বছর পাঁচেকের মধ্যে ‘অটিজ়ম’ শব্দটা বাঙালির অভিধানে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিল। কী ভাবে? সচেতনতা, জীবনচর্যা, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, না কি অন্য কিছু— স্পষ্ট বলতে পারেন না চিকিৎসক বা থেরাপিস্ট কেউই। এ অসুখের কারণ নিয়েও যে এখনও কেবলই ধোঁয়াশা। তবে, গত কয়েক বছরে অটিজ়ম স্পেক্ট্রাম ডিজ়অর্ডার যে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ তার ডায়াগনসিস যে বেশি হচ্ছে, সে কথা তাঁরা সকলেই অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারেন। তবু এ নিয়ে আজও প্রভূত লজ্জা, ভয়, সঙ্কোচ। অটিজ়মের ক্ষেত্রে যেমন সবচেয়ে বড় স্তম্ভ শিশুর বাবা-মা, তেমন তাঁরাই আবার কখনও চ্যালেঞ্জও বটে, বহু ক্ষেত্রে যাঁরা সমস্যা মানতে চান না, চিকিৎসাও তাই হয় না। আবার তাঁদের যথাযথ ভাবে বোঝানো বা পথ দেখানোর উদ্যোগের অভাবও যে আছে, তা-ও ঠিক। অতএব শব্দটা ক্রমশ পরিচিত হলেও সমস্যাটা নিয়ে সমাজের জ্ঞান কতখানি, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আপাতত এই রোগের গোড়ার কথাগুলো জেনে নেওয়া দরকার।
কী করে চিনব?
সাইকায়াট্রিস্ট আবীর মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘যে বাচ্চাকে একা ছেড়ে দিলে সে সম্পূর্ণ খোলসে গুটিয়ে যায়, চারপাশের সঙ্গে যোগস্থাপন করে না, সে অটিজ়ম স্পেক্ট্রামের মধ্যে পড়ছে বলে মনে করা যায়। কিছু বাচ্চাকে দেখলেই, তারা যে আর পাঁচ জনের চেয়ে আলাদা, এটা বুঝে নেওয়া যায়। তার অনেক রকম অসুখই থাকতে পারে, যার একটা অটিজ়ম। এর কতকগুলো ধারা আছে। একটি, সামাজিক ভাবে যোগস্থাপনের সমস্যা বা ‘সোশ্যাল কমিউনিকেটিভ প্রবলেম’। তা চেনার উপায় আছে।’’
* এই বাচ্চারা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না, ডাকলে সাড়া দেয় না, খিদে বা অন্যান্য চাহিদা বুঝিয়ে বলতে পারে না। এদের কথা বলার সমস্যা থাকে। ভার্বাল স্পিচ ডেভলপমেন্ট দেরিতে হয়, অর্থাৎ কথা ফুটতে সময় লাগে অথবা তা হলেও হয় বিচিত্র।
* আমরা যেমন শব্দ জুড়ে বাক্য তৈরি করি অথবা প্রশ্নের উত্তর দিই (‘রেসিপ্রোকাল কমিউনিকেশন’), এরা তা পারে না। কখনও হয়তো কথা বলে উঠল, তার পর আবার চুপ। গলার স্বরও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, কখনও চেঁচিয়ে কখনও-বা ফিসফিস করে কথা বলে। কখন কথা বলতে হবে, তা-ও তারা বুঝতে পারে না। অন্যের কথার মাঝখানেই হয়তো কথা বলে ওঠে।
* এদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি (কেউ বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়) অথবা মুখভঙ্গি (চোখমুখ অদ্ভুত ভাবে পাকায়, তেরচা ভাবে তাকায়) স্বাভাবিক হয় না।
যে হেতু এরা পরিবেশের সঙ্গে যোগস্থাপন করতে পারে না, তাই তারা নিজের জগতে থাকতেই স্বচ্ছন্দ। সকলের সঙ্গে মিশে কাজ করা, এমনকি খেলাধুলোও অপছন্দ। ডা. মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “এখানে কল্পনার অভাব কাজ করে। যে কারণে এরা এমপ্যাথি বা সমানুভূতিও প্রকাশ করতে পারে না। বাবা-মা বকলে বা কাঁদলে বা হাসলে প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না এই ধরনের শিশুরা।”
অটিজ়মের সমস্যা বুঝতে তার নানা ধরন চিনে নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন অলকেন্দু বোধ নিকেতন রেসিডেনশিয়াল-এর কোর্স কো-অর্ডিনেটর শ্রেয়শ্রী কুণ্ডু। তিনি বললেন, “অনেক সময়ই দেখা যায়, ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চার ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোন একদম ঠিকঠাক। তার পরেই আচমকা কথা বন্ধ— শেখা জিনিসও ভুলে গেল আর মনের বিকাশও থেমে গেল।” অনেক বাবা-মা এটা মানতেই পারেন না। তাঁরা ভাবেন, কয়েক মাস আগেও যার কথাবার্তা, আচরণ স্বাভাবিক ছিল, তার এমন হয়? বিপদের কথা, এটাই আসলে হয়। তবে এই শিশুর বুদ্ধি কিন্তু অন্যদের চেয়ে কম নয়। অনেকেরই বুদ্ধি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়। তারা ছড়া বলতে পারে তরতর করে, রং করতে পারে খাতায়। শুধু কেউ নির্দেশ দিলে তা আর পালন করতে পারে না। এটাই সমস্যার গোড়ার একটা চিহ্ন।
সমস্যার দ্বিতীয় ধারা, কার্যকলাপের পুনরাবৃত্তি ও কথাবার্তা বা ‘রিপিটেটিভ অ্যাকশন অ্যান্ড স্পিচ’। হাততালি দেওয়া, চেয়ার দোলানো, দৌড়ানোর মতো কাজ বারবার করে চলা কিংবা এক কথা বলেই যাওয়া বা এক জিনিসের দিকে তাকিয়েই থাকা (যেমন পাখা ঘোরা) — এগুলোই এর লক্ষণ। আরও কিছু অস্বাভাবিক কার্যকলাপ (যাকে ‘রেস্ট্রিক্টেড বিহেভিয়ার’ বলা হয়), যেমন তীব্র আলো বা কলের জলের ধারার দিকে তাকিয়ে থাকা কিংবা দড়ির টুকরো বা ময়লার ঝুড়ির মতো অকিঞ্চিৎকর জিনিস একদৃষ্টে পর্যবেক্ষণ করে চলা— এগুলোও লক্ষণ হতে পারে। ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, যারা আপন জগতে বিরাজ করে, তাদের আচরণ এমনই হয়, যা বাকিদের সঙ্গে খাপ খায় না। তাই রুটিনের বদলও মানিয়ে নিতে পারে না এই শিশুরা। ঘরের সাজসজ্জা সামান্য পাল্টে গেলেও তাদের খুব অসুবিধে হয়, তারা চিৎকার করে আপত্তি জানায়। এ প্রসঙ্গে শ্রেয়শ্রী বলেন, “রিচুয়ালিস্টিক বিহেভিয়ার দিয়েও এদের চেনা যায়। যেমন, লজেন্স খেতে দিলে সেগুলো লাইন করে সাজিয়ে ফেলে।”
এ ছাড়া, সেনসরি বা ইন্দ্রিয়জনিত দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। এরা কেউ হাইপারসেন্সিটিভ— অল্প আওয়াজেই চমকে ওঠে; কেউ-বা হাইপোসেন্সিটিভ — হাতে গরম জল পড়লেও নির্বিকার। আর পঞ্চেন্দ্রিয়ের ভারসাম্যের অভাবের কারণেই কখনও কেউ বিচিত্র ভঙ্গিতে হাঁটে, অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসের গন্ধ শোঁকে, বেশি করে হাত ঘষে ইত্যাদি।
কখনও সারবে না?
শ্রেয়শ্রী বলেন, বাচ্চার যে সমস্যা আছে এবং তা নিয়েই যে সারা জীবন চলতে হবে, এ কথাটা গোড়ায় মেনে নেওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে এই সমস্যায় যথাসময়ে হস্তক্ষেপ ঘটবে এবং তার ফলে যথাযথ শুশ্রূষাপদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব হবে। এমন অনেক শিশুই আছে, যারা পরবর্তী জীবনে ভাল ভাবে লেখাপড়া করতে পেরেছে, প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আসলে থেরাপিকেই ওষুধের মতো বলে মনে করেন শ্রেয়শ্রী। থেরাপির ভাগগুলি জেনে নেওয়া দরকার।
* বিহেভিয়ার মডিফিকেশন থেরাপি: পুনরাবৃত্ত কার্যকলাপই যে হেতু এদের সমাজের সঙ্গে মেলামেশার পথে প্রধান বাধা, তাই সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য কার্যকলাপ কী ভাবে করতে হয়, তা শেখানো হয়।
* স্পেশ্যাল এডুকেশন: সাধারণ পন্থা বা পাঠ্যক্রমে এরা মানিয়ে নিতে পারে না অনেক সময়েই। সে জন্য বিশেষ পড়াশোনার ব্যবস্থা।
* প্লে থেরাপি: খেলাধুলোর মাধ্যমে শিখিয়ে বা পড়িয়ে মেলামেশার সমস্যা অনেকটা অতিক্রম করা যায়।
* স্পিচ থেরাপি: কথা বলার বাধা দূর করতে পারলে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজও সহজতর হয়।
* পেরেন্ট চাইল্ড ইন্টারঅ্যাকশন থেরাপি: বাইরের পরিবেশে স্বাভাবিক থাকলেও বাড়িতে হঠাৎই হিংস্র হয়ে উঠতে পারে শিশু। পরিকল্পনামাফিক বাবা-মায়ের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটালে এই সমস্যা বহু দূর নিরাময় হতে পারে।
এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিগুলিকে বলে অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়োরিয়াল থেরাপি (এবিটি)। অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়োরিয়াল অ্যানালিসিস (এবিএ)-এর মাধ্যমে এই অভিনব পন্থাগুলো তৈরি করা হয়। এখানে নির্দিষ্ট পন্থায় ধাপে ধাপে নতুন জিনিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো হয় অটিস্টিক শিশুর। কখনও তাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কিছু জিনিস দেওয়া হয়। তবে কি এই অসুখে ওষুধের ব্যবহার একেবারেই নেই? ডা. মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “প্রধান উপসর্গগুলোতে থেরাপিই কার্যকর। তবে সেই পন্থায় যাওয়ার জন্য যে যে বাধা অতিক্রম করতে হয়, তাতে ওষুধ লাগতে পারে। যেমন, যারা আগ্রাসী হয়ে ওঠে বা ঘুমের অসুবিধে থাকে, তাদের ওষুধ দিতে হয়। অনেকের অতিরিক্ত চঞ্চলতার কারণে মনঃসংযোগের অভাব থাকে। ওষুধের প্রয়োজন তখনও।”
তবে স্পেশ্যাল এডুকেশন হোক বা থেরাপি, সবচেয়ে বেশি জরুরি বাবা-মায়ের ভূমিকাই। তাঁরা যেন বিস্মৃত না হন, অটিস্টিক শিশুকে সারা জীবন নজর দিতে হবে এবং অনেকে শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাপনও করতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy