গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
চৈত্রের দুপুর। উত্তর কলকাতার বাগবাজার থেকে শোভাবাজার সুতানুটি মেট্রো স্টেশনের রাস্তায় খাঁ খাঁ রোদ। একটু ছায়া পেতে পার্কে ঢুকেছিল খেজুরি থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসা পথচারী। ঢুকেই চমকে উঠেছিল। ছাউনি দেওয়া বসার জায়গায় থরে থরে সাজানো বই। লাইব্রেরি বা পাঠাগার বললে চোখের সামনে সাধারণ ভাবে যে ছবি ভেসে ওঠে, এটা ঠিক তেমন নয়। হালকা ভলিউমে চলছে কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। যাঁরা বসে রয়েছেন তাঁদের কারও হাতে বই, কারও হাতে পাক্ষিক পত্রিকার সংখ্যা, কারও হাতে খবরের কাগজ। কয়েক জন পাশাপাশি বসে মৃদু স্বরে গল্পও করছেন। খুব গুরুগম্ভীর পরিবেশও নয়, আবার খোলা হাটের মুখর আড্ডাখানাও নয়। কেমন যেন অন্য রকম।
চমক আরও বাকি ছিল। পাঠাগারের ঠিক সামনে রাখা ফুলগাছ, ক্যাকটাসের পরিচর্যায় ব্যস্ত এক প্রৌঢ়। মাঝেমধ্যে উঠে তিনি চা দিয়ে আসছেন সবাইকে। আবার মন দিচ্ছেন গাছ দেখাশোনায়। খোঁজ করতে জানা গেল, তিনি রাজবল্লভপাড়া মোড়ের এই জগৎ মুখার্জি পার্কের সিকিউরিটি গার্ড। নাম সত্যরঞ্জন দোলুই। আরও জানা গেল, তাঁর হাতেই তৈরি এই লাইব্রেরি। তিনিই এর দেখভাল করেন। তিনিই লাইব্রেরিয়ান।
কেউ কেউ বলেন, বাগবাজারের নাম নাকি এসেছে বাঁকবাজার থেকে। শহর পত্তনের গোড়ায় আজকের বাগবাজারের কাছেই একটি বড়সড় বাঁক ছিল গঙ্গার। সেই থেকেই বাঁকবাজার। নগর কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনে যে সব গুরুত্বপূর্ণ বাঁক এসেছে, তাতে এই বাগবাজারের ভূমিকা সত্যিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বসু, নিবেদিতারা এই এলাকা থেকে নবজাগরণের অনেক আলো ফুটিয়েছেন। বিবেকানন্দ এই এলাকায় বেশ কিছু কাল কাটিয়েছেন। রামকৃষ্ণের পদচিহ্ন পড়েছে বারংবার। এ হেন এলাকায় এক বহিরাগত মাধ্যমিক পাশ মানুষকে অন্যদের বই পড়ানোর আনন্দে মশগুল দেখে মনে হল, একেই কি স্থানমাহাত্ম্য বলে!
লাইব্রেরি বা পাঠাগার বললে চোখের সামনে সাধারণ ভাবে যে ছবি ভেসে ওঠে, এটা ঠিক তেমন নয়। হালকা ভলিউমে চলছে কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। যাঁরা বসে রয়েছেন তাঁদের কারও হাতে বই, কারও হাতে পাক্ষিক পত্রিকার সংখ্যা, কারও হাতে খবরের কাগজ। — নিজস্ব চিত্র।
সত্যরঞ্জনের পাঠাগারে বিনামূল্যে বই মেলে। চাইলে বাড়িও নিয়ে যাওয়া যায়। পুরোটাই বিশ্বাসের উপর। কোনও লেখালেখি নেই। লাইব্রেরি কার্ড নেই। এমনকি এই লাইব্রেরির কোনও দরজা-জানলাও নেই। সত্যের নেশা তাঁর বাগানের গাছ, ফুল আর বই নিয়ে ঘুরপাক খায়। তবে বই পড়া তাঁর নেশা নয়। নেশা তাঁর বই পড়ানোয়। দশটা মানুষ তাঁর চোখের সামনে বই পড়ছেন, নানা রকম আলোচনা করছেন, এটুকুই সত্যের চাওয়া। এটুকু দেখে তাঁর সুখ। আর এই নেশার জন্য তিনি কী না করেন! সাইকেল চালিয়ে উত্তর কলকাতা থেকে চলে যান জোকা পর্যন্তও। ফিরে আসেন সাইকেলের ক্যারিয়ার, হ্যান্ডেলে ঝোলানো পুরনো বই নিয়ে। তা দিয়ে বাড়তে থাকে সত্যের বইবাগান। জগৎ মুখার্জি পার্ক, এলাকায় যা চিলড্রেন’স পার্ক নামেই বেশি পরিচিত, তার পাশেই থাকেন পেশায় ‘পরিবেশ পরামর্শদাতা’ অনীত ঘোষ। পার্কের প্রায় উল্টো দিকের শ্যামবাজার এভি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। অনীতের কথায়, ‘‘এক জন প্রান্তিক মানুষ সত্যরঞ্জন। সে ভাবে পড়াশোনা করেননি। কিন্তু যে ভাবে চোখের সামনে দেখলাম তিনি এটা গড়ে তুললেন তা কুর্নিশ করার মতো।’’
সেলসে চাকরি করেন বছর তিরিশের অর্ণব বসু। এলাকার বাসিন্দা। কাজের ফাঁকে প্রতিদিন আসেন। বই পড়া, গল্প সবই হয়। সারা দিনের কাজের মধ্যে এটাই তাঁর কাছে অবসর সময় কাটানোর সেরা ঠিকানা। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু বই তো নয়, সঙ্গে সাজানো একটা বাগান। পার্কে বসে বই পড়ার সুযোগ উত্তর কলকাতায় আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।’’
জন্মস্থান থেকে শতাধিক কিলোমিটার দূরে নিজের ভাগ্য ফেরাতে কলকাতা শহরে এসেছিলেন সত্যরঞ্জন। পৈতৃক বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পাথরপ্রতিমায়। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে অল্প বয়সেই বুঝে যান, সংসারের হাল ধরার জন্য তাঁকে রোজগার করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছিলেন। তার পর কপালে যা থাকে বলে কলকাতায় পাড়ি। খুব একটা কাউকে যে চিনতেন তা-ও নয়। তবে মিশুকে, হাসিখুশি সেই তরুণ ঠিক করে নেন, কিছু একটা করবেনই। এত বড় শহর। একটা কাজ ঠিক হয়ে যাবে। সেই থেকে তাঁর ঠিকানা উত্তর কলকাতা।
প্রথমে জয়পুরিয়া কলেজের কাছে একটি বেসরকারি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। পরে সেখানেই চাকরি। ডেটা এন্ট্রির কাজ। কিন্তু মাইনে যা, তা দিয়ে চিঁড়ে ভিজত না। পাঠাগারের চেয়ারে বসে ফেলে আসা দিনের কথা শোনাতে গিয়ে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়লেন সত্য। বললেন, ‘‘সেই ৮৮ সাল থেকে ২২ বছর চাকরি করেছি। কিন্তু কোনও বছর বেতন বাড়ত ১০০ টাকা, কখনও ২০০ টাকা। ২২ বছর চাকরি হয়ে গিয়েছে। তখন মাসিক বেতন ছিল ২ হাজার টাকা! ভাবলাম, এ ভাবে চলবে না।’’ তার পর? স্থানীয় কাউন্সিলর কল্যাণী মিত্রের কাছে কাজের খোঁজ করেছিলেন সত্য। কিছু ক্ষণ ভেবে কাউন্সিলর বলেছিলেন, ‘‘একটা সিকিউরিটি গার্ডের কাজ আছে। করবেন?’’ এক মুহূর্ত না ভেবে ‘হ্যাঁ’ বলে দেন সত্য। তার পর ২০১০ থেকে জগৎ মুখার্জি পার্কে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি। সত্যের কথায়, ‘‘কাজ একটা হল বটে। কিন্তু পড়লাম অন্য সমস্যায়। গ্রামের ছেলে তো! শুধু শুধু বসে থাকতে একদম পারি না। আর কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। পার্কটা তখন অন্য রকম ছিল। ঠিক করলাম, পার্কটা ভাল করে সাজাব। শুরু করি বাগান-চর্চা। এই পার্কে মানুষের আনাগোনা সব সময়ই ভাল। কাছেই এভি স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার-গিরিবালা। একটু সামনে জয়পুরিয়া কলেজ। কমবয়সি ছেলেমেয়ে থেকে তাঁদের অভিভাবক সবাই এখানে আসতেন। তাঁদের অনেকেই পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করেন। বসে বসে কথাবার্তা শুনতাম। সেখান থেকেই একদিন এই পাঠাগার তৈরির ভাবনা এল।’’
পাঠাগারের ঠিক সামনে রাখা ফুলগাছ, ক্যাকটাসের পরিচর্যায় ব্যস্ত এক প্রৌঢ়। মাঝেমধ্যে উঠে তিনি চা দিয়ে আসছেন সবাইকে। আবার মন দিচ্ছেন গাছ দেখাশোনায়। — নিজস্ব চিত্র।
প্রথমে ওই অভিভাবকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন গাছপালা নিয়ে। তার মধ্যেই আড্ডায় শুনতেন লেখা, লেখক, সাহিত্য, সাহিত্যিকদের কথা। সেখান থেকেই পাঠাগার তৈরির কথা ভাবেন সত্য। সেই শুরু। নিজেই পত্রপত্রিকা কিনে এনে পার্কের বিশ্রামাগারে রাখতে শুরু করলেন। পড়তে পারবেন যে কেউ। সত্যের এমন কাজ দেখে নিত্যদিন যাঁরা পার্কে আসা-যাওয়া করতেন, তাঁরা আপ্লুত। তাঁদের উৎসাহে তৈরি হয়ে গেল লাইব্রেরি।
লাইব্রেরির কোনও বিশেষ প্রবেশপথ নেই। চারপাশ খোলা। ভেতরে চেয়ার পাতা এবং দেওয়াল জুড়ে কাঠের তাকে নানা রকম বই। বেশির ভাগই পুরনো। অনেকেই সত্যকে বই দিয়েছেন তাঁর লাইব্রেরি সাজাতে। কোথাও আবার পুরনো বই বিক্রি হবে শুনলে সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন সত্য। অনেক বই আবার নিজের স্বল্প উপার্জন থেকে জমানো টাকায় কেনা। তা ছাড়া বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি, তিন ভাষায় তিনটি খবরের কাগজ লাইব্রেরিতে এনে রাখেন সত্য। বই রাখার জন্য জোগাড় করেছেন পুরনো তাক, পুরনো আলমারি। পাঠাগারের দেওয়াল জুড়ে লাগিয়েছেন মনীষীদের ছবি। আর বারান্দা জুড়ে ফুল এবং পাতাবাহারি গাছ। রয়েছে ক্যাকটাসও।
কখনও নিজে পড়াশোনা করেন? প্রশ্ন করতেই সত্যের সলজ্জ জবাব, ‘‘হয়ে ওঠে না ঠিক। নিজে ভৌতিক গল্প ভালবাসি। মাঝেমাঝে পাতা ওল্টাই। তবে এত মানুষ আসেন, কোনও কিছু পড়ার পর তাঁরা আলোচনা করেন। আমি শুনি বসে বসে।’’
পার্কটি পুরসভার অধীনে। সেখানে এমন লাইব্রেরি করা নিয়ে প্রথমে বাধা এসেছিল। কিন্তু স্থানীয়রা সত্যের পাশে দাঁড়ান। সত্য বললেন, ‘‘সবাইকে পাশে না পেলে এটা হতই না। অনেক সাহায্য পেয়েছি সবার।’’ ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল। ১২ বছর হল সত্যের লাইব্রেরির বয়স। ভাঙা আলমারির তাকে এক পাঠকের ফেরানো ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ সাজিয়ে রাখতে রাখতে সত্য বলেন, ‘‘ঝড়বাদলার দিন আসছে। বর্ষার সময় বইগুলো রক্ষণাবেক্ষণে বেশ সমস্যা হয়। প্রায় ১০ হাজার বই আছে। যদি এ ব্যাপারে কারও সাহায্য পাই, খুব ভাল হয়। আর একটা কম্পিউটার যদি পাই।’’ পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর পূজা পাঁজা। সত্যরঞ্জনের লাইব্রেরি নিয়ে প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘‘এমন একটা কাজ করছেন যা সচরাচর দেখা যায় না। আমি তো দেখে মুগ্ধ। আমরা এই লাইব্রেরির জন্য আধুনিক প্রযুক্তির যা যা সাহায্য লাগবে তা-ও দেব।’’ একই সঙ্গে জানালেন, শুধু বই নয়, গাছগাছালি বা প্রকৃতি নিয়ে ওঁর প্রেম ‘‘অবাক করার মতো’’। পূজার সারসংক্ষেপ, ‘‘আসলে তিনি এই পৃথিবীকে সবুজ দেখতে চান।’’
এই পাড়ার ছোট্ট পার্কে বরাবরই এলাকার কচিকাঁচা আর বয়স্কদের ভিড় বেশি। সত্যের লাইব্রেরি, সত্যের গাছের মধ্যেই এখন ‘মর্নিং ওয়াক’ থেকে বিকেলের রোদ্দুরে হুটোপাটি। তার মধ্যেই বই খুলে বসে যান পাঠক। সত্য শুনেছেন, ইন্টারনেটের যুগে বই পড়া কমে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করেন না। নিজে সে ভাবে বই না-পড়লেও, বইপড়ুয়াদের দেখে তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং অনুভূতি হল, ‘‘আমি তো প্রতি দিনই দেখি নানান বয়সিরা এখানে বসে বই পড়ছেন। আলোচনা করছেন। আসলে বইপোকা বলে যে শব্দটা শুনেছি, তাঁরা আছেন। তাঁরা থাকবেন।’’
এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, লাইব্রেরিকে ঘিরে এখন নানা বিষয়ের আলোচনা সভা, ছবি প্রদর্শনীর মতো আয়োজনও হচ্ছে। ভবিষ্যতে এগুলো আরও বেশি করে করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
সত্য বলছিলেন, ‘‘এই বেশ ভাল আছি।’’ আর পাথরপ্রতিমা থেকে আসা সত্যর কাছে, চৈত্রের দুপুরে বিনা পরিকল্পনায় পৌঁছে যাওয়া খেজুরি থেকে আসা পথচারীর মনে হচ্ছিল— সত্য সৈকত, কী বিচিত্র এই কলকাতা! বহিরাগতদের আপন করে নেয়। বহিরাগতরাও আপন করে নেয় ‘এই শহরটাকে’। এই ভাবেই কি চলতে থাকে ‘এ কলকাতার মধ্যে’ থাকা ‘আর একটা কলকাতা’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy