বাড়ির পথে নার্গিস।—নিজস্ব চিত্র।
পরনে মলিন কুর্তা-পাজামা, গলায় গামছা জড়ানো দেহাতি বয়স্ক মানুষটি নার্সের হাত ধরে আসা মহিলাকে দেখেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন “বেটি তু জিন্দা হ্যায়! আল্লাহ ইতনা মেহেরবান! তু জিন্দা হ্যায়!” মহিলা ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বাবা-র বুকে। “আব্বু আপ আ গয়ে! মুঝে ঘর লে জাইয়ে, আম্মিকে পাস, বাচ্চোকে পাস।”
প্রায় আট মাস বিচ্ছেদের পর বাবা-মেয়ের অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলন। ‘অপ্রত্যাশিত’ কারণ, সরকারি হাসপাতালে পুলিশের মাধ্যমে পথঘাট থেকে তুলে আনা মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষের আশ্রয় হয়তো জোটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের দিনযাপন হয় নিতান্ত অমানবিক, যত্নহীন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হয়ে তাঁদের বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছেন, এমন প্রয়াস দুর্লভ। ফলে দিনের পর দিন তাঁরা পড়ে থাকেন হাসপাতালের পূতিগন্ধময় কোণে।
নার্গিস এবং ইজহার আলির ভাগ্য সহায়। তাঁদের জীবন কাহিনি বাঁক নিয়েছে অন্য খাতে। সৌজন্যে টালিগঞ্জের এম আর বাঙুর হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন নার্গিসকে বাড়ি ফেরানোর। চার মাসের চেষ্টায় বিহারের বক্সারের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আনা গিয়েছে বাবা ইজহারকে। হাসপাতালই ট্রেনের খরচা দিয়েছে। গত ৬ নভেম্বর হারানো মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালের কেটে দেওয়া টিকিটেই ট্রেনে চেপে বক্সারের চানওয়াথ গ্রামে ফিরে গিয়েছেন ইজহার। দু’হাতে আশীর্বাদ আর ধন্যবাদ দিয়েছেন হাসপাতাল সুপার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার, কর্মী, পুলিশ প্রত্যেককেই।
বাঙুরের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, ৭ জুলাই কসবা থানার পুলিশ বালিগঞ্জ স্টেশনের ধার থেকে অর্ধচেতন নার্গিসকে তুলে আনে। কথাবার্তা অসংলগ্ন ছিল। বাঙুরে আলাদা একটি ওয়ার্ড রয়েছে এমন মানসিক-অসুস্থ অজ্ঞাতপরিচয় রোগীদের জন্য। সেখানেই ঠাঁই হয় নার্গিসের। ঠিকানা বা আত্মীয়দের নাম বলতে পারছিলেন না। যাঁকেই দেখতেন, ছুটে গিয়ে বাড়ি ফেরার আর্জি জানাতেন। বলতেন, বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে। তাদের খাওয়াতে হবে।
বাঙুর কর্তৃপক্ষ জানান, বাড়ি ফিরতে না-পারার ক্ষোভে ক্রমশ হিংসাত্মক হয়ে উঠছিলেন নার্গিস। বেশ কয়েক বার অন্য রোগীদের মাথা ফাটিয়েছেন। দরজার তালা ভেঙেছেন তিন-চারটি। চিকিৎসকেরা জানান, নার্গিস ‘গ্রিফ ট্রমা সিনড্রোম’-এ ভুগছেন। অবিলম্বে পরিজনদের সঙ্গে দেখা না-করালে রোগ এতটাই বাড়তে পারে যে, তাঁকে আর কোনও দিনই সুস্থ করা যাবে না। তখনই নার্গিসের বাড়ির লোকের খোঁজ শুরু করেন বাঙুর কর্তৃপক্ষ। কাউন্সেলিং করতে করতে ২৮ অক্টোবর নার্গিস তিনটি নাম বলতে পারেন। ‘চানওয়াথ’, ‘নওয়ানগর’ এবং ‘ইজহার’। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্যে খোঁজ শুরু হয় ইন্টারনেটে।
সোমনাথবাবুর কথায়, “দেখা যায়, নওয়ানগর বক্সার জেলার একটি পিছিয়ে পড়া ব্লক। তার মধ্যে আরও পিছিয়ে থাকা গ্রাম চানওয়াথ। সেখানকার পুলিশই ‘ইজহার’ নাম নিয়ে খোঁজ করে নার্গিসের বাবার হদিস পায়। ৪ নভেম্বর ইজহার আলির সঙ্গে নার্গিসের কথা বলানো হয়। ৬ নভেম্বর কলকাতায় এসে পৌঁছন ইজহার। হাসপাতালের কর্মীরাই তাঁকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসে। ইজহার জানান, নার্গিস মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন প্রায় ২ বছর। তাঁর স্বামী ফকরুদ্দিন লুধিয়ানায় লোহা কারখানার শ্রমিক। শ্বশুরবাড়ি ভোজপুরের মানসাগর গ্রামে। কিন্তু মাথার অসুখ দেখা দেওয়ায় তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চানওয়াথে চলে যান নার্গিস।
ইজহারের কথায়, “আট মাস আগে এক দিদির সঙ্গে নার্গিসকে লুধিয়ানায় পাঠিয়েছিলাম। ট্রেনে শৌচাগারে যাওয়ার পর থেকে আর ওকে পাওয়া যায়নি। আমরা অনেক খুঁজেছি। খবরের কাগজ, টিভিতে ছবি দেখিয়েছি। ভেবেছিলাম ও মরে গিয়েছে। ওকে ফিরে পাব ভাবতেই পারিনি।” এ দিকে, বাবার আসার কথা শুনে ৪ নভেম্বর থেকে একটানা হাসপাতালের ঘরে শুধু নিজের ছেঁড়া পোঁটলা গুছিয়েছেন আর চুল বেঁধে তৈরি হয়েছেন নার্গিস। যাওয়ার সময়ে বাবার হাত জাপ্টে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন ‘ডেস্টিটিউট ওয়ার্ড’ এর বাকি রোগীরা “কে জানে কবে আমরা এ ভাবে প্রিয়জন খুঁজে পাব!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy