Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
Bhoot Chaturdashi

কেমন আছে বাংলার ব্রহ্মদৈত্য, মামদো, শাকচুন্নিরা? পশ্চিমি ভূতেদের দাপটে কোণঠাসা কি ‘তেনারা’?

সাবেক বাঙালি ভূতেরা কি আজ বেপাত্তা? সাহেবি ভয়ের জগৎ কি হাওয়া করে দিল ‘তেনাদের’? ভূত চতুর্দশীর লগ্নে বাঙালি সমাজের দিশি-বিলিতি ভয়ের হাল-হকিকত সন্ধান করল আনন্দবাজার অনলাইন।

A survey of the Bengali world of ghosts

‘তেনাদের’ কে যে কখন কোথায় খাপ পেতে আছেন, বলা মুশকিল। চিত্রাঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:০৬
Share: Save:

আজ ভূত চতুর্দশী। এমন তিথিতে তেনাদের বিষয় একটু স্মরণে না আনলে পাপ হয় বলেই বিশ্বাস ইদানীং কালে। তবে সাম্প্রতিক কালে তেনাদের খানিক পায়াভারী হয়েছে। কারণ গুরুগম্ভীর। এত কাল ভয়ের গল্পে আর শিশুতোষ আখ্যানে আটকে থাকলেও তেনাদের মর্যাদা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক চর্চায় উঠে এসেছেন বলে। সম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে সমাজবিদ তিথি ভট্টাচার্যের গবেষণাগ্রন্থ ‘ঘোস্টলি পাস্ট, ক্যাপিটালিস্ট প্রেজ়েন্স: আ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ ফিয়ার ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিথি বঙ্গভূমিতে বহমান ভয়গুলির আর্থ-সামাজিক উৎস সন্ধান করেছেন। ইতিপূর্বে পশ্চিমে ভূত বা অতিপ্রাকৃত জগৎ বিষয়ে গবেষণা হলেও বাংলার ভৌতিকতা নিয়ে সুকুমার সেনের ‘গল্পের ভূত’ নামে ক্ষুদ্র বইটি ছাড়া বিশেষ একটা বিশ্লেষণী আলোচনা দেখা যায়নি। তবে কিছু কাল আগে ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান ঘোস্টস’-এ দিশি ভূতেদের একটা কুলুজি নির্মাণের প্রয়াস নিয়েছিলেন। আর প্রায় কাছাকাছি সময়েই জে ফার্সিফার ভৈরব এবং রাকেশ খন্না ভারতীয় অতিপ্রাকৃত জগতের বাসিন্দাদের বিষয়ে একখানা আস্ত অভিধানই লিখে ফেলেছেন ‘ঘোস্টস, মনস্টারস অ্যান্ড ডেমনস অফ ইন্ডিয়া’ নামে। সুতরাং, তেনাদের নিয়ে যত্রতত্র রসিকতা করাটা ব্রহ্মদত্যি, মামদো, স্কন্ধকাটা, শাঁকচুন্নি, পেত্নি প্রমুখের না-পসন্দ হওয়াটা মোটেই আশ্চয্যির নয়।

তিথি ভট্টাচার্য তাঁর বইয়ের উপক্রমণিকাতেই একটি জরুরি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সে কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থের একেবারে গোড়াতেই শৈশবের ভয়গুলির কথা লিখেছিলেন।

“রাত্রি ন’টা বাজলে ঘুমের ঘোরে ঢুলু ঢুলু চোখে ছুটি পেতুম। বাহিরমহল থেকে বাড়ির ভিতর যাবার সরু পথ ছিল খড়্খড়ির আব্রু-দেওয়া, উপর থেকে ঝুলত মিটমিটে আলোর লণ্ঠন। চলতুম আর মন বলত কী জানি কিসে বুঝি পিছু ধরেছে। পিঠ উঠত শিউরে। তখন ভূত প্রেত ছিল গল্পে-গুজবে, ছিল মানুষের মনের আনাচে-কানাচে। কোন্ দাসী কখন হঠাৎ শুনতে পেত শাঁকচুন্নির নাকি সুর, দড়াম করে পড়ত আছাড় খেয়ে। ঐ মেয়ে-ভূতটা সবচেয়ে ছিল বদমেজাজি, তার লোভ ছিল মাছের ’পরে। বাড়ির পশ্চিম কোণে ঘন-পাতা-ওয়ালা বাদামগাছ, তারই ডালে এক পা আর অন্য পা’টা তেতালার কার্নিসের ’পরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকে একটা কোন্ মূর্তি— তাকে দেখেছে বলবার লোক তখন বিস্তর ছিল, মেনে নেবার লোকও কম ছিল না।”

A survey of the Bengali world of ghosts

পেত্নিকুলের খবর মোটেই ভাল নয় ইদানীং। ছবি: পিক্স্যাবে।

পরে এই ভয়গুলি আর নিজেদের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেনি। রবীন্দ্রনাথ তার খানিক পরেই লিখছেন শহর কলকাতার নগরালির বদলের কথা। জলের কল, গ্যাস থেকে বিজলি বাতির দিকে শহর গড়িয়ে গেলেই সেই সব ভয়েরা, ভয়ের উৎসেরা উধাও। তঁর কথায়, “ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গিয়েছে।”

তিথি ভট্টাচার্য তাঁর বইতে এই ‘আলোর জগৎ’টিকে নিয়ে ভেবেছেন, ভাবিয়েছেন। বাংলার আবহমানের ভূতেরা, ব্রহ্মদৈত্য, পেত্নি, শাঁকচুন্নি প্রমুখ ভাবগত দিক থেকে পশ্চিমি শিক্ষার ‘আলো’য় আর বস্তুগত দিক থেকে বিজলি বাতির ‘আলো’য় ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে। আর তার বদলে ক্রমে জাঁকিয়ে বসেছে অন্য কিসিমের ভয়ের জগৎ। তাতে অবশ্য ভয়ের সঙ্গে কৌতূহলও অনেকখানি মিশে ছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই এক সময়ে বিপুল ভাবে আগ্রহী হয়ে পড়েন প্রেততত্ত্ব চর্চায়। অংশ নিতে থাকেন ‘সিয়াঁস’ বা ‘প্ল্যানচেট’-এর আসরে। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, প্রেততত্ত্ব চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় শহুরে শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণির এক উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যেই। যার ফলে সাবেকি কেতার ‘তেনারা’ আর স্বমহিমায় টিকে থাকতে পারলেন না। নেহাত ছেলেভুলোনো গপ্পের চরিত্র হয়েই থমকে গেলেন।

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, অন্ধকার জমাট বেঁধে ভূত হয়। কথাটি মারাত্মক। কোন অন্ধকারের কথা বলতে চেয়েছিলেন আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের অন্যতম আদিপুরুষ? পশ্চিমের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, বিশ্ব হরর সাহিত্যে নতুন যুগের প্রবর্তক আমেরিকান সাহিত্যিক হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফটের দৃষ্টিতে সভ্যতায় সবচেয়ে বড় ভয়টি হল ‘অজানা’ সম্পর্কিত ভয়। সে দিক থেকে দেখলে বাঙালি তার সমাজের চিরপচিরিত ভূতেদের, ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর, লীলা মজুমদার হয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত ‘তেনাগণ’কে তেমন একটা অজানা অচেনা সত্তা হিসাবে দেখেননি। ‘এক দেশে এক রাজা ছিল’— এই বাক্যটি দিয়ে যেমন এ দেশের আখ্যান শুরু হয়, তেমনই ‘এক গাছে এক ব্রহ্মদৈত্য থাকত’-সুলভ বাক্য দিয়েও গপ্পো শুরু হয়েছে অসংখ্য বার। তাকে ‘স্বাভাবিক’ ভাবেই নিয়েছে সমাজ। যদি মানুষ মরেই সেই কিসিমের ভূত হয়ে থাকে, তা হলে মায়ার বাঁধন কাটিয়ে সে বেশি দূর যেতে পারেনি। বাংলার শাঁকচুন্নি থেকে দেহাতি চুড়ৈল, ভূত সমাজের কুলীন ব্রহ্মদৈত্য থেকে একেবারে ছ্যাঁচড়া মেছোভূত বা রাস্তা গুলিয়ে দেওয়া ভুলোভূত জনপদের চৌহদ্দি টপকাতে পারেনি। রেতের বেলা খানিক হুজ্জুত পাকালেও তারা এক্কেবারে অচেনা বা অজানা নয়। যেমন, নিশুত রাস্তায় মাছ কিনে একা ফেরার সময় মেছো এসে জ্বালাতন করতেই পারে। মাছ ছাড়া ফিরলে তার বয়েই গেছে পিছু নিতে। অন্য দিকে ভুলো সব সময় সক্রিয় নয়। আর তাকে পরাহত করার মন্তরও গাঁয়ের মানুষের অজানা নয়। এমন ভাবেই গলায়দড়ে, স্কন্ধকাটা, মামদো— সকলেরই কিছু না কিছু নির্দিষ্ট ‘কাজ’ রয়েছে। জীবিত মানুষ যদি সজাগ থাকে, তা হলে তাদের এড়িয়ে যাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। ফলে আবহমানের ভৌতিক জগত যেন ইহলৌকিক দুনিয়ারই ‘এক্সটেনশন’ মাত্র। তবে ত্রৈলোক্যনাথের লেখায় উঠে আসা ভূত লুল্লু বা ঘ্যাঁঘো একদা মানুষ ছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। তারা যেন ‘বাই ডিফল্ট ভূত’। বিশেষ করে লুল্লুর মতো ছিঁচকে এবং মিচকে ও একই সঙ্গে অসভ্য ভূত একদা মানুষ ছিল, ভাবলে বেশি করে হৃৎকম্প হয়। বরং ভূতদশাতেই সে খানিক সহনীয়। ওই চরিত্রের মানুষ আশপাশে থাকলে তা ভূতের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কখন যে কার গিন্নিকে নিয়ে চম্পট দেবে বলা মুশকিল!

A survey of the Bengali world of ghosts

আর কত দিন নিজের মুন্ডু হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে স্কন্ধকাটাদের? ছবি: পিক্স্যাবে।

এই যে ফুরফুরে বাতাবরণ, এর ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে খুব ক্রুর ভয়ের জগৎ। এ দেশে মনোবিদ্যার পথিকৃৎ গিরীন্দ্রশেখর বসুর ভাষায় বলতে গেলে “ঐ বুঝি করে হাঁ নাহি যার নাম”। এই যে ‘অজানিত’ জগৎ, তা এ দেশে পশ্চিমি শিক্ষার বিস্তার হওয়ার আগে ছিল না। ভূত-প্রেত-পিশাচ, অতৃপ্ত আত্মা, দানো, উপ আর অপদেবতারা অবশ্যই ছিলেন। লোককথায়, মৌখিক ঐতিহ্যে, পৌরাণিক আখ্যানে, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’র মতো অগণিত সাহিত্যের সমান্তরালে তন্ত্রের ‘ডামর’ শাখার বিবিধ গ্রন্থে তাঁদের রকম-সকম বিস্তারিত বলা হয়েছিল। কিন্তু, পশ্চিমি গথিক সাহিত্যের আবডালে, কলকাতা শহরে নতুন গড়ে ওঠা পশ্চিমি ধাঁচের বাড়িতে, খ্রিস্টীয় গোরস্থানের স্থাপত্য-ভাস্কর্যে সেঁধিয়ে থাকা ‘তেনা’রা সেই সময় ‘অজানা’ বস্তু। লক্ষ করার ব্যাপার, শহর কলকাতায় হানাবাড়ি বলে যে হর্ম্যগুলি পরিচিত, রাইটার্স বিল্ডিং বা ন্যাশনাল লাইব্রেরির মতো প্রাসাদ, তাদের সব ক’টিই ইংরেজ প্রভুদের বানানো। স্থাপত্যের দিক থেকেও তাদের গর্ভে নানান গলিঘুঁজি, আলো-অন্ধকার। ফলে এই নতুন ‘ভূতের কেত্তন’ একান্ত ভাবেই যে পশ্চিমি শিক্ষা, দেশীয় মানুষের জীবিকার বদল এবং সেই সঙ্গে মানুষের একাকিত্ববোধের প্রসারণ ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, তা একটু হিসাব কষলেই অনুমান করা যায়।

তিথি ভট্টাচার্য তাঁর বইতে ১৯ শতক-পরবর্তী বঙ্গীয় ভূতেদের দু’টি শ্রেণিতে বিভাজিত দেখেছেন। প্রথমটি ব্রহ্মদৈত্য, শাঁকচুন্নি-জাতীয় পরম্পরাগত ভূত। আর দ্বিতীয়টি পশ্চিমি সাহিত্য-সংস্কৃতির উদর থেকে উঠে আসা প্রেতাত্মা, যাদের প্ল্যানচেট বা সিয়াঁস দ্বারা আবাহন করতে হয়। উল্লেখ্য, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা অতিপ্রাকৃত গল্পের মধ্যে যেমন ‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’-এ প্রথমোক্তেরা ভয়ানক চেহারা নিয়ে উপস্থিত, তেমনই আবার ‘পেয়ালা’র মতো গল্পে তিনি নিয়ে এসেছিলেন একেবারে পশ্চিমি সাহিত্যের ‘আনক্যানি’ তথা ‘ব্যাখ্যাতীত’ ভয়ের জগৎকে। সে দিক থেকে দেখলে, বিভুতিভূষণ যেন এক সন্ধিকালের লেখক, যিনি দুই জগৎকেই একসঙ্গে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। সমসময়ের বা তাঁর ঠিক পরবর্তী সময়ের লেখকদের মধ্যে কিন্তু পশ্চিমি ঘরানার ‘হরর’ই প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ করে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূতান্বেষী বরদা সিরিজের গল্পে প্রেতলোক ব্যপারটা দেশজ শিকড় ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ক্রুর ভয়ের জগৎ তৈরি করছে বলেই মনে হয়। পাশাপাশি আবার গজেন্দ্রকুমার মিত্রের অলৌকিক গল্পমালায় দেশজ ভয়ের উপাদানই বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে। তবে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এঁরা কেউই আর ত্রৈলোক্যনাথের উত্তরসাধক হিসাবে নিজেকে মেলে ধরেননি। ভৌতিক কৌতুক ব্যাপারটা খানিক কার্নিক মেরে ঢলে পড়ল লীলা মজুমদারের মতো লেখকের দিকে। সেখানে ‘হরর’ নেই, কিন্তু গা শিরিশির করে ওঠা অনুভূতি রয়েছে। ‘পেনেটিতে’ বা ‘পিলখানা’ পড়লে সেই শিরশিরে অনুভূতির সঙ্গে এসে মেশে একটা দীর্ঘস্থায়ী মনখারাপ।

A survey of the Bengali world of ghosts

বাংলার সনাতনী ভূতেদের তুলনায় পশ্চিমি ভূতেদের ধাত বেশ কড়া। ছবি: পিক্স্যাবে।

হেমন্তকাল ব্যাপারটাই কেমন গোলমেলে। এ দিকে ভূত চতুর্দশী, পশ্চিমে হ্যালোউইন, অল সোলস’ ডে। উৎসব আর আচারের মাঝখানে একটা মনখারাপ লুকিয়ে থাকেই। এই সময়ের মার্কিন লেখিকা অড্রে নিফেনেগার তাঁর সম্পাদিত ভৌতিক কাহিনি সঙ্কলন ‘ঘোস্টলি’র ভূমিকায় লিখেছিলেন, ভূতের গল্প মানেই তা অন্য দিক থেকে দেখলে বেদনার গল্পও। আজও কি ‘মণিহারা’ বা ‘নীশিথে’ পড়তে বসলে মনখারাপ হয়ে যায় না! পাঠক কি বিষণ্ণ হয়ে পড়েন না বিভূতিভূষণের ‘মায়া’ পড়তে বসলে? হেমন্তের ঝুপ করে নেমে আসা ঝুঁঝকো সাঁঝবেলায়, পাতাঝরার শিহরনে গুঁড়ো গুঁড়ো বিষাদ এমনিতেই উড়তে থাকে। আর অল সোলস’ ডে-র দিন যদি কেউ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের গোরস্থানে যান, সেখানে কবেকার প্রয়াত সব মানুষের কবরের উপরে আজকের বংশধরদের বাতি জ্বালানোর দৃশ্যে মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে পড়ন্ত বিকেলের মরা আলো। কেউ যদি এমন সময়ে ফাঁকা বাড়িতে এক বার প্রমথনাথ বিশীর ‘ফিরে ফিরে আসবে’র মতো আখ্যানের পাতা ওলটান, যেখানে এক অভিশপ্ত পরিবারে ক্রমাগত শিশু-কিশোরদের মৃত্যু গল্পের কথককে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে… তিনি বিষণ্ণতার এক আলোহীন সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়তে বাধ্য হবেন।

আজকে তিথির গবেষণার পাশাপাশি ভৈরব এবং খন্নার অভিধান খুলে বসলে এক অদ্ভুত দোটানায় গিয়ে পড়তে হয়। এক দিকে পশ্চিমের টানে ‘ভয়’ এক নতুন মাত্রা প্রাপ্ত হচ্ছে আর অন্য দিকে এই বিশাল দেশের আনাচকানাচে লোককথা, কিংবদন্তি আর মৌখিক সাহিত্যে ছড়িয়ে রয়েছে আদিম পৃথিবীর ভয়ের রাজত্ব। দ্বিতীয় ‘ভয়’টিকে তিথি তুলনা করেছেন বাঘ-ভালুক-নেকড়ে সংক্রান্ত ভয়ের সঙ্গে। যাদের স্বভাব মানুষের জানা। কিন্তু, বিংশ শতক জুড়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত প্রসারিত ভয়ের জগৎ সেই “ঐ বুঝি করে হাঁ নাহি যার নাম”-এর মুলুক। কোন দিক থেকে কখন যে কোন ভয় আছড়ে পড়বে, তা বলা মুশকিল।

A survey of the Bengali world of ghosts

কখনও কখনও আবার ভৌতিক কাহিনি ভয়কে ছাপিয়ে বেদনাকেই বড় করে তোলে। ছবি: পিক্স্যাবে।

বেলগাছের ব্রহ্মদৈত্য, সধবা মৎস্যলোভী শাঁকচুন্নি, নিশুত রাতে তিন বার নাম ধরে ডেকে যাওয়া নিশি কিংবা নিজের মুন্ডু নিজেরই হাতে নিয়ে ঘোরা স্কন্ধকাটারা আজকে নেহাতই ‘পিছড়ে বর্গ’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমের অতিপ্রাকৃত সাহিত্যও আজ বেজায় জটিল। স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্য শাইনিং’, ‘সালেম’স লট’ বা ‘দ্য পেট সেমেটারি’ পড়তে বসলে সেই অজানার ভয় খপ করে ঘাড়ে চেপে বসে। পোড়খাওয়া পাঠকও রাত দুটোয় বাথরুমে যাবেন কি না, মনস্থির করতে পারেন না।

বাংলা সাহিত্য কি সে দিকে হাঁটছে সমান্তরালে? বিগত কয়েক বছরে বাংলা হরর সাহিত্যের একটা রমরমা নজরে এসেছে। ও পার বাংলায় হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল বা মুহম্মদ আলমগীর তৈমূরের মতো লেখক আর অনীশ দাস অপুর মতো সম্পাদকের কল্যাণে হরর একটা ইন্ডাস্ট্রির চেহারা নিয়ে ফেলেছে। তার পর তাতে যুক্ত হয়েছে নুহাশ হুমায়ূনের মতো চলচ্চিত্র পরিচালকের ছবি, যেখানে দেশজ ভয়গুলিকেই, মানে মেছোপেত্নি, জিন, নিশি-র মতো একান্ত চেনা ভূতেরাই তৈরি করছে বেমক্কা ভয়ের পরিমণ্ডল। এ পার বাংলায় সেই স্তরে চর্চা না হলেও শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের মতো তরুণ সাহিত্যিক ‘একানড়ে’র মতো উপন্যাসে ফিরিয়ে এনেছেন বাঙালির শৈশবের একান্ত ভয়ের জগৎকে। তবে, সে সব নিতান্তই আকাঁড়া ভয়ের দুনিয়া। ভূত চতুর্দশীর মতো এক ঐতিহ্যমেশা দিনে ও সব কথা ভাবতে বসলে ব্রহ্মদত্যি, মামদো, স্কন্ধকাটারা ‘মাইন্ড’ করতে পারেন। বছরের অন্য দিনগুলোয় বাঙালি ভূত-রসিকেরা রাতবিরেত স্টিফেন কিং কি লাভক্র্যাফট পড়ে কাটালেও এই একটি দিন, থুড়ি রাত ‘তেনাদের’। সাহেবি ভূতদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আজ রাতে এখানে বেলগাছে হুঁকো হাতে আয়েস করবেন ব্রহ্মদৈত্য, টাটকা মাছের গন্ধ পেয়ে মন উচাটন হবে মেছোপেত্নির, একলা পথিককে রাস্তা ভুলিয়ে মজা দেখবে ভুলোভূত, জলায় নিজের বাসনার আগুন জ্বালিয়ে লহমার জন্য দপ করে জ্বলে উঠবে আলেয়া, তালগাছের একাকিত্বে আনমনা প্রহর কাটাবে একানড়ে। আজকের রাতটিতে বরং এই বিশ্বাস নিয়েই বাঙালি ঘুমোতে যাক যে, রাতনিশুতে কেউ তিন বার নাম ধরে ডাকলে স্পিকটি নট হয়ে বিছানায় সেঁটে থাকাই শ্রেয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE