হাতে চে গেভারার উল্কি। বুধবারটা অবিনাশের কাটল চর্মশিল্পী বাবার সঙ্গে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
রাত পোহাতেই বিরিয়ানি ছেড়ে ইলিশে ফিরলেন ওঁরা দু’জন।
এ বারের কলকাতা লিগে লাল-হলুদের দুই আবিষ্কার অবিনাশ রুইদাস আর প্রহ্লাদ রায়।
অবিনাশের বাড়িতে এ দিন সাতসকালে ইলিশ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মামা। আর প্রহ্লাদ ঠাকুরনগরের বাড়িতে আসছেনই শুনে বাজার থেকে ইলিশ কিনে নিয়ে আসেন তাঁর দাদা।
ইস্টবেঙ্গল লেফট হাফ অবিনাশ দুপুরে মোবাইল অন করার সঙ্গে সঙ্গে এক-এক করে এসেছে বজবজ অঞ্চলের সাতটা পুজো কমিটির দুর্গা ঠাকুর উদ্বোধনের আব্দার।
রাইট হাফ প্রহ্লাদের দাদার কাছেও বুধবার সকাল থেকে পড়েছিলেন স্থানীয় চার-পাঁচটা পুজো কমিটির কর্তারা।
লাল-হলুদের দুই বাঙালি নতুন মুখ পত্রপাঠ সেই সব প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন।
ভূ-ভারতের তাবড় ডিফেন্ডারদের বিরুদ্ধে খেলতে ভয় নেই অবিনাশ-প্রহ্লাদের। কিন্তু যত ভয় নিজেদের টিমেরই দাদাদের বিরুদ্ধে। বজবজের গঙ্গার ধারে এ দিন বিকেলে চা-এ চুমুক দিয়ে অবিনাশ বলছিলেন, “ভূ-ভারতে কাউকে ভয় পাই না। কেবল আমাদের টিমের দীপকদার (দীপক মণ্ডল) সামনে গেলেই মনে হয় একে টলানো মুশকিল।” বাড়ি থেকে ফোনে প্রহ্লাদও বললেন, “বিপক্ষে কে ডিফেন্ডার তা নিয়ে ভাবি না। কিন্তু আমাদের টিমের অর্ণবদা (অর্ণব মণ্ডল), রাজুদার (রাজু গায়কোয়াড়) বিরুদ্ধে খেলতে গেলেই ভাবতে হয়।”
কলকাতা লিগ শেষ। এর পরে আই লিগে লাল-হলুদ জার্সি পরে নামার সুযোগ পাবেন কি? তখন তো পুরো শক্তি এসে যাবে টিমে। কী আশ্চর্য! দু’জনের জোশেও কী অদ্ভুত মিল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অবিনাশ বলছেন, “আমাকে পারতেই হবে। বজবজ ফুটবল অ্যাকাডেমিতে সামনের এক মাস ঘাম ঝরিয়ে আই লিগের দলে ঢোকার জন্য তৈরি হব। আমার লক্ষ্য জাতীয় দলে খেলা।”
উত্তর চব্বিশ পরগনার প্রহ্লাদ বলে দিলেন, “কলকাতা আমায় চিনেছে। এ বার ভারতে নিজের নাম চেনাতে হবে খেলা দিয়ে। আর সেটার জায়গা আই লিগ। তার পর চাই জাতীয় দলের জার্সি।”
ময়দানে এই দুই বঙ্গসন্তান ফুটবলারের মেন্টরদের পরিশ্রমেও অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। চড়িয়াল বাজারের চর্মশিল্পী শ্যাম রুইদাস এ দিন ফুটবলার-পুত্রকে পাশে বসিয়ে কাজ করার ফাঁকে বলছিলেন, “জুতো সেলাই করে অবিনাশকে ফুটবলার করেছি। লটারি জিতে কুড়ি হাজার টাকায় কেনা আড়াই কাঠা জমিও বিক্রি করে দিয়েছিলাম ছেলেকে ভাল ফুটবলার বানাতে।”
প্রহ্লাদের দাদা রবি রায় আবার বললেন, “ভাই বড় দলে খেলবে এটাই বহু দিনের স্বপ্ন ছিল। ওকে ট্রায়ালে পাঠাতে সোনার আংটিও বেচে দিয়েছিলাম। প্রহ্লাদ সেটা ব্যর্থ হতে দেয়নি। তবে ওকে আরও অনেক দূর যেতে হবে।”
বাংলা ফুটবলের দুই সেরা ভবিষ্যতের মধ্যে মিল আর মিলের মধ্যে অমিল যেন শুধু একটা জায়গাতেই। দু’জনের মোটিভেশনের পদ্ধতিতে।
‘দিওয়ার’ ছবিতে যেমন অমিতাভ বচ্চন নিজের হাতের উপর ছোটবেলায় অমানবিক প্রতিবেশীদের লিখে দেওয়া ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’ কথাটা দেখলেই ফুঁসে উঠতেন, অরিজিৎ সিংহের গানের ভক্ত অবিনাশ অনেকটা সে ভাবেই চোয়াল শক্ত করে বলে দিলেন, “লোকেদের জুতো সারিয়ে বাবা বড় করেছেন আমাকে। অনেকেই ‘মুচির ছেলে’ বলত। মাঠে নামার আগে ড্রেসিংরুমে মনে -মনে ছোটবেলার সেই ছবিগুলোই দেখি। মনে মনে দেখি অস্কার পিস্টোরিয়াসের দৌড়ও। তাতেই মাঠে নেমে জান লড়িয়ে দেওয়া শক্তি পেয়ে যাই।”
প্রহ্লাদ তখন শশী কপূরের ‘মেরে পাস মা হ্যায়’-এর ঢঙে বললেন, “সব ম্যাচেই মাঠে ঢোকার আগে মায়ের সঙ্গে কথা বলি। মা-দাদার আশীর্বাদ পেলেই ভাল খেলার শক্তি পেয়ে যাই।”
আরও আছে। ডার্বিতে গোল করে অবিনাশ যখন বড় টিমে খেলা পাড়াতুতো দাদা চন্দন দাসের মতো হামাগুড়ি দিয়ে মাঠে সেলিব্রেট করার স্বপ্ন দেখেন, তখন প্রহ্লাদ ডার্বিতে গোল করে রোনাল্ডিনহোর মতো দু’হাত মেলে দৌড়তে চান।
আর রোম্যান্সে? প্রশ্নটা শুনেই গোধূলি লগ্নে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে লজ্জায় রাঙা বজবজের যুবক অবিনাশ। আর প্রহ্লাদ সেই ‘গুড বয়’ ইমেজ নিয়েই বললেন, “ও সব ভাবি না। আমার কোনও বান্ধবী নেই। ফুটবলই আমার সঙ্গী।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy