হিন্দুদের দেবদেবীর সংখ্যা তো বিস্তর। ফলে তীর্থস্থানও অজস্র। কাশী, বৃন্দাবন, মথুরা তো আছেই। দক্ষিণের জনপ্রিয় তিরুপতি থেকে উত্তরে হিমালয়ের কোলে তো বলতে গেলে সবই পীঠস্থান। কেদার-বদ্রী, অমরনাথ থেকে কামাক্ষ্যা। মা কালীর ছিন্নছিন্ন শরীরের একশো আটটি অংশই তো হিন্দুদের পীঠস্থান। শ্রীকৃষ্ণের ‘দ্বারকা’ বা গুজরাতিদের ‘রণছোড়জি’তে তো সুবিশাল মন্দির রয়েছে পশ্চিম ভারতে।
ওদিকে মুসলমানদের মসজিদ পৃথিবীময় হাজারে হাজারে ছড়িয়ে থাকলেও, তীর্থক্ষেত্র কিন্তু একটিই। সৌদি আরবের ‘হজ’ বা মক্কা-মদিনাই মহাতীর্থ। কথায় বলে, নানান তীর্থ বারবার ‘হজ-যাত্রা’ একবার।
ক্রিশ্চানদের প্রায় এই রকমই। সারা বিশ্বে অজস্র পবিত্র গির্জা ছড়িয়ে থাকলেও, মহা পীঠস্থান কিন্তু ‘ভ্যাটিকান’ শহরেই। সেন্ট পিটার গির্জা। ‘যিশুখ্রিষ্টের শহর’ বা ‘পবিত্র শহর ভ্যাটিকান’ নামে সারা বিশ্বে এর পরিচয়। যিশুর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে পৌঁছে গেছি ইতালির ‘রোম’ শহরের প্রান্তে ‘ছিয়াম্পিনো’ বিমানবন্দরে। ইংরিজি ‘থি’ অক্ষরটিকে এঁরা ‘ছি’ উচ্চারণ করেন। খুঁজেপেতে শহরের ভেতরে সেঁধিয়ে উঠলুম গিয়ে আরেক মধ্যবিত্ত আস্তানায় ‘হোতেল ছেল্লো’। ছিমছাম হোটেলটি একেবারে ঠাসা বলতে পারেন, নানা দেশবিদেশের লোকে। আহা! ‘ক্রিসমাস’ আসছে না! ঈশ্বরের সাক্ষাত্ পুত্র যিশুর জন্মদিন। ফলে রোম তথা পবিত্র ‘ভ্যাটিকান সিটি’ এখন জমজমাট। সারা শহরের কোনও হোটেল-মোটেল-পান্থনিবাসে তিলধারণের ঠাঁই নেই। অনেকটা গঙ্গাসাগর মেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। খ্রিষ্টধর্মের মহামিলন ক্ষেত্র। ‘একা রামে রক্ষে নাই, লক্ষ্মণ দোসর’। ডিসেম্বরের শীত নেমেছে জাঁকিয়ে। সঙ্গে দোসর লাগাতার বরফকণা, ‘ফিসফিস’ বৃষ্টি সেই সকাল থেকে। প্রায় হাঁটুর নীচে অবধি টানা লম্বা গরম মোজা ও ট্রাউজারের ওপরে গরম গেঞ্জি-হাফহাতা সোয়েটার। তার ওপরে উষ্ণ জামা গলা অবধি বন্ধ। তদুপরি ফুলহাতা দাদুর সোয়েটার। এই সব বর্মর ওপরে গায়ে চড়াতে হয়েছে একটি ত্রিপল-জাতীয় কড়ক বস্তু দিয়ে বানানো ওভারকোট গোছের বর্ষাতি। এ জিনিস দেয়ালে টাঙাবার দরকার নেই। স্রেফ খুলে মেঝের যে কোনও জায়গায় দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দিন, ‘রোবো’ (বা রোবট)-র মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু! রাশিয়ায় বছর তিনেক ছিল, এমন বন্ধুর উপহার,—“যা, যা, নিয়ে যা। ঠিক কাজে লাগবে। ইউরোপের শীত বলে কথা! যেখানে সেখানে ছেড়ে দিবি, দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝামেলা নেই! মাথায় রোমশ পশমের কান-ঢাকা ‘কসাক’ টুপি।
যাই হোক, অত্ত সব—প্রায় দশ-পনেরো কেজি ওজনের সাজসজ্জায় ডাকা শরীরও থেকে থেকে কেমন কেঁপে উঠছে। শত হলেও বঙ্গদেশের ভেতো বাঙালি। তা, সেই গজ-কচ্ছপ গোছের ধুমসো পোশাকে রোমের প্রাচীন পাথুরে পথে ঘুরতে বেড়িয়েছি। রোমান রাজ্যের অজস্র রাজাগজারা এই সব পথে বিচরণ করেছেন। ইতিহাসবিখ্যাত ধর্মযাজকগণ হেঁটেছেন তাঁদের শুভ্র শরীর-ঢাকা পোশাক পরে। প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পী-ভাস্করদের পদধূলি পড়েছে এই পথে। এমনকী হতদরিদ্র, অত্যাচারিত তাবত্ রোমান প্রজাদের দুঃখদুর্দশা দূর করতে, তাদের মধ্যে গিয়ে তাদের সঙ্গে বসবাস করে তাদের ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত’ বলে সাহস ও মানসিক শক্তি দিতে নেমে এসেছিলেন স্বয়ং যে ঈশ্বরের সন্তান বা সাক্ষাত্ ভগবানের অবতার—সেই যিশুখ্রিষ্টও এই পথে পা ফেলে হেঁটেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে চরম সেই দুঃখের দিনে, ছিন্নভিন্ন মলিন কৌপিন পরে প্রায়-নগ্ন শরীরে, আপন কাঁধে বিশাল ওজনের রোমান ‘দণ্ডকাষ্ঠ’ বা ক্রুশ বয়েছেন। হা-ক্লান্ত পা টেনে টেনে তাঁর জন্যেই নির্ধারিত বধ্যভূমিতে আপন মৃত্যুদণ্ড নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ‘ক্রুশবিদ্ধ যিশু’ আজ বিশ্ববাসীর ধর্মের প্রতীক।
যত ভাবতে ভাবতে হাঁটছি, শরীর তত রোমাঞ্চিত হচ্ছে। শহরের প্রায় প্রধান কেন্দ্রে পৌঁছে এক বয়স্ক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলুম, “সেন্ট পিটার চার্চে কোনও বাস যায় নাকি? অনুগ্রহ করে কোন বাস, কত নম্বর একটু বলবেন?”
স্থূলকায়া মহিলাটি একটু খাটোমতন। আমার কোনও বিলিতি, গোলাপি রঙের পিসিমা-মাসিমা থাকলে হয়তো অনেকটা এই রকম দেখতে লাগত।
চোখের চশমা কপালে তুলে পিটপিটে চোখে আমায় ‘পর্যবেক্ষণ’ করলেন। বললেন, “যে কোনও বাসে উঠে পড়ুন। প্রায় বেশির ভাগই ভ্যাটিকান যাবে।” তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি ল্যাটিন আমেরিকা থেকে এসেছ, না পাকিস্তান?”
আপন দেশে বলাতে ‘পিসিমা’ আরও একগাল হেসে বললেন, “ভেরি হোলি ল্যান্ড! কাম অন সন! আমরাও ভ্যাটিকান যাব।” বলে ‘আমরা’টিকে ডাকলেন।
একটি সদ্য কিশোরী, ছটফটে। ভিড়ের মধ্যেই দু’চার কদম আগে আগে হাঁটছিল। প্রায় নাচতে নাচতে। অ্যাত্তো মানুষজন রাস্তায় হাঁটছে। একটা উত্সব-উত্সব ভাব, গন্ধ, দৃশ্য। মেয়েটির নাম মারিয়া। সবুজ-হলুদ গরম ফ্রকের ওপরে ফুলহাতা সোয়েটার। বেশ প্রাণবন্ত।
তা পৌঁছে গেলুম গন্তব্যে, একেবারে মিনিমাগনায়। ভ্যাটিকানের ‘সেন্ট পিটার গির্জা’ এক এলাহি ব্যাপার। ভীমাকৃতি থামের পর থাম। চওড়া চওড়া পাথরের সিঁড়ির পর সিঁড়ি। দশাসই পাথুরে মূর্তি-প্রতিকৃতির ছড়াছড়ি। অনেকখানি জায়গা জুড়ে মস্ত মস্ত পাথর দিয়ে তৈরি প্রাঙ্গণ। তারই চারপাশ ঘিরে প্রাচীন সময়ও যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই প্রশস্ত বিশালতার মধ্যে বড়দিনের নানান রঙিন সাজপোশাক পরা আধুনিক মানুষ-মানুষিদের কেমন খেলনা-পুতুল লাগছে। গির্জার মাথার নীচে, ডানপাশে প্রকাণ্ড একটা ঘড়ি। তার নীচে দুলছে ঘণ্টা। প্রার্থনার সময় তখন। ঘণ্টার গম্ভীর ধ্বনি এই পুরাতন ‘ভগবানের শহরে’ প্রতিধ্বনি তুলে ঘুরছে। গম্বুজ থেকে সিঁড়িতে, সিঁড়ি থেকে পাথরের মূর্তিদের গায়ে গায়ে। এই গমগম শব্দ, এই প্রতিধ্বনি যেন আজকের পুতুলদের জন্য নয়। এ যেন অনেক গভীরে-গভীরে কথা। ‘অ-উ-ম্’ অথবা ‘ওঁ’-এর মতো কোনও অতি বিশুদ্ধ পবিত্র, ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।
প্রধান গির্জায় ঢোকার আগে একটি থামের পাশে দাঁড়িয়েছিলুম। আমার ডান কান সেই থামে চেপে ধরতেই কেমন যেন শ্বাসের শব্দ। ‘সাস’ বা ‘জিসাস’-জাতীয়। হঠাত্ খেয়াল হল, মারিয়ার মা বেশ শক্ত করে হাত ধরে আছেন আমার। চোখে চোখ পড়তে সামান্য আলগা দিলেও, ছেড়ে দিলেন না। বললেন, “কেমন যেন ভয়-ভয় করে। তাই না?”
এখানে বড়দিনের মরসুম পুরোদমে শুরু হয়েছে দু’দিন আগেই। মারিয়া, চঞ্চলা তরতাজা কিশোরী, যে যৌবনের দিকে দ্রুত হাঁটছে, ছটফটে ভঙ্গিতে চোখের ইশারায় বললে, “ভেতরে যাই,
না। বয়স্কার মতো ঠিক ‘ভয়-ভয়’ নয়। তবে হ্যাঁ, খানিকটা হয়তো বা তাই। সঙ্গে চমক, সঙ্গে পরিবেশের গভীরতা। যিশুর জন্মদিনে দিগ্বিদিক থেকে বাতাস বয়ে আনছে কোনও বার্তা। হয়তো বা জয়ধ্বনি-প্রণাম। স্থবির, স্তম্ভিতের মতো পরিবেশের, ধ্বনির মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। পবিত্রতায় স্নান—ঘণ্টার শব্দ—অউম জিসাস— চোখে জল।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy