আমাদের রক্তে যে লোহিত রক্তকণিকা (আরবিসি) রয়েছে, তার আয়ু এমনিতে চার মাস। রোজই তাই মানুষের শরীরে কিছু কিছু কণিকা ভেঙে যায়। এই ভাঙনের ফলে আরবিসি থেকে বিলিরুবিন নিঃসৃত হয়ে রক্তে মেশে। বিলিরুবিন একটি যৌগ পদার্থ। সাধারণত আমাদের শরীরে এর মাত্রা থাকে ১ বা ১.২ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার-এর নীচে। রক্তের মাধ্যমে বিলিরুবিন প্রথমে পৌঁছয় লিভারে। এর পর লিভার থেকে বাইল ডাক্ট হয়ে যায় খাদ্যনালিতে। সব শেষে তা মল ও কিছুটা মূত্রের সঙ্গে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এই চলার পথে সেটি বিভিন্ন ভাবে ভাঙতে থাকে। ওই জন্য এমনি রক্ত পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, বিলিরুবিনের মাত্রা রয়েছে ০.৫ থেকে ১.২ মিলিগ্রামের মধ্যে। কিন্তু কোনও কারণে তা যদি ১.৫ মিলিগ্রামের উপরে চলে যায়, তা হলে ধরে নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্ডিস হয়েছে। এই বিলিরুবিনের মাত্রা কখন বাড়ে?
মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের মতে, বিলিরুবিন চলাচলের পথ তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়— রক্ত থেকে লিভারে ঢোকা, লিভারের মধ্যে এবং লিভার থেকে বেরিয়ে খাদ্যনালিতে পৌঁছনো। এই তিনটি পর্বের কোথায় সমস্যা হয়েছে, সেটা দিয়েই জন্ডিস বিচার করা হয়। লোহিত রক্ত কণিকা যে পরিমাণে ভাঙার কথা তার চেয়ে বেশি ভাঙলে জন্ডিসের সম্ভাবনা বাড়ে। এরও নানা কারণ হতে পারে। যেমন, কোনও ব্যক্তির হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া (থ্যালাসেমিয়ার মতো রোগ যেখানে রক্ত ভেঙে যায় তাড়াতাড়ি) রয়েছে, কারও শরীরে সংক্রমণ হয়েছে, কাউকে সাপে কামড়েছে ইত্যাদি। এই সব কারণে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে তাকে বলে প্রি-লিভার জন্ডিস। অন্য দিকে, স্টোন কিংবা টিউমরের কারণে লিভার থেকে বাইল ডাক্ট হয়ে বিলিরুবিন খাদ্যনালিতে যেতে না পারলে তা উল্টো দিকে বয়ে লিভারে চলে আসে এবং রক্তে মিশে যায়। এ ক্ষেত্রে যে জন্ডিস হয় তাকে বলে অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস। অনেক সময়েই গলস্টোন কিংবা গল ব্লাডার কিংবা প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের কারণেও রোগীর জন্ডিস হতে পারে। এই দু’টি ক্ষেত্রে লিভারের কোনও ক্ষতি হয় না। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল জানালেন, অনেক সময়ে লিভারের সমস্যার কারণেও জন্ডিস হয়। পিত্তনালির মুখে টিউমর, ক্যানসার, সিরোসিস অব লিভার, সংক্রমণ কিংবা অন্য কোনও সমস্যার কারণে যখন লিভার বিলিরুবিন খাদ্যনালিতে পৌঁছে দিতে পারে না, তখন রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বাড়ে। জলবাহিত কারণে যে জন্ডিস হয় তা হল হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই। গরমকালে এই জন্ডিসের প্রকোপ বাড়ে। কারণ অনেকেই যেখান-সেখান থেকে জল পান করেন। আর রক্তবাহিত বা দেহ রসের মাধ্যমে (যৌন মিলন কিংবা রক্ত নেওয়ার সময়ে সংক্রমিত রক্ত দিলে বা ইঞ্জেকশনের সময়ে সংক্রমিত সিরিঞ্জ ব্যবহার করা হলে) যে জন্ডিস হয়, তা প্রধানত হল হেপাটাইটিস বি আর হেপাটাইটিস সি।
রোগের লক্ষণ
দু’ভাবে জন্ডিস নির্ণীত হয়। উপসর্গ দেখেই চিকিৎসকেরা প্রাথমিক ভাবে তা ধরে নিতে পারেন। যেমন, চোখের যে অংশটা সাদা (কনজাঙ্কটাইভা) তা কিছুটা হলুদ হয়ে যায়। এ ছাড়াও জিভের নিম্নাংশ, হাতের তালু হলুদ হলেও তা জন্ডিসের লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়। এটা হল শারীরিক পরীক্ষা। ডা. সুবীর মণ্ডল জানালেন, চিকিৎসক রোগীকে দেখে নিয়ে সাধারণত রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা জানতে লিভার ফাংশন টেস্ট করতে বলেন। সেই রিপোর্ট দেখেই বোঝা যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রি লিভার না ইনফেকটিভ অথবা অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস হয়েছে। এ ছাড়া আলট্রা সোনোগ্রাফি (ইউএসজি) করে দেখা হয় লিভার কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে কোনও স্টোন আছে কি না বা অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভারের সমস্যা হচ্ছে কি না। এই প্রাথমিক পরীক্ষার পরে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যক্তির এন্ডোস্কপির মতো পরীক্ষা করা হতে পারে। আর যদি জীবাণুর কারণে হয়ে থাকে, তা হলে আলাদা ভাবে হেপাটাইটিস এ, বি, সি এবং ই-এর পরীক্ষাও করা হয় বলে জানালেন ডা. মণ্ডল।
চিকিৎসা
জন্ডিসের কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। যেমন, কারও অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস হলে সেটা কী কারণে হচ্ছে, আগে জানা দরকার। হয়তো কোনও ব্যক্তির গলস্টোনের কারণে বা পিত্তনালির মুখে টিউমর হওয়ায় জন্ডিস হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করলে তাঁর জন্ডিস কমে যেতে পারে। তেমনই হেমোলাইটিক জন্ডিসের ক্ষেত্রে রক্তকণিকার বেশি ভেঙে যাওয়ার কারণ জানা গেলে, তার উপযুক্ত চিকিৎসা করলেই জন্ডিস কমবে। ডা. তালুকদার জানাচ্ছেন, মানুষের ভ্রান্ত ধারণা থাকে যে জন্ডিস মানেই লিভারের রোগ। তা কিন্তু সব সময়ে না-ও হতে পারে। ডা. মণ্ডলের মতেও, জন্ডিস হওয়ার কারণটা জানা সবচেয়ে আগে জরুরি। সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করলে জন্ডিস সারানো সম্ভব।
নিরাময় এবং রক্ষণাবেক্ষণ
ডা. তালুকদারের মতে, জলবাহিত রোগের কারণে হওয়া জন্ডিস এড়ানো যায় পরিশ্রুত জল পান করলে। ডা. মণ্ডল জানালেন, হেপাটাইটিস বি আর সি ছ’মাসের মধ্যে না সারলে, অর্থাৎ ক্রনিক হয়ে গেলে প্রয়োজনমতো অ্যান্টিভাইরাল দেওয়া আবশ্যক। তবে হেপাটাইটিস বি আর সি হওয়ার পরে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সাবধানে থাকতে হয়।
ক্যানসার কিংবা কোনও টার্মিনাল ডিজ়িজ়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যদি কোনও কারণে জলবাহিত কারণে জন্ডিস হয় তা হলে সাধারণ মানুষের তুলনায় রোগের প্রকোপ হবে বেশি। তাই এই সব রোগীকে ও তাঁদের পরিবারের মানুষদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে জলবাহিত কারণে এঁদের জন্ডিস না হয়। অনেক সময়ে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্ডিস হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় শরীরে এমন হরমোন বার হয়, যা থেকে জন্ডিস হতে পারে। তাই তাঁদের নজরে রাখতে হয় এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হয়। তবে মায়ের জন্ডিস হলেও গর্ভস্থ সন্তানের জন্ডিস না-ও হতে পারে, বলে জানালেন ডা. তালুকদার। কিন্তু তা-ও সাবধানতা জরুরি যেহেতু এ ক্ষেত্রে দু’টি প্রাণ একসঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা তাই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
কুসংস্কার ও খাদ্যাভ্যাস
জন্ডিস হলে হলুদ খেতে নেই, এ ধরনের কিছু মিথ রয়েছে। ডা. তালুকদারের মতে, সেগুলোর কোনও ভিত্তি নেই। তবে জন্ডিস হলে বেশি তেল-মশলাযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত নয়। তখন রোগীর পেট ভাল থাকে না। তাই বেশি ফ্যাট জাতীয় খাবার (মাখন, ডিম ইত্যাদি) কম খাওয়া উচিত। বরং সহজপাচ্য খাবার খান। ডা. মণ্ডল জানালেন, জলবাহিত কারণে জন্ডিস (হেপাটাইটিস এ)-এর ক্ষেত্রে দিনে অন্তত চার বার মলত্যাগ করলে ভাল। এই জন্ডিসের জীবাণু খাদ্যনালিতে থাকে। ফলে মলের সঙ্গে এই জীবাণু শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। জল বেশি করে খাওয়া উচিত, যাতে শরীর হাইড্রেটেড থাকে। জামাকাপড়ও পরা উচিত হাল্কা।
ডা. মণ্ডল বললেন, অনেকে জন্ডিস হলে আখের রস খান। যেহেতু তেল জাতীয় খাবার বারণ থাকে, তাই পর্যাপ্ত ক্যালরি জোগাতে অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার দিতেই এ ধরনের ফল দেওয়া হয়। কিন্তু আখ ইত্যাদির মধ্যে জন্ডিস সারানোর মতো উপাদান নেই। তবুও আখের রস বা গ্লুকোজ়ের জল খেলে তৈরি করার পরেই খেয়ে নেওয়া ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy