ফাইল চিত্র।
‘সহানুভূতি’ মিলল। সুরাহা মিলল না।
বাজেট বক্তৃতার প্রথম বাক্যেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন করোনা-কালে স্বাস্থ্য ও রুটিরুজির দিক থেকে মার খাওয়া মানুষের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার পরে দেড় ঘণ্টার বাজেট-বক্তৃতায় সেই সমস্ত দুর্দশাগ্রস্ত গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জন্য কোনও সুরাহা সে ভাবে ঘোষণা করলেন না তিনি!
অর্থনীতিবিদ থেকে বিরোধী শিবির— অনেকের দাবি সত্ত্বেও, কোভিডের তৃতীয় বছরেও আমজনতা, বিশেষত দরিদ্রদের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার পথে হাঁটল না মোদী সরকার। উল্টে আমজনতার আশু সমস্যা নিয়ে বাজেটে বেশি শব্দ ব্যয় না করে ২০৪৭ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষের দিকে তাকিয়ে আগামী ২৫ বছরের ‘অমৃতকাল’-এর রূপরেখা নিয়েই বেশি চর্চা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
দেশের অর্থনীতি করোনার গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের সঙ্গেও লড়াই চলছে এখনও। আদতে কোভিডের আগের বছরে, শ্লথ বৃদ্ধির অর্থনীতিতে জিডিপি যে জায়গায় ছিল, অতিমারির দু’বছর পরে জিডিপি তার থেকে সামান্য এগিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আজ নির্মলা বাজেটে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াকে স্থায়ী করতে এবং বৃদ্ধিকে চাঙ্গা করতে চেয়েছেন। পরিকাঠামোয় বিপুল খরচ বাড়ানোকে হাতিয়ার করেছেন।
গত বাজেটে মোদী সরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পরিকাঠামোয় ৫.৫৪ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। সেখান থেকে ৩৫.৪ শতাংশ খরচ বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবর্ষে (২০২২-২৩) পরিকাঠামো বা স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে ৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা খরচের কথা ঘোষণা করেছেন। সবটাই সরকারের ঘর থেকে খরচ হবে, এমন নয়। এর মধ্যে এক লক্ষ কোটি টাকা রাজ্যগুলিকে বিনা সুদে ৫০ বছরের জন্য ঋণ দেওয়া হবে। সরকারের দাবি, বাস্তবে পরিকাঠামো খাতে আরও বেশি অর্থ (১০.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা) খরচ হবে। তবে তার মধ্যে পরিকাঠামোয় খরচের জন্য অনুদান, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে সম্পদ তৈরির খরচও ধরা হয়েছে। বিরোধীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক সময়ে ১০০ দিনের কাজকে গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প বলেছিলেন। এখন সেই খরচকে পরিকাঠামো তৈরির খরচ হিসাবে ধরা হচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে বাজেট পেশ করতে গিয়েও অর্থমন্ত্রী বড় কোনও ঘোষণার পথে হাঁটেননি। রাজকোষে টানাটানির মধ্যে মধ্যবিত্তকে খুশি করতে আয়করে ছাড় দেননি। তেমনই আর্থিক সংস্কারের পথেও যাননি। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নীলেশ শাহের বক্তব্য, এটি ‘নো সারপ্রাইজ, নো শক’ বাজেট। কোনও চমকও নেই। কোনও ধাক্কাও নেই। কেন্দ্রের প্রাক্তন সচিব অনিল স্বরূপের মতে, এই বাজেট বাস্তবসম্মত। কারণ, এতে চাষিদের আয় দ্বিগুণ করা, ১০ কোটি কর্মসংস্থান, পাঁচ বছরে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির কথা নেই। সেই জন্য অর্থমন্ত্রীর সাধুবাদ প্রাপ্য। তবে অনেকের মতে, সাধারণত ভোটের মুখে বাজেটে অর্থমন্ত্রী দরিদ্রদের জন্য বিপুল বরাদ্দ কিংবা তাঁদের কল্যাণে টাকা দেওয়ার আগ্রহটুকু অন্তত দেখানোর চেষ্টা করেন। নির্মলা সেই পথেই হাঁটেননি।
কোভিড-উত্তর অর্থনীতিতে মোদী সরকারের সামনে বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি দুই প্রধান মাথাব্যথার কারণ। সেই সঙ্গে, বাজারে চাহিদার অভাব। অর্থনীতির অন্যান্য চাকা ঘুরতে শুরু করলেও, সাধারণ মানুষ, বেসরকারি ক্ষেত্রের কেনাকাটা এখনও কোভিডের আগের বছরের তুলনায় কম। বাজারে চাহিদা নেই বলেই শিল্পমহল নতুন লগ্নির কথা ভাবছেও না। চাহিদা আগের জায়গায় না ফিরলে, অর্থনীতি কী ভাবে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
অর্থমন্ত্রী মেনেছেন, এখনও বেসরকারি লগ্নি আসছে না। তাই সরকারকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে পরিকাঠামোয় খরচ করতে হচ্ছে। তবে তাঁর আশা, সরকার পরিকাঠামোয় খরচ করতে শুরু করলে, আগামী দিনে বেসরকারি লগ্নিও আসবে। বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর যুক্তি, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে এই বিপুল কর্মকাণ্ডে ভর করেই কাজের সুযোগ তৈরি হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে সরকার যে উৎসাহ ভাতা দিচ্ছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ চাকরি তৈরি হবে।
মূল্যবৃদ্ধির হার খুচরো বাজারে ৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও, অর্থমন্ত্রীর দাবি, এখনও তা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সহনসীমার মধ্যে। আর্থিক সমীক্ষায় আগামী বছরে ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশের বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর আশা, জিডিপি আগামী বছরে ২৫৮ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছবে। মূল্যবৃদ্ধি-যুক্ত বৃদ্ধির হার ১১.১% হবে। যা থেকে স্পষ্ট, অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৯০ ডলারে পৌঁছলেও, মূল্যবৃদ্ধির হার ২.৬ থেকে ৩.১ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে সরকারের আশা।
কর বাবদ আয় বাড়লেও চলতি বছরে বিলগ্নিকরণের ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র ৮৩ হাজার কোটি টাকা ঘরে আসবে বলে সরকারের অনুমান। এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দু’টি ব্যাঙ্ক, একটি বিমা সংস্থা বেসরকারিকরণের কথা ঘোষণা করলেও, তা করে ওঠা যায়নি। তবে এলআইসি-র প্রথম বার শেয়ার ছাড়ার পরে সরকারের ঘরে আরও কিছু বাড়তি আয় আসতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রকের আশা। আগামী বছরেও ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের ফলে বিলগ্নিকরণ থেকে মাত্র ৬৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী সার, পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি ছাঁটাই করেছেন। কোভিডের পরে দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে বাড়তি রেশনের গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা চালু হয়েছিল। তা ৩১ মার্চ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে খাদ্যে ভর্তুকিও কমছে। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়েনি। গত বাজেটে প্রথমে ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও, পরে বাড়িয়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকা করতে হয়েছে। এ বছরও প্রাথমিক বরাদ্দ ৭৩ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গিয়ে বেশি খরচ করতে হচ্ছে বলেই ঘাটতি বেশি কমাতে পারেননি।
সার্বিক ভাবে বাজেটের মোট খরচ বাড়ছে। ফলে চলতি অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতিকে ৬.৮ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য নিলেও, বাস্তবে ঘাটতি তার থেকে বেশি (৬.৯%)। আগামী অর্থবর্ষেও অর্থমন্ত্রী ঘাটতি কঠোর ভাবে কমানোর চেষ্টা করেননি। ৬.৪ শতাংশের লক্ষ্য নিয়েছেন। ফলে তাঁকে বাজার থেকে আগামী বছরে ১১.৫৮ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে। ঋণ জোগাড় করতে পরিবেশ-বান্ধব প্রকল্পের জন্য ‘গ্রিন বন্ড’ ছাড়া হবে। পুরনো ঋণের কারণে সরকারের সুদের বোঝাও বেড়েছে। তবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে ঘাটতিকে ৪.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা তাঁর মাথায় রয়েছে। অর্থমন্ত্রীর এই অবস্থান শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করেছে।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলছেন, ‘‘অর্থমন্ত্রীর সামনে কোভিডের ধাক্কায় আমজনতার চাকরি যাওয়া, ছোট-মাঝারি-শিল্প বন্ধ হওয়া, বহু পরিবারের দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়া, ধনী-গরিবের অসাম্য বৃদ্ধির মতো সমস্যা ছিল। বাজেটে এর কোনও সমস্যার সমাধানই হয়নি। দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য একটি শব্দও নেই।’’ তাঁর অভিযোগ, গরিব শব্দটিই অর্থমন্ত্রীর বাজেট-বক্তৃতায় মাত্র দু’বার এসেছে।
উল্টো দিকে অর্থমন্ত্রীর যুক্তি, তিনি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার মাধ্যমে রোজগার তৈরি হবে। ৮০ লক্ষ পরিবারকে সাধ্যের মধ্যে বাড়ি করে দেওয়া হবে। বাড়িতে নলবাহিত জল পৌঁছে দিতে ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। হোটেল, পর্যটন শিল্প-সহ ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্যও ঋণ গ্যারান্টি প্রকল্পের সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দাবি, ১০০ বছরের ভয়ঙ্কর দুর্যোগের মধ্যে এই বাজেট উন্নয়নের প্রতি ভরসা তৈরি করবে। অর্থনীতি মজবুত করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্যও তৈরি হবে সুযোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy