এক লহমায় সে দিন ‘খেলা’ ঘুরে যায় আজহারউদ্দিনের কব্জির মোচড়ে। — নিজস্ব চিত্র।
৪৭ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস আতঙ্ক! এমন দৃশ্য রাজ্য কখনও দেখেনি। একঘর ছাত্রছাত্রীর সামনে পিস্তল উঁচিয়ে, পড়ানোর টেবিলে দু’খানা বোতলবোমা রেখে, চিৎকার করে চলেছে ক্লাসরুমে আচমকা ঢুকে পড়া মধ্যবয়সি। স্কুল জুড়ে আতঙ্ক। অভিভাবকেরা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না! লাইভ খবরের দৌলতে সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল রাজ্য জুড়ে। এ বার কী হবে? কী চায় লোকটা? গুলি চালিয়ে দেবে না তো? নবান্ন টানটান। থানা থেকে এসপি অফিস— চাঞ্চল্য, ছুটোছুটি। আচমকাই আতঙ্কের যবনিকা পতন। এক লহমায় ‘খেলা’ ঘুরে গেল আজহারউদ্দিনের কব্জির মোচড়ে।
সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকারের মতো, ছিলা থেকে ছিটকে বেরোনো তিরের মতো আজহারউদ্দিন ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর নিশানার দিকে। প্রতিপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কব্জির কায়দায় ৭.৬৫এমএম পিস্তলের নলটা ঘুরিয়ে দিলেন ছাদের দিকে। দেহের ওজনকে কাজে লাগিয়ে রোগাটে বন্দুকধারীকে পেড়ে ফেললেন মাটিতে। মুহূর্তে পরিস্থিতি পাল্টে গেল। ছুটে গেল পিছনে থাকা পুলিশবাহিনী। দুষ্কৃতীর কাছ থেকে উদ্ধার হয় আরও একটি পিস্তল, মোজায় গুঁজে রাখা দু’খানা ছুরি। তত ক্ষণে ঘর থেকে বার করে আনা হয়েছে জনা সত্তর ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের বাংলার শিক্ষিকাকে।
স্বস্তির নিশ্বাস স্কুলে। স্বস্তিতে এসপি অফিস থেকে থানা। স্বস্তি নবান্নে। রাজ্য জুড়ে এই স্বস্তির মধ্যেই খোঁজ শুরু হয়ে গেল, জীবনের বাজি নিয়ে পিস্তলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া ভদ্রলোক কে? কিছু ক্ষণের মধ্যে পরিচয় মিলল। আজহারউদ্দিন খান। রাজ্য পুলিশের এক জন ডিএসপি (ডেপুটি সুপারিনটেন্ড্যান্ট অব পুলিশ)। এই মুহূর্তে মালদহে পোস্টেড। এ সবের মধ্যেই স্বগতোক্তির মতো আনন্দবাজার অনলাইনের নিউজ়রুমে ভেসে উঠল সম্পাদকের কণ্ঠ, ‘‘এ মাসের অ-সাধারণ আর কেউ হতে পারেন না।’’
যে ভাবে বন্দুকবাজকে বাগে আনলেন খালি হাতে। ছবি: ভিডিয়ো থেকে নেওয়া।
অ-সাধারণ সাহস। এবং অ-সাধারণ ফিটনেস। সাহস বা দুঃসাহস প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, এমন নাদুসনুদুস ভুঁড়ি, ঈষৎ স্থূল চেহারা নিয়ে অমন ছুটটা দিলেন কী করে? কী করে নির্ভুল নিশানায় বন্দুকবাজের হাতটা এক্কেবারে ঠিক জায়গায় ধরে ফেললেন? প্রশ্ন শুনেই হেসে ফেললেন ডিএসপি। কথায় কথায় জানা গেল, লম্বায় তিনি ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। ওজন ৯০ কেজি। স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি ওজন। তবে কি পরিস্থিতিই তাঁকে দিয়ে ওই দৌড়টা দিইয়ে নিল? উত্তরে প্রথমে একটু ব্যাকফুটে গিয়ে আলতো টোকা আজহারউদ্দিনের, ‘‘একেবারেই না। আমি কিন্তু ফিট।’’ তার পরেই, নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মাপা স্ট্রোক, ‘‘ডেভিড বুন, অরবিন্দ ডি’সিলভা, ইনজামাম-উল হকদের কি আপনি আনফিট বলতে পারবেন? চেহারা দিয়ে সব সময় ফিটনেস বোঝা যায় না।’’ জানালেন, এখনও নিয়মিত ক্রিকেট খেলেন। ছোট থেকেই খেলাধুলার নেশা। তাই, ২৬ এপ্রিলের দুপুরে হঠাৎ কোনও ‘গতি’ ভর করেনি তাঁর উপর, সবটাই তাঁর স্বাভাবিক ফিটনেসের ফল।
আজহারউদ্দিন নিজেও এক বার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঠাকুরদাদার বাড়িতে গিয়েছিলেন ইদের ছুটিতে। হাওড়ার উলুবেড়িয়ায়। মুসাপুর গ্রাম। ছোট্ট আজহারউদ্দিন পুকুরে নেমেছিল স্নান করতে। কিন্তু সাঁতার না-জানা ছেলে জলে নেমে একটু পরেই হাবুডুবু। তার পর ধীরে ধীরে তলিয়ে যাওয়া। শেষে পাড়ার দু’জন জলের তলা থেকে টেনে তুলেছিলেন। কোনও ক্রমে বেঁচে ফেরা। মালদহের স্কুলে ‘পণবন্দি’ বাচ্চাদের বোমা-বন্দুকের সামনে অসহায় অবস্থায় দেখে, এক লহমায় আজহারউদ্দিনের মনে পড়ে গিয়েছিল প্রায় সাতাশ বছর আগের সেই ঘটনার কথা। পড়ুয়াদের প্রাণ সংশয় দেখে তাই নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘অতগুলো আতঙ্কিত মুখ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই দিনটায়। আমিও সে দিন বাঁচতে চেয়েছিলাম। ওই দুটো মানুষ আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে নবজীবন দিয়েছিলেন। তাই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ছুটে গিয়েছিলাম। ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম পিস্তলের নলের নিশানা। কিছু ক্ষণের ধস্তাধস্তি। এর পর আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারেনি।’’
সে দিন আজহারউদ্দিনের আর একটা কাজ নিয়ে কোনও খবর হয়নি। আর এক জনকে বাঁচিয়েছিল পুলিশ। সেখানেও অগ্রণী দায়িত্বে তিনি। বন্দুকধারী দেব ধরা পড়ার পর স্কুলের বাইরে অপেক্ষমাণ অভিভাবক এবং সঙ্গে থাকা জনতার একটা অংশ তাঁকে গণপিটুনি দেওয়ার আওয়াজ তুলেছিলেন। পুলিশ বুঝতে পেরেই সতর্ক হয়। আইন হাতে তুলে নিতে চাওয়া সেই অংশকে নরমে-গরমে সামলান আজহারউদ্দিনেরা।
ছাত্রছাত্রীদের বাঁচানোর পর, বন্দুকবাজকে 'গণরোষের' হাত থেকে বাঁচাতেও এ ভাবে তৎপর হতে হয়েছিল আজহারউদ্দিনদের। ছবি: সংগৃহীত।
২০১৩ ব্যাচের ডব্লিউবিপিএস আজহারউদ্দিন। ভাবেননি কখনও পুলিশের চাকরি করবেন। কিন্তু এখন পুলিশে কাজ করেন বলে গর্ব বোধ করেন। ঠিক যেমন মালদহের স্কুলের ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর ঊর্ধ্বতন-অধস্তনেরা তাঁকে নিয়ে গর্ব বোধ করছেন। স্বয়ং পুলিশমন্ত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। আজহারউদ্দিন যদিও মনে করেন, তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। বাড়তি কিছু করেননি। কিন্তু তাঁর ঊর্ধ্বতন আধিকারিক তথা মালদহের পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব বলছিলেন, ‘‘আমরা তো একবারে ব্যক্তিগত স্তরে গিয়ে কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পারি না। পরিস্থিতি অনুযায়ী আধিকারিকদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আজহারউদ্দিন অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। গুলি চালিয়ে দিতে পারতেন ওই ব্যক্তি। আমাদের ব্যাক আপ টিম ছিল যদিও। কিন্তু ওঁকে গুলি করে দিলে তো করার কিছু থাকত না। কোনও সাবাশিই ওঁর জন্য যথেষ্ট নয়।’’ একই কথা বলছেন মালহদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অমিত সাউ। তিনি বলেন, ‘‘আজহারউদ্দিন খুবই ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজটা করেছেন। প্রায় ৭০ জন পড়ুয়া ছিল। নিজের প্রাণের কথা না ভেবে উনি যে ভাবে এক জন সশস্ত্র ব্যক্তিকে নিরস্ত করেছেন, তাতে আমাদের বিভাগের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। খুব প্রশংসনীয় কাজ। উনি এ ভাবেই কাজ করুন। এমন সাহসী আধিকারিকই দরকার বাহিনীতে। আমরা খুবই প্রশংসিত হয়েছি। উনি আমাদের কাঁধ উঁচু করেছেন।’’
আজহারউদ্দিনের জন্ম কলকাতায়। পড়াশোনাও। প্রথমে মর্ডান হাইস্কুল। তার পর সিটি কলেজ। গ্রামের বাড়ি হাওড়ার উলুবেড়িয়ার কাছে মুসাপুরে। বাবা আবুল আলি খান কর্মসূত্রে কলকাতার পার্ক সার্কাসে চলে এসেছিলেন অনেক বছর আগে। তাঁর ঠিকাদারির কাজ। বড় ছেলে আজিম খান তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় উঁচু পদে কাজ করেন। আর ছোট ছেলে পুলিশ আধিকারিক। বড় ছেলে আজিমই আসলে আজহারউদ্দিনকে পুলিশ বানানোর প্রাথমিক ‘কারিগর’। ২০০৭ সালে স্নাতক হওয়া ‘ভাই’ তখন একটি বেসরকারি সংস্থায় বিপণনের কাজ করেন। পাশাপাশি, গরিব পড়ুয়াদের পড়ান। একেবারেই বিনে পয়সায়। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে এমএসসির সুযোগ পাননি বলে প্রেসিডেন্সিতে সুযোগ পেয়েও ভর্তি না-হওয়া ভাইকে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় বসার পরামর্শ দেন আজিম। আজহারউদ্দিন রাজি হননি প্রথমে। শেষে দাদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘পুলিশে কাজ করতে পারব তো আমি?’’ আজিম ভরসা দেওয়াতেই বিপণন জগতের চাকরি ছেড়ে শুরু করেন প্রস্তুতি। ২০১৩ সালে তিন পর্ব পেরিয়ে ডব্লিউবিসিএসের ‘বি গ্রুপ’-এ চাকরি পেলেন আজহারউদ্দিন। পুলিশ সার্ভিস।
মালদহের এসপি প্রদীপকুমার যাদবের সঙ্গে ডিএসপি আজহারউদ্দিন খান। নিজস্ব চিত্র।
প্রথম পোস্টিংয়ে কালিম্পঙের ডিএসপি (ট্রাফিক)। ছোট্ট পাহাড়ি জেলায় ওই পদে তেমন কোনও কাজ ছিল না। আজাহারউদ্দিনের কথায়, ‘‘আমার প্রথম পোস্টিংটা প্রায় ঘুরতে যাওয়ার মতো ছিল। ছ’মাস ওখানে ছিলাম। তেমন কোনও কাজ ছিল না। ঘুরতাম সারা দিন। আর পড়াতাম।’’ এর পর জয়গাঁওয়ের এসডিপিও। তার পর আলিপুরদুয়ারের ডিএসপি (অপরাধ)। সেই সময় কালচিনিতে একটি কোচিং সেন্টারও খোলেন তিনি। উদ্দেশ্য, চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্য করা। কিছু দিনের মধ্যেই বদলি মালদহে। সেটা ২০২০ সালের ডিসেম্বর। এই জেলাতে এসেও ‘পড়ানো’র ঝোঁক কিন্তু হারিয়ে ফেলেননি। চাকরির পরীক্ষার ইন্টারভিউয়ের জন্য কী ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবেন পরীক্ষার্থীরা, তার প্রশিক্ষণ দেন আজহারউদ্দিন। শুধু তাই নয়, সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে কনস্টেবল হওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া ৯০ শতাংশই কৃতকার্য হয়েছেন। তাঁর আওতায় থাকা চারটি থানার ২১ জন সিভিক ভলান্টিয়ারের মধ্যে ১৭ জন ইতিমধ্যেই কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন।
গত বুধবার দুপুরে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বসেছিলেন আজহারউদ্দিন। আচমকাই এসপি-র ফোন। আজহারউদ্দিনকে জানানো হয়, মুচিয়া চন্দ্রমোহন হাই স্কুলে এক বন্দুকবাজ ঢুকে পড়েছে। তার কাছে অন্যান্য অস্ত্রও রয়েছে। রয়েছে পেট্রলবোমাও। সে সপ্তম শ্রেণির প্রায় জনা সত্তর পড়ুয়াকে ‘পণবন্দি’ করে রেখেছে। এসপির নির্দেশ, সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে হবে আজাহারউদ্দিনকে। মিনিট দশেকের মধ্যে স্কুলের সামনে পৌঁছে গেলেন বছর আটত্রিশের পুলিশকর্তা। দরজার বাইরে তখন শ’তিনেক অভিভাবক। মালদহ থানার পুলিশও রয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউ ভিতরে ঢুকতে পারছেন না। বন্দুকবাজের ঘোষণা, পুলিশ এলেই সে গুলি চালিয়ে দেবে। ফলে কেউ ঝুঁকি নিতে পারছিলেন না। পাশের পাঁচিল টপকে শেষমেশ ক্লাসের কাছে পৌঁছন আজহারউদ্দিন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের লোক ছাড়া কাউকেই কাছে ঘেঁষার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বন্দুকবাজ। তাই আবার বাইরে বেরিয়ে আসেন। ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে কোয়ার্টারে পাঠান, সাদা পোশাক আনতে। কিন্তু বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বুঝে আজহারউদ্দিন স্থানীয় এক জনের কাছ থেকে টি-শার্ট চেয়ে নেন। নেন হাওয়াই চপ্পলও। খুলে ফেলেন নিজের উর্দির জামা ও বেল্ট। পরে ফেলেন আকাশি রঙা টি-শার্ট। তার পর মোবাইলে ভিডিয়ো করতে করতে এগিয়ে যান ক্লাসঘরের দিকে। এমন ভাব, যেন তিনিও সংবাদমাধ্যমের কর্মী।
কারসাজি কাজে লেগে যায়। তাঁকে সন্দেহই করেননি বন্দুকবাজ। পরের পদক্ষেপ আচমকাই করেন আজহারউদ্দিন। ভিডিয়ো করতে করতে চকিতে ছুটে যান বন্দুকবাজের দিকে। জাপটে ধরে ফেলে দেন ক্লাসঘরের মেঝেতে। তার আগেই কব্জির মোচড়ে বন্দুকবাজের হাতে থাকা পিস্তলের নলের মুখ ঘুরিয়ে দেন ছাদের দিকে। এর পর আজহারউদ্দিনের পিছনে থাকা পুলিশের ‘ব্যাক আপ টিম’ পাকড়াও করে বন্দুকবাজ দেব বল্লভকে। ওই ক্লাসঘরেই আটকে ছিলেন বাংলার শিক্ষিকা প্রতিভা মোহান্ত। ৪৭ মিনিটের এই ‘নাটকের’ সাক্ষী তিনি। প্রতিভা বলছেন, ‘‘সিনেমাতে অনেক হিরো দেখেছি। কিন্তু এমন রিয়েল হিরো প্রথম দেখলাম। বন্দুকবাজের ভয়ে আমি কার্যত দিশাহীন হয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় আচমকা এক জন ঝাঁপ দিয়ে বন্দুকবাজকে মাটিতে ফেলে দিলেন। ঘুরিয়ে দিলেন বন্দুকের নিশানা। স্তম্ভিত হয়ে যাই। পরে জানতে পারি, উনি পুলিশ আধিকারিক আজহারউদ্দিন খান।’’ ওই স্কুলের প্রধানশিক্ষক স্বাগতম সাহা বলছেন, ‘‘১২ বছর চাকরি করছি এই স্কুলে। এমন হাড়হিম করা পরিস্থিতির মধ্যে পড়িনি কখনও। ভাবতেও পারিনি, সাদা পোশাকে এক জন পুলিশ আধিকারিক নিজের জীবন বাজি ধরে বিপন্মুক্ত করবেন আমাদের। আজহারউদ্দিন সাহেবকে পরে নমস্কার করেছি।’’ অভিভাবক সমর সরকারও একই কথা বলছেন। তাঁর কথায়, ‘‘খুব আতঙ্কে ছিলাম। স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। পুলিশ আমাদের ঢুকতে দিচ্ছিল না। হঠাৎ দেখি গেঞ্জি পরা এক ব্যক্তি কিছু লোকজন নিয়ে পাঁচিল টপকে ঢুকলেন। তাঁর বাহাদুরিতেই আমাদের বাচ্চারা বেঁচে ফিরল।’’
যাঁর বাহাদুরিতে বাইরের দুনিয়া মাতোয়ারা, সেই আজহারউদ্দিনের পরিবার তখনও কিছুই জানত না। দুপুর দুটো নাগাদ ফোন স্ত্রী রুবিনা পরভীনের। কোয়ার্টার থেকে। স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘দুপুরের খাবার পাঠাব তো?’’ আজহারউদ্দিনও খুব নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘হ্যাঁ।’’ ফোন রেখে দেন রুবিনা। কিছু ক্ষণের মধ্যে আবার ফোন, ‘‘এই তুমি কী করেছ? বাবা ফোন করে বললেন, টিভিতে তোমাকে দেখাচ্ছে!’’ হালকা হেসে ফোন রেখে দিয়েছিলেন আজহারউদ্দিন। তার আগে শুধু বলেছিলেন, ‘‘কিছুই করিনি। কাজই করেছি। ঘরে এসে বলব।’’ তার পর কলকাতা থেকে বাবা-মায়ের ফোন। মা বলেছিলেন, ‘‘এত বড় ঝুঁকি নিলি! যদি কিছু হয়ে যেত! তবে, অনেক মায়ের কোল বাঁচালি। তোর উন্নতি হোক।’’ বাবা বলেছিলেন, ‘‘অনেক বড় কাজ করেছ। ঈশ্বর তোমাকে অনেক বড় মানুষ তৈরি করুন। সাবধানে থেকো।’’ কিন্তু সন্ধ্যায় দাদার ফোনটা পেয়ে আজাহারউদ্দিন হেসে ফেলেছিলেন। আজিম ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘কি রে! কী করেছিস রে? ডেনমার্ক থেকে তোর ছবি পাঠিয়ে আমার এক বন্ধু জানতে চাইছে, তুই আমার ভাই কি না! তাড়াতাড়ি বল তো কী করেছিস?’’ দাদাকে শুধু একটা কথাই বলেছেন আজহারউদ্দিন, ‘‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ দাদা। যা করেছি, তা তোমার জন্যই করতে পেরেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy