খড়-বিচালির টাকা দুর্নীতির ছোঁয়ায় সোনায় রূপান্তরিত হয়েছিল। সেই সোনাই আবার টাকা হয়ে ফিরছে ঝাড়খণ্ডের কোষাগারে।
অবিভক্ত বিহারের কুখ্যাত পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির বহর কতটা ছিল, তা নিয়ে নানা মহলে নানা মত। তবে সরকারি সূত্রের ইঙ্গিত, বর্তমান বিহার ও ঝাড়খণ্ড--- দুই রাজ্যের বিভিন্ন ট্রেজারির হিসেব মিলিয়ে অঙ্কটা হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। তদন্তকারী সিবিআইয়ের তৎপরতায় এ বার লুঠ হয়ে যাওয়া ওই সরকারি অর্থের সামান্য অংশ ঝাড়খণ্ড ফেরত পেতে চলেছে। কী ভাবে, আজ রাঁচির সিবিআই আদালতে এক কথায় তা বর্ণনা করতে গিয়ে তদন্তকারীরা বলেন, “টাকা-সোনা, সোনা-টাকা।”
সিবিআই-সূত্রের খবর: পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির কালো টাকা কোথায় রাখা যায়, তা খুঁজতে খুঁজতে কিছু লুঠেরা হাতের কাছে পেয়ে গিয়েছিল অভাবিত সুযোগ কেন্দ্রীয় সরকার তথা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘গোল্ড বন্ড’ স্কিম। এরই দৌলতে কালো টাকার একটা অংশ রাতারাতি সোনায় পরিণত করা হয়েছিল, যার কিছুটা এখন টাকা হয়ে সরকারের ঘরে ঢুকতে চলেছে।
ব্যাপারটা কী রকম? বুঝতে হলে তখনকার অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখা দরকার। ১৯৯০-এ দেশের বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ার তলানিতে এসে ঠেকলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখর রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সোনার একাংশ বিদেশের ব্যাঙ্কে বন্ধক রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে। হইচই পড়ে যায়। সংসদে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। চন্দ্র-জমানা অবশ্য চার মাসের বেশি টেকেনি। ১৯৯১-এর ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন পিভি নরসিংহ রাও, বেহাল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যিনি অর্থমন্ত্রী করে নিয়ে আসেন মনমোহন সিংহকে। শুরু হয়ে যায় ভারতীয় অর্থনীতির সংস্কার পর্ব।
আর তারই অঙ্গ হিসেবে ১৯৯৩-এ ‘গোল্ড বন্ড স্কিম’-এর আবির্ভাব। জাতীয় স্বর্ণ সঞ্চয় বাড়াতে অর্থ মন্ত্রকের অনুমোদনক্রমে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চালু করা প্রকল্পটির বৈশিষ্ট ছিল, বন্ড কেনার জন্য জমা দেওয়া সোনার বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না। অর্থাৎ সোনা হলেই হল, তা কালো না ভাল, সে বাছ-বিচারের বালাই থাকবে না। “কার্যত বেআইনি সোনা মজুতকারীদের ‘কালো’ সোনাকে সাদা টাকায় বদলে নেওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিল সরকার।” মন্তব্য এক অফিসারের।
গোল্ড বন্ড স্কিমে বিনিয়োগ করলে সোনার উৎস নিয়ে খোঁচাখুচি হবে না এটা জেনে পশুখাদ্য-দুর্নীতির কুশীলবেরা হাতে চাঁদ পেয়ে যায়। সিবিআই জানতে পেরেছে, রাঁচি থেকে বস্তা বস্তা কালো টাকা নিয়ে লুঠেরার দল কলকাতায় হাজির হয়েছিল। সেখানে দু’শো কিলোগ্রাম (দু’কুইন্টাল) সোনা কেনা হয়, যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা রেখে নেওয়া হয় পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ড। লুঠেরাদের আশা ছিল, ১৯৯৮-এ বন্ড ভাঙিয়ে তারা সাদা টাকা পাবে। কারও সন্দেহ জাগবে না।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি প্রথম সামনে এলে দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সিবিআই তদন্তে নামে, বিহার-রাজনীতিতে টালমাটাল শুরু হয়। অবিভক্ত বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব গ্রেফতার হন, তাঁকে কুর্সি ছাড়তে হয়। লালু মুখ্যমন্ত্রী পদে বসান স্ত্রী রাবড়ীদেবীকে। এমতাবস্থায় প্রবল রাজনৈতিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের রক্ষাকবচ নিয়ে সিবিআই তদন্ত চালিয়ে গিয়েছে।
এবং ক্রমে উদ্ঘাটিত হয়েছে নেপথ্যের হরেক নায়কের হরেক ভূমিকা। ফাঁস হয়েছে স্বর্ণ-রহস্যও। সিবিআই-সূত্রের খবর, পশুখাদ্য-তদন্তে রাঁচির একটা মামলাতেই ১৬০ কিলো সোনার হদিস মিলেছে। এক রাজসাক্ষীর দেওয়া তথ্যে বিষয়টা প্রথম নজরে আসে। জানা যায়, কারা কী ভাবে লুঠের টাকায় সোনা কিনেছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে হুঁশিয়ার করে। নির্দিষ্ট গোল্ড বন্ডগুলো যাতে মেয়াদপূর্তিতে ভাঙানো না যায়, তার ব্যবস্থা হয়।
সেই ইস্তক ওই দু’কুইন্টাল সোনা রিজার্ভ ব্যাঙ্কে পড়ে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে হওয়া পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির সিবিআই-তদন্ত রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েছে, তা-ও প্রায় এক যুগ পার। অবশেষে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ‘কালো’ সোনার ৩৯ কেজির টাকা ঝাড়খণ্ড সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য আজ সিবিআই আর্জি জানায় আদালতে। রাঁচির সিবিআই কোর্টের বিচারক ওয়াই মণি তা মঞ্জুর করেছেন।
ফলে আগামী ক’দিনের মধ্যে এ বাবদ প্রায় ১০ কোটি টাকা রাজ্য সরকারি তহবিলে জমা পড়বে বলে সিবিআই-সূত্রে জানানো হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়া যাঁর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল, সিবিআইয়ের সেই তৎকালীন যুগ্ম-অধিকর্তা, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মমতা মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য উপেন বিশ্বাসের কথায়, “চুরি যাওয়া সরকারি টাকার একটি অংশ কোষাগারে ফেরত আসা নজিরবিহীন।” তাঁর মতে, দেশের ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে পশুখাদ্য-পর্ব দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। “কারণ এতে কোনও অভিযুক্ত ছাড় পায়নি। কোথাও প্রমাণের অভাবে সিবিআই’কে পিছু হটতে হয়নি।” মন্তব্য উপেনবাবুর।
দু’কুইন্টালের মধ্যে মাত্র ৩৯ কেজি সোনার গতি হচ্ছে! বাকি ১৬১ কিলোগ্রাম? সিবিআই-সূত্রের খবর: বাকি সোনার টাকাও যাতে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের (বিহার বা ঝাড়খণ্ড) কোষাগারে জমা পড়ে, সে প্রক্রিয়া শীঘ্র শুরু হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy