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ভবিষ্যতে ছাড়পত্র পেলে ওই বাড়িতে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন তাঁরা। ইন্ডোর আর খুলবেন না।
সে দিনের ঘটনার পরে মৃতদের পরিবারের সদস্যেরা মিলে তৈরি করেছিলেন ‘আমরি ফায়ার ভিকটিম্স অ্যাসোসিয়েশন।’ এঁরা অধিকাংশই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি ক্ষতিপূরণ বাবদ পাঁচ লক্ষ টাকা পেলেও হাসপাতালের তরফে ঘোষণা করা ক্ষতিপূরণের টাকা প্রত্যাখান করেছেন। এ দিন হাসপাতাল খোলার খবর পেয়ে পুরনো স্মৃতি, ক্ষোভ ফের টাটকা হয়ে উঠেছে এঁদের অনেকেরই।
সেই রাতে হাসপাতালেই ছিলেন সুরজ পণ্ডিত। রিসেপশনে বসেই ঘুমোচ্ছিলেন। তাঁর বোন সঙ্গীতা ভর্তি ছিলেন চার তলায়। সুরজ যখন টের পেলেন আগুন লেগেছে, তখন চারদিকে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। বোনকে বাঁচাতে সিঁড়ি বেয়ে তিন তলা পর্যন্ত ছুটেছিলেন তিনি। তার পরে আর উঠতে পারেননি। শনিবার সকালে কাঁদতে কাঁদতে সুরজ বললেন, “ওই রাতটার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না।” পারমিতা গুহঠাকুরতার মা মৃদুলা গুহঠাকুরতা আগুন লাগার কথা টের পেয়ে রাত তিনটেয় মেয়েকে ফোন করতে চেয়েছিলেন। ভুল করে ফোন করে ফেলেন বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীকে। পারমিতা বললেন, “মায়ের খাটের রেলিং তোলা ছিল। তাই আগুন লেগেছে টের পেয়েও মা নেমে পালাতে পারেনি।” ধনঞ্জয় পালের মেয়ে প্রাকৃতার বয়স তখন ১৪। মাথায় চোট পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা মেয়েকে আর বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি ধনঞ্জয়বাবুও। শুভাশিস চক্রবর্তীর স্ত্রী মুনমুনের বয়স তখন ৩৮। অটো দুর্ঘটনায় পায়ে চোট পেয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মুনমুন। ৯ তারিখ দুপুরেই তাঁর ছুটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সকালবেলা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে শুভাশিসবাবু যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন, ততক্ষণে সব শেষ।
সে দিনের ঘটনার কথা মনে করে ক্ষোভ উগরে দিলেও সকলেই জানালেন, তাঁরা হাসপাতাল খোলার বিরোধী নন। তাঁদের আক্ষেপ একটাই। “হাসপাতালটা ফের চালু করতে সরকার উদ্যোগী হল, কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি যে কবে হবে কে জানে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy