সায়েন্টিস্টস ড্রিম অ্যাবায়ুট ডুয়িং গ্রেট থিংস। ইঞ্জিনিয়ারস ডু দেম”— উক্তিটি মার্কিন লেখক জেমস এ মিশেনার-এর। বহু দিন ধরে ছাত্রছাত্রী তথা অভিভাবকদের কাছে সফল কেরিয়ারের সংজ্ঞায় প্রথম সারিতে থেকেছে ইঞ্জিনিয়ারিং। যার ফলে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অনেক ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন থাকে সফল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্থান পাওয়ার আশায়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনা ও চাকরিবাকরির চিত্রটা ঠিক কেমন, এক বার দেখা যাক।
মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতবর্ষে ৬২১৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি কলেজ রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১৫ লক্ষ ছাত্রছাত্রী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে। কিন্তু এর মাত্র ২০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই তাদের পাঠ্য বিষয়ে চাকরি পেতে সক্ষম হয়। আর বাকি ৮০ শতাংশ? এই বিরাট অংশের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা জরুরি। এই সমস্যাটিকে তিনটি প্রশ্নে সাজিয়ে তার উত্তর জানার চেষ্টা করা যাক।
গত বছর আমাদের দেশের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং আসন খালি পড়ে ছিল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ৩২ হাজারেও বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং আসন আছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে প্রায় অর্ধেক আসন খালি ছিল। আর ২০১৯-এ সেই সংখ্যা আরও বাড়ে। এত আসন খালি পড়ে থাকছে কেন? তার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ হল: অনেক বেসরকারি কলেজে সিভিল, মেক্যানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো ‘কোর ডিসিপ্লিন’-এ ঠিকঠাক পরীক্ষাগারের অভাব রয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান ঠিকমতো হয় না।
দুই, ভর্তির সময় ছাত্রছাত্রীদের কার কোন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রবণতা রয়েছে, তার ঠিকমতো যাচাই হয় না। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা এবং আগামী দিনে যে ছাত্র বা ছাত্রীটি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোচ্ছে— দু’ক্ষেত্রেই মানের অবনতি অবশ্যম্ভাবী।
তিন, অভিভাবকদের অনেকেরই দাবি, বেসরকারি কলেজগুলিতে পড়ানোর জন্য তাঁদের যতটা খরচ করতে হয়, সেই তুলনায় যে চাকরিগুলি ছাত্রেরা পাচ্ছে, তার বেতন অনেকটাই কম।
চার, ইঞ্জিনিয়ারিং সফল কেরিয়ার হওয়ার ফলে এক সময় বাজার ধরতে প্রচুর টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এতগুলি কলেজের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
এ বার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে— স্নাতক স্তরের পর কী রকম চাকরি পাওয়া যাচ্ছে বা কোন বিষয়ে চাকরির সুযোগ কেমন?
ছবি ১ দেখলে বোঝা যাবে ২০১৯ সালে দেশের সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মিলিয়ে কোন বিষয়ে কত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে।
যারা দেশের প্রথম সারির কলেজগুলিতে পড়ছে, তাদের চাকরি পাওয়ার চিন্তা নেই বললেই চলে। দ্বিতীয় সারির কলেজগুলিতেও অনেক ছাত্রছাত্রী কলেজ থেকেই চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বহু বেসরকারি কলেজ থেকে পাশ করা ছেলেমেয়ে চাকরি পাচ্ছে না। এখানে উল্লেখ করব, দেশে দু’হাজারেরও বেশি বেসরকারি কলেজ আছে, যার মধ্যে মাত্র কুড়িটি কলেজ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট র্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক (এনআইআরএফ) র্যাঙ্কিং-এ স্থান পেয়েছে। একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্লেসমেন্ট বিভাগের প্রধান বললেন, “কম্পিউটার সায়েন্স, সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, অটোমেশন-এর মতো বিষয়গুলিতে চাকরির সুযোগ অনেক ভাল। আজকাল শিল্পসংস্থাগুলি শুধুমাত্র কলেজের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে সুযোগ্য ছাত্র নির্বাচন করে না। তারা মূলত কোডিং সংক্রান্ত এক বা একাধিক ধাপের প্রতিযোগিতা (হ্যাকাথন) বা পরীক্ষার আয়োজন করে। এখন চাকরির নির্বাচন এই ধরনের প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষার ফলাফলের উপর হয়ে থাকে। তা ছাড়া, কোর্স পড়ার সময় বা পরে ইন্টার্নশিপ বা প্রজেক্ট কী করা হয়েছে তার উপরেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই কোম্পানিগুলির বেতন সব থেকে বেশি। কোর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অনেকটাই কম। তবে দেখা যাচ্ছে কেমিক্যাল বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চাকরির প্রথম দিকের বেতন কম থাকলেও দু-তিন বছরের মধ্যে বেতনের অনেকটা উন্নতি হচ্ছে।
যেটা উল্লেখযোগ্য, তা হল বেসরকারি কলেজগুলি থেকে প্রচুর সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ‘সার্ভিস’ বা ‘সেলস’-এর কাজে নিযুক্ত হচ্ছে। ধরা যাক, কোনও সংস্থা এডুকেশনাল সফটওয়্যার-এর ব্যবসা করে। তারা এই সব কলেজের ছেলেমেয়েদের সেলস আর তার স্ট্যাটিসটিক্যাল স্টাডি-র কাজে নিয়োগ করতে চায়। যে কোম্পানিগুলি কোর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজ করে তাদেরও ক্রমশ ‘কম্পিটিশন বেসড হায়ারিং’-এর প্রবণতা বাড়ছে। অনেক কলেজে নিয়মিত ভাবে এই রকম ‘আইডিয়াথন প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে। এখানে কোডিং প্রতিযোগিতার বদলে সংস্থা হয়তো বিভিন্ন শাখার এক দল ছাত্রকে একটি প্রজেক্ট দিয়ে সেটার সলিউশন এক দিনের মধ্যে বার করতে বলল। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, ছাত্রছাত্রীদের বিজ়নেস প্ল্যানিং, প্র্যাকটিক্যাল নলেজ শেয়ারিং, কমিউনিকেশন স্কিলস, নেটওয়ার্কিং-এর জ্ঞান যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে সংস্থাগুলি।” তিনি আরও জানালেন, কাজের সুযোগ বাড়ছে জৈবপ্রযুক্তি, ই-কমার্স-এর মতো ক্ষেত্রেও।
নামকরা একটি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিতে কর্মরত, আইআইটি খড়্গপুরের এক প্রাক্তনী জানাচ্ছেন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, অলটারনেটিভ এনার্জি অ্যান্ড এডুকেশন-এর মতো বিষয়গুলির গুরুত্বও ক্রমশ বাড়ছে।
এ বার তৃতীয় প্রশ্নে আসা যাক। কী পরিবর্তন আনলে বেকারত্বের সংখ্যা কমবে? একটা কথা মনে রাখতে হবে, যদিও কোর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরি এখন অনেকটাই কম, কিন্তু এই বিষয়গুলির প্রয়োজনীয়তা সব সময়েই থাকবে। আর একটি ধ্রুব-সত্য এই যে, কেউ যদি ঠিকমতো পড়াশোনা করে থাকে এবং তার কনসেপ্ট পরিষ্কার থাকে, কর্মক্ষেত্রে সে ঠিকই অপরিহার্য হয়ে ওঠে। একটি বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ার জানালেন, কলেজে চাকরির ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে যে ঘাটতি সব থেকে বেশি নজরে পড়ে তা হল, ছাত্রছাত্রীদের পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেও, প্রযুক্তিগত ব্যবহারিক জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। তাঁর মতে, কলেজ ও শিল্পক্ষেত্রকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে কলেজ থেকে বেরনোর পরে এক জন ইঞ্জিনিয়ার শিল্পক্ষেত্রে কাজ করার জন্য তৈরি হয়ে (ইন্ডাস্ট্রি রেডি) বেরোতে পারে। তাই শিক্ষা পদ্ধতিতে এমন পরিবর্তন আনতে হবে যাতে দেশের ইঞ্জিনিয়াররা বিশ্বের যে কোনও শিল্প-সংস্থাতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে পারে। তখন বেকারত্বের সংখ্যা কমে যেতে বাধ্য।
কলেজে পড়াকালীন আমাদের এক অধ্যাপক বলতেন, “ইঞ্জিনিয়ারিং হল ৯০ শতাংশ সাধারণ বুদ্ধি আর ১০ শতাংশ পুঁথগত বিদ্যা।” তাই নিজের মধ্যে এই সাধারণ বোধকে সজাগ রাখতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা সফল তখনই হয়, যখন কোনও ভাবনাকে কার্যকর করা যায়। সময়ের সঙ্গে নিজেকে প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াকিবহাল রাখতে হবে। স্টিভ জবস বলেছিলেন, “ওল্ডার পিপল সিট ডাউন অ্যান্ড আস্ক, “হোয়াট ইজ় ইট?” বাট দ্য বয় আসকস, “হোয়াট ক্যান আই ডু ইউথ ইট?” কৌতূহলী মনের নতুন কিছু জানার ও শেখার কোনও সময় সীমা নেই। পুঁথিগত বিদ্যার উপর নির্ভরশীল না হয়ে পাঠ্য বিষয়টির উপর ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করলেই ভবিষ্যতে এক জন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়।
ম্যানেজার, জেকবস-সিইএস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy