অনেকে পরিবার ছাড়খাড় হয়ে গিয়েছে নোটবন্দির পর। প্রতীকী ছবি।
সামনেই ছিল ছোট মেয়ের বিয়ে। সে জন্য টাকা প্রয়োজন। অথচ এটিএম থেকে তখন দিনে দু’হাজারের বেশি টাকা তোলা যাচ্ছে না। তা-ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল। তাই বার বার ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা পাননি হাওড়ার উলুবেড়িয়ার বাসুদেবপুরের সনৎ বাগ। ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা শেষ হয় বছর পঞ্চান্নর সনতের। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যের মৃত্যু কার্যত পথে বসিয়েছে তাঁর স্ত্রী কল্পনাকে। স্বামীর মৃত্যুর পরে ধার-দেনা করে কোনওক্রমে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তবে মানসিক ভারসাম্যহীন দুই ছেলের চিকিৎসা আর সংসার টানতে ভিক্ষাই অবলম্বন।
সোমবার তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, জল-মুড়ি খাচ্ছেন কল্পনা। এ দিনই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নোটবন্দি বৈধ ছিল। শুধু পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের এক জন বিচারপতি এই রায়ের বিরোধিতা করেছেন। কল্পনা বলেন, ‘‘আমি অতশত বুঝি না। শুধু এটুকু জানি, ওই ঘোষণার পরে আমার সংসারটা শেষ হয়ে গিয়েছে।’’
প্রকারান্তরে একই বক্তব্য বেহালার কল্লোল রায়চৌধুরী, কোচবিহারের দিনহাটার ধরণীকান্ত ভৌমিক বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভীষ্মদেব নস্করের পরিবারের। এঁরা সকলেই ওই সময়ে ব্যাঙ্ক বা এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা যান। কোচবিহার থেকে বেহালার আদর্শনগরের বাড়িতে ফিরছিলেন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কর্মী কল্লোল। হুগলির ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে স্থানীয় একটি এটিএমে লাইন দেন। এক সময়ে পড়ে যান। অভিযোগ, অনেক ক্ষণ কেউ ফিরে তাকায়নি। পরে চুঁচুড়া ইমামবড়া হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাঁর স্ত্রী সীমা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎপরতায় স্বামীর চাকরি পান। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে সোমবার সীমা বলেন, ‘‘হাজার হাজার লোককে যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, সেটার কী হবে? রাজনীতিতে না গিয়েই একটা প্রশ্ন করছি, আমাদের যা গিয়েছে, তা কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবেন?’’
কোচবিহারের দিনহাটা শহরের সাতকুড়ার ধরণীকান্ত ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। দিনহাটার এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা তোলার লাইনে অসুস্থ হয়ে পড়েন ৫৬ বছরের ধরণীকান্ত। পরে মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, একমাত্র রোজগেরের মৃত্যুর পরে গত ছ’বছরে কেউ তাঁদের খোঁজ রাখেনি। সম্প্রতি ধরণীকান্তের ছেলে শৈবাল জুনিয়র হাই স্কুলে করণিকের চাকরি পেয়েছেন। ধরণীকান্তের মেয়ে শ্রাবণী বলেন, ‘‘নোটবন্দির জেরে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, সে সব পরিবারের পাশে কেন্দ্রীয় সরকার দাঁড়ালে অনেক উপকার হত।’’
ব্যাঙ্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মত্যু হয়েছিল রায়দিঘির ভীষ্মদেব নস্করেরও (৭৬)। এ দিন ভীষ্মদেবের ছেলে পঙ্কজ বলেন, “নোটবন্দির ফল কতটা ভয়ঙ্কর, সেটা আমরা বুঝেছি।’’
সনৎ বাগের স্ত্রী কল্পনা জানান, রাজ্য সরকারের থেকে দু’লক্ষ টাকা ও পঞ্চায়েত থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকল্পে ঘর করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাশে থাকার আরও অনেক প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবে দেখা যায়নি বলেই তাঁর দাবি। তিনি বলেন, ‘‘এখন দুই ছেলে নিয়ে কী ভাবে দিন কাটে, কেউ জানতে চায় না। ছেলেদের প্রতিবন্ধী ভাতা মেলে না। বার্ধক্য ভাতার ওই হাজার টাকায় সংসার চলে? তাই ভিক্ষে করে কোনওক্রমে সংসার চালাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy