নেহা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্র: আইআইটি খড়্গপুর থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বহুজাতিক সংস্থায় ভাল চাকরি করছিলেন। তা হলে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?
উ: চাকরি করার কিছু দিন পরেই মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা ভীষণ একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তেমন কোনও বৈচিত্র নেই। চাকরির প্রথম দিকেই এমন ভাবনা মনে এলে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে। সেটা করতে গিয়েই সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
এই সময় পুরনো আইএএস আধিকারিকদের নিয়ে দু’একটা বই পড়ি, ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখি। সেখান থেকেই মনে হয়েছিল, এক জন আইএএস আধিকারিকের চাকরির একটা বিশেষ সামাজিক মূল্য এবং বৈচিত্র আছে, যেটা অন্য অনেক চাকরিতেই নেই।
প্র: কী ভাবে ইউপিএসসি-র পড়া আর চাকরি, দুটো একসঙ্গে সামলাতেন?
উ: ২০১৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষা নিয়ে জোরদার ভাবনা শুরু করি। পুরোপুরি মনস্থির করতে দু’তিন মাস সময় লেগেছিল। মে মাসে আমার কলেজ শেষ হয়। আর চাকরিতে যোগ দিই জুলাই মাসে। ওই দু’মাস বাড়িতে থাকার সময় একটা পরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম যে পরের বছর পরীক্ষা দেওয়ার আগে পর্যন্ত নিজেকে কী ভাবে তৈরি করব। এই সময়ে পরীক্ষার বেসিক পড়াশোনার অনেকটাই করে রেখেছিলাম।
• চাকরি করতাম বলে আমি প্রতি দিন সমান সময় পেতাম না। কিন্তু যতটা সময় পড়তাম, পুরোটা ব্যবহার করতাম।
• ইন্টারনেটে যে মেটিরিয়াল পাওয়া যায়, তার মধ্যে কোনটা তোমার কাজে লাগতে পারে সেই বিষয়ে অনেক সময় কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা সাহায্য করতে পারেন। আমি যদিও পুরো প্রস্তুতিটাই নিয়েছিলাম কোনও কোচিং সেন্টারের সাহায্য ছাড়াই।
• নিজের মতামত ব্যক্ত করতেই ডায়রিতে কোনও বিষয় নিয়ে একটা ছোট লেখা লিখে ফেলতাম। সেটাই মেনস-এ উত্তর লেখায় সাহায্য করেছিল। আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে কোনও বিষয় জানা থাকলে সেটা ঠিকই গুছিয়ে লিখতে পারব।
• প্রিলিমসে স্মার্ট গেসিং-এর প্রয়োজন। কিন্তু ভুল গেস করা চলবে না, যে হেতু এখানে নেগেটিভ মার্কিং রয়েছে। এই দক্ষতা গড়ে তোলার কোনও বাঁধাধরা ফর্মুলা নেই।
চাকরি সূত্রে আমাকে কলকাতা থেকে দিল্লি চলে যেতে হয়। নতুন জীবন, সবে চাকরিতে ঢুকেছি— প্রথম প্রথম টাইম ম্যানেজমেন্টে অসুবিধে হত। কিন্তু তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিয়েছিলাম। সাধারণ দিনে অফিস যেতাম সকাল ১০-১১টায়। তার আগে দু’-তিন ঘণ্টা পড়াশোনা করতাম। অফিসে লাঞ্চের সময়েও বেশ কিছু ক্ষণ পড়তাম। ওই সময় অনলাইন কোনও বিষয় লেকচার শুনতাম। আমার অফিস ছিল নয়ডাতে। দিল্লিতে থেকে শাটল-এ অফিস যাওয়ার পথেও অনলাইনে নিউজ় দেখা, ব্লগ পড়া বা কোনও রিভিশন করে নিতাম। সপ্তাহের সব দিন সমান ভাবে পড়াশোনার সুযোগ পেতাম না। তবে শনি-রবিবারটা যতটা সম্ভব ব্যবহার করতাম।
প্র: সাধারণ ধারণা হল, সিভিল সার্ভিসেস পেতে গেলে সব কিছু ভুলে ১৭-১৮ ঘণ্টা পড়তে হয়। কোনও অবসর বিনোদন নয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং নয়। আপনি কি তা করেছিলেন?
উ: কোনও দিনই ১৭-১৮ ঘণ্টা পড়তে পারিনি। কিন্তু যতটা সময় পড়তাম, পুরোটা ব্যবহার করতাম। নিজের জন্য যেটা সবচেয়ে উপকারী, সেটাই করা উচিত। অনেকেই শুনেছি মন বিচলিত হওয়ার ভয়ে পরীক্ষার আগে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করা বন্ধ করে দেয়। যে হেতু আমাকে অধিকাংশ সময়েই অনলাইন পড়াশোনা করতে হত, তাই চোখের উপরে বেশি চাপ দেব না বলেই ওই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোয় অ্যাক্টিভ থাকতাম না।
প্র: প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য কী ভাবে তৈরি হয়েছিলেন? আর মেনস পরীক্ষার জন্যেও স্ট্র্যাটেজি কী ছিল?
উ: ২০১৮ সালের মে-জুন মাস থেকে একই সঙ্গে প্রিলিমিনারি এবং মেনস-এর জন্য পড়াশোনা শুরু করি। এটা চালিয়ে গিয়েছিলাম পরের বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গত বছর প্রিলিমস পরীক্ষা হয় জুন মাসে। তাই শুধু প্রিলিমস-এর জন্য পড়েছিলাম মার্চ থেকে। এখানে থাকে এমসিকিউ প্রশ্ন। চারটে অপশন দেওয়া হয়। অনেক সময়েই উত্তরগুলো এত কাছাকাছি থাকে যে বোঝা যায় না কোনটা ঠিক। সে জন্য স্মার্ট গেসিং-এর প্রয়োজন। কিন্তু ভুল গেস করা চলবে না, যে হেতু এখানে নেগেটিভ মার্কিং রয়েছে। এই দক্ষতা গড়ে তোলার কোনও বাঁধাধরা ফর্মুলা নেই। পড়াশোনা, নানা ধরনের প্রশ্ন প্র্যাকটিসের পাশাপাশি চোখ-কানও খোলা রাখতে হয়, যে হেতু পরীক্ষাটা সমাজবহির্ভূত কোনও ব্যাপার নয়। প্রিলিমস-এ একটা প্রশ্ন এসেছিল: “এলটিই কোন মোবাইল প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত?” এক বার একটি মোবাইল স্টোরে গিয়েছিলাম কানেকশন নেওয়ার জন্য। সেখানে এক জায়গায় লেখা ছিল ‘৪জি এলটিই’। ব্যাপারটা মনে রেখেই উত্তর দিয়েছিলাম ‘৪জি’। উত্তরটা ঠিক হয়েছিল।
গুগল-এ ‘প্র্যাকটিস কোয়েশ্চেনস ফর আইএএস প্রিলিমিনারি’ বলে সার্চ করলেই এক গুচ্ছ সাইট পাওয়া যাবে। সেখান থেকে নিজের সুবিধেমতো প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করে সময় ধরে প্রশ্ন প্র্যাকটিস করতে হবে। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর জন্য সারা বছর কিছু বাছাই করা সংবাদপত্র (দ্য হিন্দু, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ইত্যাদি) পড়া উচিত। বিশেষত সম্পাদকীয় অংশগুলি। সংবাদপত্র পড়লে তা পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্ট-এ সাহায্য করে বলেই আমার অভিমত।
আর যখন যা পড়ছ, সেটা থেকে নিজের নোট তৈরি করে রাখলে ভাল হয়। এখন ইন্টারনেটেও বেশ কিছু সাইট আছে, যেখান থেকে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর পিডিএফ-ও ডাউনলোড করা যায়।
পরীক্ষার প্রস্তুতির শুরু থেকেই বিভিন্ন বিষয়ের জন্য এনসিইআরটি-সহ যে বইগুলি রেফার করতাম (যেমন ‘হিস্ট্রি’র জন্য ‘স্পেকট্রাম’, ‘পলিটি’র জন্য ‘লক্ষ্মীকান্ত’ ইত্যাদি), সেখান থেকে নিজের মতো নোট তৈরি করে নিয়েছিলাম। এ ছাড়া অনলাইন থেকে নিজের ল্যাপটপে বিষয় অনুযায়ী ফোল্ডার বানিয়ে অনেক তথ্য বা পিডিএফ রেখে দিতাম। সময়ে সময়ে রিভাইজ় করতাম সেগুলি।
মেনস-এ বড় উত্তর লিখতে হয়। অনেকে প্রথম থেকেই উত্তর লেখা শুরু করে। প্রস্তুতির প্রথম দিকে কোনও বিষয়ই গভীর ভাবে জানা থাকে না। বিষয়টা পুরোপুরি না জেনে লেখার অভ্যেস করা আমার কাছে একেবারেই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। বরং আমি লেখা প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম প্রিলিমস হয়ে যাওয়ার পরে। কিছু বিষয় প্রিলিমস-এ থাকে না। যেমন ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি, এথিক্স। এগুলি প্রিলিমস-র পরে পরেই পড়ে ফেলি। এখানেও আগের বছরের প্রশ্নপত্র থেকে লেখা প্র্যাকটিস করা উচিত। মেনস-এর পেপারগুলোয় ২০টি করে প্রশ্ন থাকে। তিন ঘণ্টার মধ্যে লিখতে হয়। প্রতিটা প্রশ্নের জন্য মোটামুটি ৮-৯ মিনিট সময় থাকে হাতে। তা-ও নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে। কোনও প্রশ্নই সহজ-সরল, স্কুল বা কলেজের পরীক্ষার মতো থাকে না। ফলে, উত্তর ভাবা এবং খাতায় লেখা সমান্তরাল ভাবে চালাতে হয় খুব তাড়াতাড়ি। গোটা প্রক্রিয়াটা কিন্তু শরীরের উপরে চাপ তৈরি করে। তাই এই অভ্যাস আগে থেকে করা উচিত। মেনস-এ নিজের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ থাকে। সেখানে লেখার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রেফারেন্স (হতেই পারে দৈনন্দিন জীবনে দেখা কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা) বা নামী ব্যক্তিদের উক্তি ব্যবহার করো, যেটা তোমার লেখাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারে। মেনস-এর ক্ষেত্রে মূল পরিকল্পনাই হওয়া উচিত এত দিন যা পড়েছ, সেটা রিভিশন করা।
প্র: এখন ইন্টারনেটে ইউপিএসসি-র প্রচুর মেটিরিয়াল পাওয়া যায়। ফলে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে থেকে কী ভাবে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেছে নিতে হবে?
উ: এত মেটিরিয়াল দেখে অনেক সময় ঠিকটা বাছতে সমস্যা হয়, কিছুটা সময়ও নষ্ট হয়। আমারও হয়েছিল। তাই এখানে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। তবে মূল লক্ষ্যটা হওয়া উচিত, যে ভাবে সময় ধরে পড়াশোনা করার পরিকল্পনা করেছ, সেটা থেকে সরে না যাওয়া। আমি যেমন কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর জন্য সংবাদপত্র ছাড়া আর একটা ওয়েবসাইট থেকে পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়তাম। মাঝেমধ্যে অন্যান্য সাইটও দেখতাম। কিন্তু সেগুলোকে সে ভাবে গুরুত্ব দিইনি। অনেক সময় কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। আমি যদিও পুরো প্রস্তুতিটাই নিয়েছিলাম কোনও কোচিং সেন্টারের সাহায্য ছাড়াই।
প্র: সুযোগ পেলেই আপনি নাকি ডায়রি লিখতেন। সেটা এই পরীক্ষার জন্য কী ভাবে সাহায্য করেছিল?
উ: ইউপিএসসি-র প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এমন অনেক বিষয় পড়তে হয়েছে, যেগুলো পড়ে মনে হয়েছিল, কারও সঙ্গে আলোচনা করলে ভাল হয়। এ দিকে সব বন্ধুবান্ধব তখন বিদেশে। তাই নিজের মতামত ব্যক্ত করতেই ডায়রিতে কোনও বিষয় নিয়ে একটা ছোট লেখা লিখে ফেলতাম। সেটাই মেনস-এ উত্তর লেখায় সাহায্য করেছিল। তা ছাড়া, আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে কোনও বিষয় জানা থাকলে পরীক্ষার সময় সেটা ঠিকই গুছিয়ে লিখতে পারব।
প্র: আপনি অপশনাল নিয়েছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। নিজের বিষয়। কিন্তু অনেকে বলেন সোশিয়োলজি বা অ্যানথ্রপোলজির মতো কিছু স্কোরিং সাবজেক্ট নেওয়া উচিত। আপনার কী মত?
উ: অন্য বিষয় নিইনি দু’টো কারণে। প্রথমত, যদি কোনও নতুন বিষয় বাছাই করি, তা হলে সেটা আমাকে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। তাই মনে হয়েছিল নিজের চেনা বিষয়, যেটা চার বছর ধরে পড়েছি, সেটা বাছাই করাই এ ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয়। দ্বিতীয়ত, ইউপিএসসি এমন একটা পরীক্ষা যেখানে পড়লেও তুমি পাবে কি না, সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। সে ক্ষেত্রে নিজের একটা ব্যাক আপ প্ল্যান রাখতে হবে। ঠিক করেছিলাম এ বছর না পেলে, আর এক বছর চেষ্টা করব। তখনও না হলে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে গবেষণা করতে চলে যাব।
নেহা ২০১৯ সালের
পরীক্ষার্থী, র্যাঙ্ক ২০
সাক্ষাৎকার: সৌরজিৎ দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy