Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ইন্দিরার চারপাশে এখনও সেই নির্লজ্জ স্তাবকদেরই ভিড়

বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চরণ সিং ইন্দিরার আদত দুশমন বলে সর্বজন বিদিত! কিন্তু তিনিও ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে একটি বিষয়ে একমত – লোকে ইন্দিরাকে দেখতে ভিড় করেছে।

মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে সাধরণ মানুষের মধ্যে মিশে যেতেন শ্রীমতি গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে সাধরণ মানুষের মধ্যে মিশে যেতেন শ্রীমতি গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

রণজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৭ ২০:০১
Share: Save:

‘ লোকে কেন আগ্রা যায়?’- এই প্রশ্নটি আজ ইন্দিরা গান্ধীকে করলে নিশ্চয় তিনি জবাব দেবেন-‘ কেন দুর্গ ও তাজ দেখতে’। তেমনি যদি পাল্টা প্রশ্ন করা যায় দিল্লির সবচেয়ে দর্শনীয় বস্তুটি আজ কি- তাহলে নির্দ্বিধায় যে দুটি নাম উনিই করবেন তা হল- ‘কুতুব মিনার ও ইন্দিরা গান্ধী’। পাগল না মাথা খারাপ- সে আপনি মনে মনে ভদ্রমহিলা সম্পর্কে যে ধারণাই পোষণ করুন না কেন, তাতে শ্রীমতী গান্ধীর কিছুই আসে যায় না। এক কথায় নিজের সম্পর্কে উনি আজকাল যা বলে বেড়াচ্ছেন তা দেবকান্ত বরুয়ার ১৯৭৫এর সেই বিখ্যাত-‘ ইন্দিরাই ভারত,ভারতই ইন্দিরা’- উক্তির ই সামান্য হেরফের মাত্র।আদতেওই উক্তিটি বরুয়াজীর নিজস্ব কোন সৃষ্টি নয়। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে গোটা জরমনি যে শ্লোগানে গমগম করত সেই বিখ্যাত শ্লোগান- ‘ হিটলারই জরমনি এবং জরমনিই হিটলারে’র একটি চোরাই সংস্করণ মাত্র।

বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চরণ সিং ইন্দিরার আদত দুশমন বলে সর্বজন বিদিত! কিন্তু তিনিও ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে একটি বিষয়ে একমত – লোকে ইন্দিরাকে দেখতে ভিড় করেছে। কেন করেছে তার জবাবে সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেনঃ স্বৈরাচারীর বেদীচ্যুত ওই মহিলার বর্তমান ‘সকলটি’ চাক্ষুষ করবার জন্যই ওই ভিড়।

পূর্ণ এগারো বছর এদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বৃহৎ পুঁজি ও জোতদারদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এবং খেটে খাওয়া মানুষজনকে ছিবড়ে বানানোর জন্য কি অমানুষিক পরিশ্রমটাই না উনি করেছেন! চক্রবৃদ্ধিহারে দুর্নীতির অগ্রগতি এবং প্রশাসনের সর্বস্তরের অক্টোপাসের দাঁড়ার মত তার ক্রমবিস্তার ওই আমলের নিশ্চয় অন্যতম অবদান। কালোটাকার পাহাড় গজানো তাও ওই আমলে? ( মনে পড়ে তেষট্টি সালে এ আই সি সি’র জয়পুর অধিবেশনে ওয়ারকিং কমিটির জনৈক সদস্যা বলেছিলেন, গোটা দেশে তিন হাজার কোটি কালো টাকা নাকি সাদা টাকার সমান্তরাল একটি অর্থনীতি চালাচ্ছে। আর সম্প্রতি শ্রীমতিজীর ভক্ত –চেলা সংসদ সদস্য বসন্ত সাঠে বলেছেন, গত বছর পর্যন্ত বিশ হাজার কোটি কালো টাকা সারা দেশে চালু ছিল।)

এক সভায় ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শ্রীমতিজীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনতিবিলম্বেই দেখা গেল কংগ্রেস যা বলে তার উলটোটা করায় রীতিমত দক্ষ হয়ে উঠেছে। সে আমলে আমূল পরিবর্তনকামী শক্তিগুলিকে খুব একটা বাধা না দিয়েই বরং কংগ্রেস চেয়েছিল গণতান্ত্রিক একটা মুখোশ বজায় রাখতে। সেই মুখোশ টিও ছিঁড়ে ফেলে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে ফ্যাসিস্ট কায়দায় একনায়কত্বের বুনিয়াদের উপর মধ্যযুগীয় রাজবংশের কাঠামো গড়ে তোলার কাজটুকু সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন শ্রীমতী গান্ধী। এ যেন ঠিক বেনিটো মুসোলিনির ধড়ে নেপোলিয়ান বোনাপারটের মুড়োটি বসিয়ে দেওয়া । কিন্তু সে কায়দা খাটলো না, শ্রীমতীজীকে পস্তাতে হল। এখন উনি পাগলের মত চেষ্টা করছেন অসম্মানের চোরাবালি থেকে আত্মোদ্ধারের জন্য যা কিনা চরণ সিং তার জন্য সযত্নে গড়ে তুলেছেন। এত করেও শাস্তি উনি এড়াতে পারবেন না।

পঁচাত্তরের জুনের সেই বিশেষ সকালেই ওঁর স্বৈরাচারী সম্ভাবনার পুষ্পটি হঠাৎ বিকশিত হয়নি।যেদিন উনি প্রধানমন্ত্রী হন সেই দিন থেকে তিল তিল্ করে ঐ সম্ভাবনার দিকেই এগোচ্ছিলেন। সেই সব কংগ্রেসি নেতারাই হলেই তারপ্রথম শিকার যারা তাঁকে গদিতে বসিয়েছিলেন।তারপর খোদ কংগ্রেসই ওঁর হাতে প্রতারিত হল- দিলেন দল্টিকে দুটক রো করে। ওঁর নিজের কংগ্রেস গণতন্ত্রের শিখাটিকে এক ফুঁয়ে দিলেন নিভিয়ে ।

সেই সঙ্গে অকংগ্রেসি দল গুলিকে চূর্ণ করার কাজে উনি হাত পাকাতে লাগলেন। বিশেষ করে বামপন্থী কর্মধারায় বিশ্বাসী সরকার ও দলগুলির চূড়ান্ত হেনস্থা শুরু হল। আর এই উদ্দেশ্যে সরকারি সম্পদ অব্যাহত ধারায় ব্যয় হতে লাগল ।

যেখানে টাকায় কাজ হত না, সেখানে সশস্ত্র গোয়েন্দা এবং পুলিশ বাহিনী এবং ‘ প্রতিরোধ বাহিনী’ নেমে পড়ত কাজে। সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হত্যাতো নিত্য- নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সর্বোচ্চ পর্যায়ে নীতি হিসাবে এই হত্যায় রাজনীতি গৃহীত না হলে কি বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন রাজ্যে খুন খারাপি অনুষ্ঠিত হতে পারত ?

যে রাজত্ব উনি গড়ে তুলেছিলেন তাতে ন্যায় নীতির কোন স্থান ছিল না। নৈতিক মান বলে কিছু আর অবশিষ্ট রাখা যায়নি। বিশেষ করে কংগ্রেসের ভেতর। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের জায়গীরদার ও মনসবদাররা যেনতেন প্রকারণে ‘লুঠি তো ভান্ডার’ মোহে আছন্ন হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সরকারী প্রশাসনে ও দলের ভেতর ইন্দিরা নীতির ইনফেকশন শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় ফোঁড়ার আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে অনেকাংশেই ওই রোগ থেকে মুক্ত ছিল।

একগাদা জীপ বে-আইনি ভাবে নিয়ম কানন তুড়ে দিয়ে বরাদ্দ করা এবং তার জন্য কয়েকজন ব্যাবসায়ীকে টাকা দিতে বাধ্য করার অভিযোগে শ্রীমতী গান্ধীকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল গত লোকসভা নির্বাচনের দিন কয়েক আগে। জড়িত টাকার অঙ্ক লাখ চল্লিশেক। এখন আদালতই স্থির করবেন তাকে ধরাটা যথাযথ হয়েছে কিনা বা এই অভিযোগে তার জেল হওয়া বাঞ্ছনীয় কিনা।

আদালত যে আদালতের কাজ করবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই নিয়ে কংগ্রেসিদের ঘোঁট পাকানোটা রীতিমত দর্শনীয়। কংগ্রেসিদের মতে চরণ সিং অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে ইন্দিরাকে গ্রেফতার করিয়েছেন। সেই সব কংরেসীরা যারা এখনো মাতাজীর নাম উচ্চারণ না করে জলস্পর্শ পর্যন্ত করেন না, তাঁরা কি বলতেচান যে শত শত কোটি টাকার কেলেঙ্কারী নাহলে সরকার ওই ভদ্রমহিলা কে ধরতে পারবেন না? কারণ কি এই , যে একদা তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন? হ্যাঁ, এটা অনস্বীকার্য বাছাই করা কয়েকজন শিল্পপতির ভাঁড়ার থেকে কংগ্রেস দল ও ওই দলের চূড়ামণিদের কাছে ব্যক্তিগত ভাবে যে বিপুল অর্থ নির্বাধে প্রবাহিত হয়েছে তার তুলনায় ওই চল্লিশ লক্ষ টাকা ভাসমান শিলার অগ্রভাগের অতিরিক্ত নয়। ইন্দিরা সমর্থক কংগ্রেসিরা তাদের নেত্রীর হয়ে যে সাফাই গাইছেন তার নির্গলিতার্থ হল সব দলই ব্যাবসায়িদের কাছ থেকে টাকা নেয়। অন্যান্য দলের পক্ষে তা সত্যই হোক আর মিথাই হোক, কংগ্রেস যে বিপুলপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে এটা ধ্রুব সত্য।শুধু প্রশ্ন হল শ্রীমতী গান্ধীর রাজত্বের শেষ বছর গুলিতে কংগ্রেসি ভাঁড়ারে কি হারে টাকা ঢুকেছে – কোটি কোটি না শত কোটির অঙ্কে?

কংগ্রেসের তুলনায় অন্যান্য দলগুলি যা পেয়েছ তা খুদ কুঁড়োর মত। টাকাআদায়ের পদ্ধতি- প্রকরণে কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের পার্থক্য রীতিমত মৌলিক। ক্ষমতাসীন ছিল বলেই পারমিট ও লাইসেন্সের হরির লুটের পদ্ধতি ও প্রথা কংগ্রেস এক এক সময় এক এক দল ব্যাবসায়ীর স্বার্থ মোচড়াতো। একাত্তর সাল ইস্তক এটাই ছিল প্রশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ওই পদ্ধতিতে লুণ্ঠিত অর্থের একাংশ ব্যবসায়ীদের তোষাখানা থেকে কংগ্রেসি ভাঁড়ারে নিঃশব্দে প্রবেশ করত। ইন্দিরা রাজত্বে মন্ত্রীপদ গুলি অকারণে বাঁটোয়ারা করা হত না- ওই সব মন্ত্রীদের কাজই ছিল চাঁদা তোলা। এর ভেতর দিয়ে কোন কোন মান্যবর ব্যক্তিগত ভাগ্যো ফিরিয়ে নিয়েছেন। ইন্দিরার মুক্তি নিয়ে কংরেসীরা বেজায় শোরগোল করছেন। রাজনৈতিক দিক থেকে চরণ সিং এরেই কাজটা আদৌ সময়োচিত হয়নি। জনতা পার্টির এক বর্ষীয়ান নেতার মতে স্রেফ মুর্খামি। আপাতভবে চরণ সিং ভেবেছিলেন রাজনীতির ঘাটলা পেরিয়ে আইনের দরিয়ায় অক্লেশে নাও ভাসাতে পারেন। কিন্তু প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে সে দাওয়াই প্রয়োগ করা হোক তা যে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে পর্যবসিত হবে এই সরল সত্যটুকু চরণ সিং এর মাথায় ঢোকেনি । আইনগত কাজিয়ার প্রথম দফায় সরকার হেরে ভূত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই মামলার সেটাই শেষ কথা নয়।

ইন্দিরাকে গ্রেফতার করার দিন পর্যন্ত শাহ কমিশনের মাত্র চারটি বৈঠক বসেছিল। ওই চার দিনেই ইন্দিরা রাজত্বে প্রশাসনের চেহারা যে কি বীভৎস হয়ে উঠেছিল, তার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য ফাঁস করেছিলেন প্রাক্তন আমাত্য ও আমলার দল। ওই চারটিদিনেই কংগ্রেসিদের হাতে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল। আরো স্বীকারোক্তি ছিল প্রকাশোন্মুখ। কিন্তু ওই গ্রেফতারের সুযোগ নিয়ে ইন্দিরা সরকার ও কংগ্রেসের ভেতর তার শত্রুদের রীতিমত বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন – তবে জনতা সরকারের বক্তব্য ওই বেকায়দা নেহাতই সাময়িক।

শ্রীমতী গান্ধী শেখেন নি কিছু বা ভোলেন নি কিছু। সেই সব শুম্ভ-নিশুম্ভ, একদা যারা তার নামে সরকার চালাত তারাই এখন তাঁর উপদেষ্টা ও বন্ধু-সেই সঞ্জয়, সেই বংশীলাল, সেই যশপাল কপূর, সেই আর কে ধাওয়ান এবং সেই ধীরেন্দ্র ব্রম্ভচারী। সেই পুরনো হিটলারী ঝটিকা বাহিনী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে দিবারাত্র ভিড় জমাচ্ছে। জরুরী অবস্থার দুবছরে এই সব নন্দী- ভৃঙ্গি যা উশুল করেছিল তার অতিরিক্ত কিছুকি এরা আদায় করতে পারবে? –কিংগ্রেসিদের মুখে মুখে আজ এই একটাই প্রশ্ন সরব হয়ে উঠেছে।

[আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ অক্টোবর ১৯৭৭ থেকে সংগৃহীত]

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE