মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একের পর এক সিদ্ধান্তে হতচকিত বিশ্ব। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে দূরপাল্লার হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিল পেন্টাগন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৫ ০৭:৩১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২২
এক দিকে রাশিয়ার সঙ্গে সখ্য বৃদ্ধি। অন্য দিকে নেটো থেকে নাম প্রত্যাহারের হুমকি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শরীরী ভাষায় বিশ্ব জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। এই আবহে নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের কথা ঘোষণা করল যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত চিনের রক্তচাপ বাড়াবে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
০২২২
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন সূত্রে খবর, এই প্রথম দূরপাল্লার হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র (লং রেঞ্জ হাইপারসোনিক ওয়েপন) মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী চলছে যাবতীয় প্রস্তুতি। শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিতে উড়ে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালানোর ক্ষমতা রয়েছে এই ক্ষেপণাস্ত্রের। তবে সেগুলিকে কোথায় মোতায়েন করা হবে, তা স্পষ্ট নয়।
০৩২২
চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমের কাছে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন পেন্টাগনের এক শীর্ষকর্তা। ডিফেন্স নিউজ়কে তিনি বলেন, ‘‘হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো সহজ নয়। সেই চ্যালেঞ্জের কারণে এর মোতায়েনে প্রচুর বিলম্ব হয়েছে। চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৪-’২৫) শেষে এগুলিকে মোতায়েন করা সম্ভব হবে।’’
০৪২২
গত কয়েক দশক ধরে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে জলের মতো টাকা খরচ করেছে রাশিয়া এবং চিন। দু’টি দেশকেই ঘন ঘন এই ধরনের অতি শক্তিশালী মারণাস্ত্র পরীক্ষা করতে দেখা গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেন যুদ্ধে এই শ্রেণির ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ব্যবহারও করেছে মস্কো। ফলে হাইপারসোনিক প্রযুক্তি নিয়ে আমেরিকার প্রতিরক্ষা গবেষকদের উপর চাপ বাড়ছিল।
০৫২২
হাইপারসোনিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিজেদের এক নম্বরে রাখতে একসঙ্গে দু’টি প্রকল্প চালিয়েছে পেন্টাগন। সেটি হল, দুরন্ত গতির এই ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ এবং একে প্রতিহত করার ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) গড়ে তোলা। প্রথমটিতে সাফল্য এলেও, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এখনও সেটা পায়নি আমেরিকা।
০৬২২
পেন্টাগন সূত্রে খবর, ২০২৩ সালের মধ্যে দূরপাল্লার হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা ছিল মার্কিন সেনার। ঠিক হয়, মারণাস্ত্রগুলিকে ওয়াশিংটনের লুইস-ম্যাককর্ডের জয়েন্ট বেসে নিয়ে যাওয়া হবে। সেগুলি চালানোর নিয়ন্ত্রণ তৃতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের পঞ্চম ব্যাটালিয়ন এবং ১৭ নম্বর ফিল্ড আর্টিলারি ব্রিগেডের হাতে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
০৭২২
কিন্তু, ওই সময়ে লঞ্চার এবং লঞ্চ সিকোয়েন্সজনিত প্রযুক্তিগত সমস্যায় ভুগছিল মার্কিন সেনা। ফলে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের প্রাথমিক লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী। আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এই মারণাস্ত্রের একের পর এক পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ বাতিল করতে বাধ্য হয় পেন্টাগন।
০৮২২
বিষয়টি নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মার্কিন সেনার পদস্থ কর্তা ডগ বুশ। তাঁর কথায়, ‘‘এই ধরনের মারণাস্ত্র মোতায়েনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিরাপত্তা। সেখানে কোনও গলদ থাকা চলবে না। আর তাই রণাঙ্গনে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যাওয়ার আগে এর একাধিক পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।’’
০৯২২
বুশ জানিয়েছেন, প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় বেশ কয়েক বার সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তার সীমারেখা মেনে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারেনি মার্কিন প্রতিরক্ষা গবেষকদের তৈরি হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে এতে প্রযুক্তিগত কিছু বদল করেন তাঁরা। এর পর চূড়ান্ত পরীক্ষায় সাফল্য মেলে। ফলে মারণাস্ত্রটির মোতায়েনে বিলম্ব হয়েছে।
১০২২
গত বছর হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের একাধিক পরীক্ষামূলক কর্মসূচিতে মঞ্জুরি দেয় পেন্টাগন। ফলে মারণাস্ত্রটি তৈরির প্রকল্প গতি পেয়েছিল। ২০২৪ সালের মে মাসে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের প্রশান্ত মহাসাগরীয় রেঞ্জে হাইপারসনিক হাতিয়ার পরীক্ষা করে মার্কিন সেনা। সেখানে এর ‘এন্ড টু এন্ড ফ্লাইট’-এর উপর কড়া নজর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজি কর্তাদের।
১১২২
ওই পরীক্ষায় নবনির্মিত ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা দেখে চমকে গিয়েছিল পেন্টাগন। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস ফোর্স স্টেশন থেকে আরও একটি হাইপারসোনিক হাতিয়ারের সফল পরীক্ষা চালায় আমেরিকা। এর পরই মারণাস্ত্রটির মোতায়েনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন পেন্টাগনের কর্তাব্যক্তিরা।
১২২২
মার্কিন সেনাবাহিনীতে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের কোড নাম ‘ডার্ক ঈগল’। এর পাল্লা ২৭৬০ কিমি বলে জানা গিয়েছে। স্থলভাগের উপর লঞ্চার রেখে সেখান থেকে এর উৎক্ষেপণ করা হয়। নৌ এবং বায়ুসেনার জন্য এই ক্ষেপণাস্ত্রের আলাদা প্রকার তৈরি করা হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।
১৩২২
সূত্রের খবর, ট্রাকের উপর রাখা লঞ্চার থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র চালাতে পারবে মার্কিন সেনা। সে ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ছ’হাজার কিমিরও বেশি গতিতে উড়ে যাবে ওই ব্রহ্মাস্ত্র। লঞ্চ হওয়ার পর প্রথমে ক্ষেপণাস্ত্রটি পৌঁছবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে। তার পর সেখান থেকে সুনির্দিষ্ট নিশানায় আছড়ে পড়বে সেটি।
১৪২২
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে সক্ষম হওয়ায় ‘এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের’ সাহায্যে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। মোতায়েনের আগে এর ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমেরিকার সৈনিকদের নিতে হয়েছে অন্তত পাঁচ বছরের প্রশিক্ষণ।
১৫২২
গত বছরের ২১ নভেম্বর ইউক্রেনীয় শহর ডেনিপ্রোতে ‘আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ (ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম) দিয়ে হামলা চালায় রুশ ফৌজ। হাতিয়ারটির সাঙ্কেতিক নাম ‘ওরেশনিক’, রুশ ভাষায় যার অর্থ হ্যাজেল গাছ। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র।
১৬২২
‘অপারেশন ডেনিপ্রো’র কিছু ক্ষণের মধ্যেই টিভিতে ভাষণ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘নতুন ধরনের প্রথাগত মাঝারি পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে (ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইআরবিএম) হামলা চালানো হয়েছে। শব্দের ১০ গুণ গতিতে (১০ ম্যাক) উড়ে গিয়ে সেটি লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে।’’
১৭২২
রুশ প্রেসিডেন্টের দাবি সত্যি হলে সেকেন্ডে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে ‘ওরেশনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র। ইউক্রেনের গুপ্তচর বাহিনীর রিপোর্ট অনুযায়ী, রাশিয়ার আস্ট্রাখান এলাকা থেকে এটিকে ছোড়ে পুতিন ফৌজ, ডেনিপ্রো থেকে যার দূরত্ব প্রায় হাজার কিলোমিটার (৬২০ মাইল)। লক্ষ্যে আঘাত হানতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় নিয়েছিল ‘ওরেশনিক’।
১৮২২
কিভের সেনাবাহিনীর দাবি, শব্দের চেয়ে ১১ গুণ গতিতে উড়ে এসে হামলা চালায় ওই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। মোট ছ’টি ওয়ারহেডে সজ্জিত ছিল ‘ওরেশনিক’। সেগুলির প্রতিটি থেকে আবার ডেনিপ্রোর উপর আছড়ে পড়ে ছ’টি করে বিস্ফোরক ভর্তি হাতিয়ার। ইউক্রেনীয় শহরকে ধূলিসাৎ করার ভিডিয়ো পরে প্রকাশ করে মস্কো।
১৯২২
এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের একেবারে গোড়ার দিকে ‘কিনজ়েল’ নামের একটি হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল মস্কো। যুদ্ধবিমান থেকে সেটিকে নির্দিষ্ট নিশানায় ছোড়া হয়। ‘ব্রহ্মাস্ত্র’টির ধ্বংস ক্ষমতা দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত ছিল পোল্যান্ড-সহ বাল্টিক এলাকার অন্যান্য দেশ।
২০২২
মস্কোর মতোই চিনের হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বর্তমানে ডিএফ-১৭, ডিএফ-৪১ এবং ডিএফ-জ়েডএফ নামের একাধিক এই ধরনের উচ্চ গতির মারণাস্ত্র রয়েছে বেজিংয়ের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র অস্ত্রাগারে। তবে এগুলির কার্যকারিতা নিয়ে বার বার সন্দেহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমি দুনিয়া।
২১২২
গত তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে তৎপর হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেই লক্ষ্যে কিভকে হাতিয়ার সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ফলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে মস্কোর। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের সম্পর্কে দেখা দিয়েছে ফাটল।
২২২২
পাশাপাশি, চিন, কানাডা এবং মেক্সিকোর সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে নেমেছেন ট্রাম্প। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে বেজিং। পাশাপাশি, ওয়াশিংটনের উপরে উচ্চ হারে শুল্ক চাপিয়ে ‘ইটের জবাব পাটকেল’ নীতি নিয়েছে ড্রাগন। এই পরিস্থিতিতে পেন্টাগনের হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।