বিষয় হিসেবে রসায়ন আপনার মতে কেমন?
রসায়ন বা কেমিস্ট্রি পড়া একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। কেননা এর সিলেবাস বড়। এ ছাড়া জৈব, অজৈব, ভৌত প্রত্যেকটার অ্যাপ্রোচ আলাদা। প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলো নানা রকমের। কারও কাছে রসায়ন বিষয়টা আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে কি না, তা বুঝতে হলে একটা পাঠ্যবই নিজে নিজে পড়তে হবে। এক বার নয়, একাধিক বার। দেখো, যেটা পড়ছ, ভাল লাগছে কি না, পড়তে পড়তে মনে উৎসাহ আসছে কি না। ছেলেমেয়েরা দ্বাদশ শ্রেণি স্তরে রসায়ন নিয়ে যা পড়ে, তা খানিকটা হলেও সুবিধে দেয় অনার্স স্তরের পড়াশোনায়। অনার্স স্তরে কেমিস্ট্রি থাকলে পাস-এ ফিজিক্স এবং অঙ্ক নিতেই হয়। কিছু জায়গায় বায়োলজির কিছু কিছু বিষয় নেওয়া যায়। তবে সে ক্ষেত্রে মুশকিল হয় কোনও ভাল প্রতিষ্ঠানে দু’বছরের এম এসসি প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার সময়। এই সব পরীক্ষায় গণিত আর পদার্থবিদ্যার ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলে চলে না।
স্নাতক স্তরে রসায়ন কোথায় পড়া যায়? অন্য রকম কোর্স পড়ারও কি সুযোগ আছে?
রাজ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত বিভিন্ন কলেজেই কেমিস্ট্রি অনার্স পড়ানো হয়। এ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের সেন্ট্রাল ও স্টেট ইউনিভার্সিটিগুলিতেও কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে।
সাধারণ বি এসসি কোর্সের বাইরে এখন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে রসায়ন নিয়ে একটু ভিন্ন ধরনের কোর্স পড়ানো হয়। যেমন,
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এ (আইআইএসইআর পুণে, কলকাতা, ভোপাল, মোহালি, তিরুঅনন্তপুরম, ব্রহ্মপুর ও তিরুপতি) কেমিস্ট্রিতে পাঁচ বছরের বি এস-এম এস ডুয়াল ডিগ্রি প্রোগ্রাম রয়েছে। আইআইটি-তেও এমন পাঁচ বছরের ইন্টিগ্রেটেড এম এসসি কোর্স আছে। আইআইএসসি বেঙ্গালুরুতে ‘ব্যাচেলর অব সায়েন্স প্রোগ্রাম’-এ বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়া যায়। কোর্সটি চার বছরের। www.iisc.ernet.in
বেশির ভাগ আইআইটি (কানপুর www.iitk.ac.in; বম্বে www.chem.iitb.ac.in; খড়্গপুর www.iitkgp.ac.in; দিল্লি www.iitd.ac.i• ইত্যাদি) কেমিস্ট্রিতে ব্যাচেলর অব সায়েন্স প্রোগ্রাম আছে। আইআইটি গুয়াহাটিতে (www.iitg.ac.in) যেমন রয়েছে কেমিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে চার বছরের বি টেক কোর্স। এ ছাড়াও অনেক আইআইটিতেই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি টেক-ও পড়া যায় দ্বাদশ শ্রেণির পর।
কেমিক্যাল সায়েন্সেস-এ পাঁচ বছরের ইন্টিগ্রেটেড এম এসসি প্রোগ্রাম রয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, ভুবনেশ্বর (নাইসার, www.niser.ac.in) এবং ইউনিভার্সিটি অব মুম্বই ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টার ফর এক্সেলেন্স ইন বেসিক সায়েন্সেস (ইউএম-ডিএই সিবিএস)-এ (www.cbs.ac.in)। ভর্তি হতে সর্বভারতীয় ন্যাশনাল এন্ট্রান্স স্ক্রিনিং টেস্ট (নেস্ট) দিতে হয়।
রসায়ন নিয়ে রাজ্য তথা দেশে কী ধরনের উচ্চশিক্ষা করা যেতে পারে?
রাজ্য এবং দেশের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে বি এসসি-র পর এম এসসি এবং পিএইচ ডি করার সুযোগ থাকেই। আইআইটিগুলোতেও বি এসসি-র পর দু’বছরের এম এসসি করতে ‘জ্যাম’ পরীক্ষা দিতে হয়। আইআইএসসি বেঙ্গালুরু এবং সব ক’টি আইআইএসইআর ও আইআইটি-তে কেমিস্ট্রিতে পিএইচ ডি করা যায়। আইআইএসসি বেঙ্গালুরু এবং আইআইএসইআরগুলোয় পিএইচ ডি-র পাশাপাশি এই বিষয়ে ইন্টিগ্রেটেড পিএইচ ডি-রও (এম এসসি-পিএইচ ডি ডুয়াল ডিগ্রি) কোর্স আছে। চাইলে এনআইটিগুলো থেকেও পিএইচ ডি করতে পারো। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (www.iiests.ac.in) থেকেও এম এসসি ও পিএইচ ডি করা যায়। আইআইটি ধানবাদ-এ (www.iitism.ac.in) কেমিস্ট্রিতে এম এসসি, অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রিতে এম ফিল করতে পারে ছাত্রছাত্রীরা। এখানে পিএইচ ডি-রও সুযোগ আছে। কেমিস্ট্রিতে পিএইচ ডি করা যায় রাজীব গাঁধী ইনস্টিটিউট অব পেট্রোলিয়াম টেকনোলজি-তেও (www.rgipt.ac.in)।
কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের অধীনেও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে এই বিষয় নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা বা গবেষণা করা যায়। যেমন, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (www.iacs.res.in), এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস (www.bose.res.in/b125), বোস ইনস্টিটিউট (www.jcbose.ac.in/home), জওহরলাল নেহরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চ (www.jncasr.ac.in), টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (www.tifr.res.in), সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (www.saha.ac.in/web) ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি (www.iicb.res.in) ইত্যাদি। পিএইচ ডি-র ফেলোশিপ পেতে নেট-উত্তীর্ণ হতে হয় বা গেট-এ ভাল ফল করতে হয়। স্টেট ইউনিভার্সিটিগুলোয় পিএইচ ডি করতে ‘সেট’ পাশ করতে হবে।
স্কুল ও কলেজের পড়াশোনার মধ্যে বিস্তর ফারাক। কেউ হয়তো দ্বাদশ শ্রেণিতে রসায়নে ভাল নম্বর পেল। কিন্তু অনার্সের ক্লাস করতে গিয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়ল। তখন সে কি বিষয়টা নিয়েই এগোবে নাকি অন্য বিষয় পড়ার কথা ভাববে?
দ্বাদশ শ্রেণিতে রসায়নে ভাল নম্বর পেয়ে কেউ হয়তো ঠিক করল, রসায়ন নিয়ে অনার্স পড়বে। কারণ বিষয়টা তার দারুণ লাগে। কিন্তু কিছু দিন অনার্স ক্লাস করার পরে সে সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। এমন পরিস্থিতি অনেকেরই হয়। সাধারণত যারা রাজ্য বোর্ড থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করে, তাদের মধ্যে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কারণ মূলত দুটো—
• দ্বাদশ শ্রেণির সব কিছু বাংলায় পড়ানো হয়েছে, কিন্তু অনার্স-এ সব কিছু ইংরেজিতে পড়ানো হয়। ফলে ছাত্রছাত্রীরা অসুবিধায় পড়ে। তাই দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই পরিভাষা জানার উপরে জোর দিতে হয়। বেশি অসুবিধে হলে, অনার্স-এর জন্য ইংরেজিতে লেখা বই পড়ার পাশাপাশি পাস কোর্সের জন্য বাংলায় লেখা বই পড়লেও সুবিধে হতে পারে।
• এটা সত্যি, কলেজের সিলেবাস স্কুলের তুলনায় বড়। এই বিরাট সিলেবাসকে আয়ত্তে আনতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন প্রতিটি উপ-বিষয় বা সাব-ডিসিপ্লিনের জন্য একাধিক বই না পড়ে যে কোনও একটি বই পড়া। ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই অনুযোগ করে যে বিদেশি লেখকদের বই তাদের কাছে সহজপাঠ্য নয়। এই জন্য আমাদের এখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের অনেক শিক্ষক বেশ কিছু বই লিখেছেন, যেগুলি বিদেশি লেখকদের বইয়ের তুলনায় অনেক সহজ ভাবে লেখা। যেমন, অনার্সের জন্য বেশ কিছু নতুন বইয়ের কথা বলা যেতে পারে—
• ড. হৃষীকেশ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি / ড. আশিস নাগ-এর লেখা ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি
• ড. রমাপ্রসাদ পি সরকারের জেনারেল এবং ইনঅরগ্যানিক কেমিস্ট্রি
• ড. চন্দন সাহা-র অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি
ধরা যাক, কোনও পড়ুয়ার ক্লাস শুরু হওয়ার পর মনে হল, সে অনার্স পড়ার উপযুক্ত নয়। সে ক্ষেত্রে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বশাসিত কলেজে মাঝপথে বিষয় পরিবর্তন করার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার পরের সিমেস্টারে নতুন করে বিষয় পরিবর্তন করার সুযোগ মিলতে পারে। সাধারণত এক বার কোনও বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করার পরে সমস্যা দেখা দিলে অনেক ছাত্রছাত্রী বছর নষ্ট হবে ভেবে বা অভিভাবকদের উপরে চাপ পড়বে ভেবে, বাবা-মায়ের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করে না। এই সমস্যায় যাতে পড়তে না হয়, তার জন্য অনার্স পড়ার আগে প্রথমেই উচিত সিলেবাসের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া। দেখে নেওয়া, বিষয়টি পড়ার জন্য সে স্বতঃপ্রণোদিত কি না। আর অভিভাবকদের উচিত ছেলেমেয়েদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের উপরে কিছু চাপিয়ে না দেওয়া।
প্রত্যেকটা বিষয়ের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। সেই বিষয়টা অনুধাবন করে কোনও পড়ুয়া কী ভাবে বিষয়টি নিয়ে এগোবে?
বেসিক সায়েন্সের বিষয়গুলির মধ্যে রসায়নের পরিধি কম নয়। যেমন, ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে ভাল করতে হলে ফিজিক্স বা অঙ্কের বেসিক কনসেপ্টগুলো ভাল করে জানতেই হবে। ঠিক তেমনই বায়োকেমিস্ট্রি পড়তে হলে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির জ্ঞান জরুরি। এই জন্য প্রথম থেকেই প্রতিটি উপবিষয়ে সময় দিতে হবে। অনেকের মধ্যে একটা প্রবণতা থাকে— তারা টেক্সট বইগুলো ভাল ভাবে পড়ে, কিন্তু তাতে দেওয়া বিভিন্ন প্রবলেম (যেমন, ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির অঙ্ক, অরগ্যানিক কেমিস্ট্রির কেমিক্যাল ট্রান্সফরমেশন) সলভ করে না। যত বেশি প্রবলেম সলভ করবে, তত কনসেপ্ট পরিষ্কার হবে এবং বিষয়ের প্রতি ভালবাসাও তত বাড়বে।
চাকরির বাজারে রসায়নের ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা কেমন?
বছর কয়েক আগেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরি পাওয়ার যে সুযোগ ছিল, তা অনেকাংশে কমেছে। সেই জায়গায় কেমিস্ট্রির গ্র্যাজুয়েটদের কাজের সুযোগ বরং বেড়েছে। এর প্রধান কারণ দুটো: অধিকাংশ স্কুল কলেজে অনেক শূন্য পদ পড়ে আছে। দুই, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বা ‘স্টার্টআপ ইন্ডিয়া’-র প্রেরণায় ইদানীং ইন্ডাস্ট্রি এবং বেসিক সায়েন্সের মেলবন্ধনের যুগে অনেক ছোট-বড় স্টার্টআপ সংস্থার জন্য নতুন করে কাজের সুযোগ গড়ে উঠছে। রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির নতুন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে এ দেশে কী ভাবে নতুন স্টার্টআপ সংস্থাগুলি অগ্রসর হয়েছে। এই সব সংস্থায় সিনিয়র সায়েন্টিস্ট থেকে শুরু করে অ্যানালিস্ট, ল্যাব টেকনিশিয়ান ইত্যাদি পদে চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আজকাল বাজারে অনেক নতুন কেমিক্যাল ডিসট্রিবিউটর সংস্থা এসে গিয়েছে, মূলত নতুন আইআইএসইআর এবং আইআইটি বা এনআইটি-র মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, এবং নতুন সব স্টার্টআপ খুলে যাওয়ার কারণে। এর জন্য চোখ রাখতে হবে চাকরির বিজ্ঞাপনের উপরে। আজকের ওয়েব দুনিয়ার যুগে বেশ কিছু চাকরি পাওয়ার ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেখে রিজিউমে পাঠিয়েও অনেকেই মনের মতো চাকরির হদিশ পেয়ে যায়।
অধ্যাপক দে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, মোহালি-র রসায়ন বিভাগের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy