শুক্রবারের বিকেল পাঁচটা। কিছু ক্ষণ আগে লোকসভায় পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) চালুর জন্য বিল পেশ করেছেন অরুণ জেটলি। তার পর অর্থ মন্ত্রকে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন। ওঠে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ। জেটলি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই পণ্য-পরিষেবা করের জোরালো সমর্থক।” কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো এখনও এর বিরোধিতা করছে! অর্থমন্ত্রীর জবাব, “আশা করি, ওঁদের সুবুদ্ধি হবে।”
একই সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় বসেছেন বঙ্গভবনে। সেখানেও জিএসটি নিয়ে প্রশ্ন। মমতার জবাব, “আমরা নীতিগত ভাবে জিএসটি-র পক্ষে। তৃণমূলের ইস্তাহারেই তা বলা ছিল। রাজ্যগুলির ক্ষতির বিষয়টি কেন্দ্রকে দেখতে হবে।” মমতার বক্তব্য সঙ্গে সঙ্গে জেটলিকে জানানো হয়। হাসি মুখে তিনি বলেন, “আমি খুশি যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। যথেষ্ট সুরাহা দেওয়া হচ্ছে রাজ্যগুলিকে।”
মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগেই দলের সাংসদদের জিএসটি নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। আজ তিনিই সুর নরম করে কেন্দ্রকে সহযোগিতার বার্তা দিলেন। তাঁর বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় সরকার অভিভাবক হলে রাজ্য সন্তানের মতো। রাজ্যের ক্ষতি করে জিএসটি চালু করা যাবে না। জিএসটি চালু করতে গিয়ে রাজ্যের যাতে আর্থিক ক্ষতি না হয়, কেন্দ্রকে সেটা দেখতে হবে।” মমতাকে আশ্বস্ত করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জেটলি জানিয়ে দিয়েছেন, জিএসটি চালুর পর কোনও রাজ্যের কর বাবদ আয় কমে গেলে কেন্দ্র তা মিটিয়ে দেবে। মমতা-অমিতের দাবি ছিল, মুখের কথা নয়। বিলে এই বিষয়টি রাখতে হবে। জেটলি জানিয়েছেন, তা-ই থাকছে।
মোদী সরকারের অবস্থান হল, সিবিআই তদন্ত নিয়ে মমতা যতই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দাগুন, রাজ্য রাজনীতিতে যতই বিজেপি-তৃণমূল সংঘাত থাক, উন্নয়নের প্রশ্নে রাজ্যকে বঞ্চিত করা হবে না। শুক্রবার বিকেলের ওই ঘটনাপ্রবাহ থেকেই স্পষ্ট, উন্নয়নের প্রশ্নে মোদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাইছেন মমতাও। তিনি নিজেও জানিয়েছেন, উন্নয়ন নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। তিনি সহযোগিতাই করতে চান। আজ জিএসটি নিয়েও সেই বার্তাই দিয়েছেন তিনি। জেটলিও সেই বার্তায় সদর্থক সাড়া দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
স্থির হয়েছিল, আগামী সোমবার বিলটি পেশ করা হবে সংসদে। কিন্তু নানা বিরোধিতায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা বিলটি নিয়ে একবার যখন রাজ্যগুলির সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছনো গিয়েছে, তার পরে আর একটুও দেরি করতে চাননি মোদী-জেটলিরা। নতুন কোনও বাধা আসার আগেই চাই আজ বিলটি পেশ করে দেন জেটলি। পরে তিনি বলেন, “১৯৪৭ সালের পর কর ব্যবস্থার সংস্কারে জিএসটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।” জিএসটি চালু হলে নানাবিধ করের বদলে একটিমাত্র কর চালু হবে। ইনস্পেক্টর-রাজের অবসান হবে। সংসদের বাজেট অধিবেশনে এই বিল পাশ করাতে তৎপর হবে কেন্দ্র।
জিএসটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আশঙ্কাটা ঠিক কী? মমতার বক্তব্য, জিএসটি চালু করায় রাজ্যের ক্ষতি হলে তা মিটিয়ে দিতে হবে। সব রাজ্যের মতামত নিতে হবে। কোনও রাজ্যের স্বার্থে যাতে ঘা না পড়ে, তা দেখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের কতটা ক্ষতি হবে? জবাবে মমতা বলেন, “আমি অর্থনীতি বুঝি না।” পরমুহূর্তে সাংবাদিকদের সামনেই নিজের মোবাইল থেকে অমিত মিত্রকে ফোন করেন। লাউডস্পিকারে রাখা সেই মোবাইল মারফত অমিত সকলকে জানান, জিএসটি চালু হলে প্রথম বছরে রাজ্যের ৮,২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে। জেটলি অবশ্য বলেছেন, “এ সবই অজানার আতঙ্ক। তা-ও আমরা ঠিক করেছি, প্রথম তিন বছর রাজ্যের ১০০ শতাংশ ক্ষতি কেন্দ্র মিটিয়ে দেবে। চতুর্থ বছরে ৭৫ ভাগ, পঞ্চম বছরে ক্ষতির ৫০ ভাগ পূরণ করে দেওয়া হবে। তা ছাড়াও রাজ্যের আয় বাড়াতে রাজ্যগুলি দু’বছর ধরে আন্তঃরাজ্য পণ্য রফতানির উপরে ১ শতাংশ হারে কর নিতে পারবে।”
পশ্চিমবঙ্গের আর একটি উদ্বেগের বিষয় ছিল, কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর বাবদ ক্ষতিপূরণ। পশ্চিমবঙ্গের মতে, জিএসটি চালুর জন্য বিক্রয় করের হার কমানোয় রাজ্যগুলির মোট ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাওনা হয়েছে। কিন্তু জেটলির বক্তব্য, ওটা আসলে ৩৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। তিন কিস্তিতে কেন্দ্র তা দিয়ে দেবে। চলতি অর্থবর্ষেই প্রথম কিস্তির ১১ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। যার ভাগ পাবে পশ্চিমবঙ্গও।
মমতার বক্তব্য, শুধু নিজের জন্য নয়, অন্য সব রাজ্যের হয়ে লড়ছে পশ্চিমবঙ্গ। তাঁর কথায়, “অন্য রাজ্যগুলি এতটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলছে না। কিন্তু কাউকে তো বেড়ালের গলায় ঘন্টি বাঁধতে হবে।” অর্থ মন্ত্রকের একটি সূত্র অবশ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বাকি সব রাজ্যই কার্যত জিএসটি-র পক্ষে সায় দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ একা বিরোধিতা চালিয়ে গেলেও লাভ হতো না। বরং স্পষ্ট হয়ে যেত, স্রেফ রাজনৈতিক কারণে জিএসটি-র বিরোধিতা করছে তারা। ভুল বার্তা যেত শিল্পমহলেও। জিএসটি নিয়ে মমতার সুর বদলের পরে জেটলিও বলেন, “শুধুই রাজনৈতিক কারণে কেউ জিএসটি-র বিরোধিতা করছে না। এটা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের সব থেকে ভাল দিক।”
পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যের দাবি মেনে জেটলি যেমন ক্ষতিপূরণের বকেয়া মেটাতে রাজি হয়েছেন, তেমনই পেট্রোপণ্য, অ্যালকোহল ও তামাককে জিএসটি-র বাইরে রাখতে রাজি হয়েছেন। তবে আপত্তি সত্ত্বেও ‘এন্ট্রি ট্যাক্স’ বা প্রবেশ করকে জিএসটি-র আওতায় আনা হয়েছে। এই প্রবেশ কর থেকে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা আয় করে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু পেট্রোপণ্যকে জিএসটি-র বাইরে রাখায় কংগ্রেস প্রশ্ন তুলছে, এমন আপস করে জিএসটি চালু করলে কি অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে? জেটলির বক্তব্য, “এই মুহূর্তে এটাই জিএসটি-র সব থেকে ভাল চেহারা। পেট্রোপণ্য আপাতত বাইরে থাকলেও সাংবিধানিক ভাবে তা জিএসটি-র আওতায় চলে আসছে। শুধু কবে থেকে সেটি চালু হবে, তা পরে কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে ঠিক করবে।”
যার অর্থ, বিলটি পেশ করা গেলেও সব বিরোধিতা বা প্রশ্ন এখনও মিটিয়ে ফেলা যায়নি। বিজেপি তাই রাজনৈতিক ভাবে জিএসটি নিয়ে প্রচারের চাপটা রেখে যাবে। দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি রাহুল সিংহের এ দিনের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। ৭ জানুয়ারি কলকাতায় বিশ্ব বাংলা সম্মেলন শুরু হচ্ছে। মমতার আমন্ত্রণে উদ্বোধনের দিনেই জেটলির সেখানে যাওয়ার কথা। রাহুল সিংহ জানান, সে দিনই শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে জেটলি বক্তৃতা করবেন। রাহুল বলেন, “জিএসটি নিয়ে আগে আপত্তি ছিল না তৃণমূলের। এখন আপত্তি করছে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের বেকায়দায় ফেলতে। এটা দ্বিচারিতা।”
দিনের শেষে দেখা গেল জিএসটি প্রশ্নে আপাতত সেই ‘দ্বিচারিতা’ থেকে সরে আসারই বার্তা দিলেন মমতা। যে কারণে ‘আশা করি, ওঁদের সুবুদ্ধি হবে’ বলার কিছু পরেই জেটলি হাসিমুখে জানিয়েছেন তিনি খুশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy