রাস্তায় নেমে এল যাদবকুলের অন্দরমহলের কেচ্ছা। সর্বসমক্ষে মাইক ফুঁকে শিবপাল যাদব কখনও বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যা বলছেন।’’ আবার কখনও রুদ্ধ কণ্ঠে মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ প্রকাশ্যে বললেন, অমর সিংহ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এক সময় মাইক নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল শিবপাল আর অখিলেশের মধ্যে। তুমুল বিতণ্ডায় জড়ালেন মঞ্চে থাকা নেতারা। সামলাতে না পেরে বৈঠকের মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন ‘নেতাজি’।
উত্তরপ্রদেশে সপার সব বিধায়ক, সাংসদ এবং মন্ত্রীর ডাক পড়েছিল এ দিনের বৈঠকে। মুলায়মের লক্ষ্য ছিল, হেস্তনেস্ত করে ফেলা। কিন্তু শিবপাল আর অখিলেশ যে আরও চড়া মেজাজে পরস্পরের মধ্যে হেস্তনেস্ত করে ফেলার অপেক্ষায় ছিলেন, তা সম্ভবত আঁচ করতে পারেননি সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমো। মুলায়ম ভেবেছিলেন, বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি এবং তাঁর ধমক বদলে দেবে পরিস্থিতি, ঠান্ডা হয়ে আসবে অন্দরমহলের আগুন। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ও বোধ হয় আঁচ করতে পারেননি, পরিস্থিতি আর হাতের মধ্যে নেই। তাই অখিলেশ যাদব ভাষণ শুরু করতেই শিবপাল-অমরদের বিরুদ্ধে স্লোগান শুরু করে দিলেন দলের বিধায়কদের একাংশ। মুলায়মের উপস্থিতিতেই সপা বিধায়করা অখিলেশের সুরে সুর মিলিয়ে মুলায়ম ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে স্লোগান শুরু করবেন, সপায় এ যাবৎ অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচিত ‘নেতাজি’ তেমনটা একেবারেই আশা করেননি। অখিলেশ সরাসরি এবং সর্বসমক্ষে অমর সিংহের বিরুদ্ধে আঙুল তোলেন। মুলায়মের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘অমর সিংহের টুইটার অ্যাকাউন্ট দেখে নিন। তিনি টুইট করে জানিয়েছিলেন, অক্টোবরে উত্তরপ্রদেশে বড় বদল হতে চলেছে। দিল্লিতে খোঁজ নিন, আপনার অনেক যোগাযোগ। সেখানে সবাই জানেন এ কথা। অমর সিংহ টুইট করেছেন, নভেম্বরে উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী বদল হতে চলেছে।’’ আবেগপ্রবণ অখিলেশ মুলায়মের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘‘আপনার দল, আপনি চাইলে আমাকে সরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে আমি প্রশ্ন তুলবই।’’
মুলায়ম ভাষণ দিতে উঠে দৃশ্যতই ছেলেকে ধমক দিতে শুরু করেন। অত্যন্ত কঠোর শব্দ প্রয়োগ করে তিনি বলেন, ‘‘পদ পেয়ে তোমার মাথা ঘুরে গিয়েছে।’’ শিবপাল এবং অমর সিংহকে কোনও ভাবেই তিনি দূরে সরিয়ে দেবেন না, পুত্র তথা মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশকে সাফ জানিয়ে দেন মুলায়ম। নিজের ভাষণের সময় মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশের প্রাপ্য মান-সম্মানেরও খেয়াল রাখেননি মুলায়ম। তিনি বলেন, ‘‘অমর সিংহকে গালি দিচ্ছ? অমর সিংহ আমাকে জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। উনি না থাকলে আমি আজ জেলে থাকতাম। অমর সিংহ আমার ভাই। কী যোগ্যতা রয়েছে তোমার?’’
অখিলেশ যাদব মুলায়মের কথার কোনও প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু নিজের মান-সম্মানের প্রশ্নে যে তিনি কোনও আপস করবেন না, তা দলের সাংসদ-বিধায়কদের সামনেই বাবাকে বুঝিয়ে দেন ছেলে। মুলায়ম যখন অখিলেশকে নির্দেশ দেন, শিবপালকে আলিঙ্গন করতে। মুলায়ম বলেন, ‘‘শিবপালকে আলিঙ্গন কর, উনি তোমার কাকা হন।’’ শিবপাল যাদবও এ দিন অখিলেশকে সর্বসমক্ষে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেননি। অখিলেশের নাম না করে, তাঁর সঙ্গে অমর সিংহের তুলনা টানেন শিবপাল। বলেন, ‘‘তোমরা কেউ অমর সিংহের পায়ের ধুলোর যোগ্যও নও।’’ অখিলেশ সপা ভেঙে নতুন দল গঠন করবেন বলেছিলেন বলেও শিবপাল যাদব অভিযোগ করেন। অখিলেশকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরানোর দাবিও সর্বসমক্ষেই তোলেন শিবপাল। মুলায়মকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
আরও পড়ুন: দু’পক্ষকে আপ্রাণ মেলানোর চেষ্টা মুলায়মের, শেষরক্ষা হল কি
অখিলেশ আবার শিবপালের তোলা অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘‘নতুন দল তৈরি হবে বলে শুনছি। কে তৈরি করবে আমি তো করব না।’’ তাঁর নামে অমর সিংহ মিথ্যা খবর রটিয়েছেন বলেও অখিলেশ অভিযোগ করেন। এর পরেই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে যায় সপা শীর্ষ নেতৃত্বের নাটক। শিবপাল যাদব আচমকা উঠে এসে অখিলেশের হাত থেকে মাইক কেড়ে নেন। তিনি অখিলেশকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দেন। শিবপাল বলেন, ‘‘অখিলেশ নিজে আমাকে বলেছিলেন, তিনি নতুন দল গড়বেন।’’ নিজের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে শিবপাল গঙ্গাজলের নামে শপথ করেন।
অখিলেশ এবং শিবপালের অনুগামীদের মধ্যে এর পর তুমুল বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়, মঞ্চের উত্তেজনা নীচেও ছড়িয়ে পড়ে। বিরক্ত এবং দিশাহারা মুলায়ম সিংহ যাদব বৈঠক ছেড়ে চলে যান।
তবে অখিলেশের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধেই কিন্তু সীমাবদ্ধ থাকেননি শিবপাল যাদব। দলের যে বিধায়করা মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও কলহে জড়িয়েছেন মুলায়মের এই ভাই। অখিলেশের হাত থেকে মাইক ছিনিয়ে নিয়ে শিবপাল যখন বলছিলেন, কী ভাবে তিনি দলের জন্য খেটেছেন, সপার জনভিত্তি ধরে রাখতে কী ভাবে দিন-রাত এক করে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন, তখনই কটাক্ষ ছুটে আসে মঞ্চের সামনে থেকে। এক অখিলেশ-পন্থী নেতা শিবপালকে বলেন, অখিলেশ সরকার তাঁকে হেলিকপ্টার দিয়েছিল, তাই তিনি জেলায় জেলায় ঘুরতে পেরেছিলেন। এই কথা শুনেই মেজাজ আরও হারান শিবপাল। ওই নেতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘হেলিকপ্টারটা কি তোমার বাবার ছিল? আমি সরকারের মন্ত্রী ছিলাম।’’ শিবপাল বোঝাতে চান, তিনি মন্ত্রী ছিলেন বলেই সরকারি কপ্টার পেয়েছেন, এতে অখিলেশের কোনও অবদান নেই। কিন্তু তত ক্ষণে তুমুল বিশৃঙ্খলা মঞ্চে এবং মঞ্চের নীচে। মুলায়মও চলে গিয়েছেন বৈঠক ছেড়ে। ফলে সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই আচমকা শেষ হয়ে গিয়েছে বৈঠক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy