গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।
ছোট্ট একটা ব্যবসা আছে তাঁর। আইসক্রিমের। ফেরিওয়ালারা ঠেলাগাড়ি করে আইসক্রিম কিনে নিয়ে যান তাঁর কারখানা থেকে। কিন্তু সে ব্যবসা আর আগের মতো নেই। নামী-দামি কোম্পানির আইসক্রিম বাজারে এসে গিয়ে ঠেলাগাড়ি-বাক্স করে এলাকায় ফেরি করে বেড়ানোদের দিন গিয়েছে। তবুও যেটুকু যা আছে, বাপ-ব্যাটা মিলে তা সামলে দেন। আর ব্যবসায় তাঁর মন আর কবেই বা ছিল! সেই যে তরুণ বয়সে দৃষ্টিহীনদের দিকে চোখ ঘুরে গেল তাঁর, মাথা আর অন্য দিকে ঘোরেনি কখনও। তখন থেকেই তো তিনি অন্ধকারের দেশে আলোর ফেরিওয়ালা।
সিদাম সাহার বয়স এখন ৬৩। দৃষ্টিহীনদের জন্য তাঁর কাজ নিয়ে কথা শুরু হলে প্রথমেই তিনি ফিরে যান সেই ১৯৮০ সালে। তখন বয়স ছিল ২২। সেই তরুণ বয়সেই সিদাম হঠাৎ খবর পেয়েছিলেন তাঁর এক সম্পর্কিত ভাগ্নে গোবিন্দ দাসের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাতে তাঁর একটা চোখ একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষীণ হতে শুরু করে অন্য চোখের দৃষ্টিও। স্থানীয় চিকিৎসককে দেখানোর পর সিদাম তাঁর ভাগ্নেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান। সেখানকার চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ রণবীর মুখোপাধ্যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানিয়ে দেন, গোবিন্দের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করাতে হবে। তা হলেই ওই চোখে দৃষ্টি ফিরে পাওয়া সম্ভব।
এর পর শুরু হয় কর্নিয়ার খোঁজ। তরুণ সিদামের কোনও ধারণাই ছিল না এ সব সম্পর্কে। হাসপাতালে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, গোবিন্দর নাম হাজার দুয়েক মানুষের পিছনে। আবেদন করলে কবে কর্নিয়া মিলবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তেমনই এক সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি ছোট্ট বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল সিদামের। তা দেখেই চলে যায় প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের ‘ইন্টারন্যাশনাল আই ব্যাঙ্ক’-এর দফতরে। সেখানে যোগাযোগ করেই গোবিন্দর জন্য মাস তিনেকের মধ্যেই সিদাম জোগাড় করে ফেলেন কর্নিয়া। প্রতিস্থাপনের পর গোবিন্দ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান একটি চোখে।
এই ঘটনাই সিদামকে প্রথম দৃষ্টিহীনদের জন্য ভাবতে শেখায়। আর তখন থেকেই মরণোত্তর চক্ষুদানের জন্য সাধারণ মানুষকে বোঝানো শুরু। ঠিক করে ফেলেন, যাঁদের চোখে আলো নেই, তাঁদের আলোর পথযাত্রী করে তোলাই হবে তাঁর কাজ। মানুষের মৃত্যুর পর দেহ পোড়ানো বা কবর দেওয়ায় আদতে যে চোখ ‘নষ্ট’ করা হয়, সেটাই বোঝাতে থাকেন সিদাম। এখনও তিনি বলেন, ‘‘অনেক কুসংস্কার আছে। কিন্তু চোখ পুড়িয়ে বা মাটিতে পচিয়ে লাভ কী! ওই চোখ এক জন দৃষ্টিহীনের চোখে আলো ফেরাতে পারে। মৃত্যুর পরে চোখ দান করাই উচিত আমাদের।’’
মরণোত্তর চক্ষুদান দিয়ে সচেতনতা তৈরি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সিদাম। নিজস্ব চিত্র।
‘ইন্টারন্যাশনাল আই ব্যাঙ্ক’-এর সহযোগিতায় ১৯৮৫ সালে শ্রীরামপুরেই গড়ে ওঠে আই ব্যাঙ্ক। সেখানকার সদস্য হন সিদাম। এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ‘চোখ’ সংগ্রহ করেছেন ওঁরা। সিদামের কথায়, ‘‘ওই সাড়ে পাঁচ হাজার চোখ পেতে অন্তত ৩০ হাজার মানুষের কাছে আবেদন করতে হয়েছে। কোনও মৃতের পরিবার রাজি হয়েছেন। তবে বেশির ভাগই রাজি হননি। সকলে যদি দিতেন, তা হলে তো দেশটাই বদলে যেত!’’
এই করোনা পরিস্থিতির আগে পর্যন্ত শ্মশানে গিয়ে ক্যাম্প করতেন সিদাম। মৃতের সঙ্গে আসা শ্মশানযাত্রীদের কাছে আবেদন করতেন চক্ষুদানের জন্য। বছরে এক দিন টানা ক্যাম্প। চার-পাঁচটি চোখ পেতেনও। কোথাও মৃত্যুর খবর পেলে এখনও সিদাম দৌড়ে যান মৃতের বাড়ি। পরিবারের লোকজনকে বোঝাতে থাকেন। খ্যাতনামীরাও বাদ যান না। কথায় কথায় সিদাম বলছিলেন, চিত্রপরিচালক তপন সিংহ, অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ রায়, পরিচালক যিশু দাশগুপ্তের চোখ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। তবে অনেকেই সিদামের চক্ষুদানের প্রস্তাব পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই তালিকায় রয়েছে প্রয়াত সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী, তৃণমূল নেতা অজিত পাঁজা, অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের পরিবার। সিদাম বলেন, ‘‘সুচিত্রা সেন মারা যাওয়ার খবর পেয়েই ওঁর বাড়িতে ফোন করেছিলাম। পরিচয় দিই। সম্ভবত মুনমুন সেন ফোন ধরেছিলেন। তিনি 'না' বলে দেন।’’
তবে এই 'না' শুনতে এখন আর খারাপ লাগে না সিদামের। শ্রীরামপুর আই ব্যাঙ্কের সঙ্গে এখন তো না হয় কাজ করছে চুঁচুড়া, কোন্নগর, রিষড়া জাঙ্গিপাড়ার বেশ কয়েকটি সংস্থা। কিন্তু সিদাম যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখনও মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে মানুষের স্পষ্ট ধারণাই তৈরি হয়নি। কলকাতার আই ব্যাঙ্ক থেকে ‘লিফলেট’ নিয়ে বাসে করে ফিরতেন। সিদাম ইচ্ছা করেই সেগুলো ব্যাগে না ভরে হাতে রেখে দিতেন। যদি কেউ দেখে আগ্রহী হন। শ্রীরামপুরে একটা হোর্ডিংও টানিয়েচিলেন সেই সময়। পথচলতি মানুষের যদি চোখে পড়ে! প্রতিবেশীর বাড়িতে চক্ষুদানের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছেন। ঝাঁটা হাতে গৃহিনীর তাড়া তাঁকে খেতে হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে খানিক আগ্রহ তৈরি হতে লাগল মানুষের মধ্যে। চলতে লাগল সচেতনতার প্রচার। আই ব্যাঙ্কে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসে বিনামূল্যে চিকিৎসা চলতে থাকে। বিশ্ব কর্নিয়া দিবসে প্রতি বছর দৃষ্টিহীন শিশুদের জন্য নিজেই আয়োজন করেন খাওয়া-দাওয়ার। চলে নাচ, গান, পার্কে ঘোরা। সিদামের কথায়, ‘‘একটা দিন ওদের অনাবিল আনন্দে মেতে উঠতে দেখে খুব ভাল লাগে।’’
বিশ্ব কর্নিয়া দিবসে প্রতি বছর দৃষ্টিহীন শিশুদের জন্য খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেন সিদাম সাহা। নিজস্ব চিত্র।
বাড়িতে স্ত্রী, দুই ছেলে, বড় ছেলের স্ত্রী আর সিদামের এক দাদা রয়েছেন। এক সময়ে মায়ের কাছ থেকে বিপুল উৎসাহ পেয়েছেন। পরিবারের সকলেই সিদামের এই কাজকে অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখেন। সিদাম বলছিলেন, ‘‘দৃষ্টিহীনদের চোখে আলো ফেরানোর কাজ করি। ওটাই আমার সব। পরিবারের সকলে সেটা জানে।’’ আর পরিবারের বাইরে? সে ভালবাসাও পান সিদাম। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁদের দৃষ্টি ফেরাতে পেরেছি, তাঁদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাঁরা বলেন, আপনারা না থাকলে দৃষ্টি ফিরে পেতাম না। আমি লজ্জা পাই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা আনন্দ হয়। সেটা পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। ওটাই সব।’’
মা মারা গিয়েছেন ২০১৩ সালে। এসএসকেএম হাসপাতালে মায়ের দেহ দান করেন। চোখও। কেউ না কেউ সেই চোখ পেয়েছেন। সিদাম তাঁর খোঁজ পাননি এখনও। খুঁজতে চানওনি। অনেকে তাঁকে সংবর্ধিত করতে চান। কোথাও কোথাও সিদাম যানও। কিন্তু ও সব তাঁর ভাল লাগে না। বলছিলেন, ‘‘সংবর্ধনা কী হবে! ওটা নিয়ে কী কাজ! তার চেয়ে যদি একজন দৃষ্টিহীনের দৃষ্টিও যদি ফিরিয়ে দিতে পারি, তা হলে সেটা হবে কাজের কাজ।’’
দরিদ্র বয়স্কদের চোখের ছানি অস্ত্রোপচারেও হাত বাড়িয়ে দেন সিদাম। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এ কাজ করান তিনি। এ সব ক্ষেত্রে তাঁর ব্যবসার টাকা ঢুকে যায়। স্ত্রী-পুত্র যদিও কিছু বলেন না। কারণ, ওঁরা এত দিনে বুঝে গিয়েছেন, যাঁর কারখানা থেকে ফেরিওয়ালারা আইসক্রিম কিনে নিয়ে যান, সেই সিদাম সাহা আসলে অন্ধকারের দেশে এক জন আলোর ফেরিওয়ালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy