প্রতীকী ছবি।
ধর্মতলায় ডাক্তারদের অনশন নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে তর্কবিতর্ক চললেও তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মামলায় কোনও দিশা মিলল না। পশ্চিমবঙ্গের জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের দাবি শুনে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মতো প্রশ্নে ঢুকে মূল বিষয় থেকে সরে যেতে চান না। আর জি করের ঘটনার পরে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা শুরু করেছিল। এই মামলার পরিসীমা সুপ্রিম কোর্ট বাড়াতে চায় না। কেন্দ্রের তরফে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাও মন্তব্য করেন, মূল বিষয় থেকে সরে আসা উচিত হবে না।
সিবিআইয়ের তরফে আজ সুপ্রিম কোর্টে মুখ-বন্ধ খামে যে তদন্তের অগ্রগতি রিপোর্ট জমা পড়েছে, তাতে জানানো হয়েছে, সিবিআই ৭ অক্টোবর চার্জশিট জমা দিয়েছে। তাতে মূল অভিযুক্ত হিসেবে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের নাম রয়েছে। খুন-ধর্ষণের ঘটনায় আরও কেউ জড়িত কি না, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ নিয়ে জুনিয়র বা সিনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনের আইনজীবীরা কোনও প্রশ্ন তোলেননি।
রাজ্যের জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের হয়ে আজ সুপ্রিম কোর্টে ইন্দিরা জয়সিংহ জানান, কর্মবিরতি আন্দোলন থেকে ডাক্তাররা সবাই কাজে ফিরেছেন। কিন্তু আট জন ডাক্তার অনশন করছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিন জনের অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সকলেই চান, এই অনশনে ইতি টানা হোক। কারণ সকলেই এ নিয়ে চিন্তিত।
আর জি করের নির্যাতিতার বিচার, স্বাস্থ্যসচিবকে সরানো, কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থা, খালি বেডের সংখ্যা নজরদারিতে ডিজিটাল ব্যবস্থা, সব মেডিক্যাল কলেজে টাস্ক ফোর্স, হাসপাতালের নিরাপত্তায় পুলিশ নিয়োগ, শূন্যপদ পূরণ, ছাত্র সংসদের নির্বাচন, হাসপাতালের হুমকি-প্রথার তদন্তে কমিটি, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে দুর্নীতির তদন্তের মতো দশ দফা দাবিতে ডাক্তাররা অনশন শুরু করেছিলেন। মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ আগেই ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে দাবি করেছেন, দশটির মধ্যে সাতটি দাবি ইতিমধ্যেই মেনে নেওয়া হয়েছে।
অনশনে ইতি টানার সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে আজ জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের হয়ে ইন্দিরা যুক্তি দেন, ২০২২ সালের পর থেকে মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। প্রতি বছর নির্বাচন হওয়ার কথা। ছাত্র সংসদে মনোনীত ব্যক্তিদের বসানো হচ্ছে। পছন্দের লোকদের বসানো বা ‘ফেভারিটিজ়ম’ এবং হুমকি-প্রথা বা ‘থ্রেট কালচার’ চলছে। ইন্দিরা যুক্তি দেন, এর ফলেই আর জি কর হাসপাতালের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দেন, এই নির্বাচনের মধ্যে তাঁরা ঢুকতে চান না। তা এই মামলার পরিসীমার অনেকখানি বাইরে। ডাক্তাররা প্রয়োজনে হাই কোর্টে যেতে পারেন। প্রসঙ্গত জুনিয়র ডাক্তারদের যে তিনটি দাবি রাজ্য সরকার এখনও মানেনি, তার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণ, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি এবং রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে দুর্নীতির তদন্ত। এই তিনটির মধ্যে নির্বাচনের প্রসঙ্গটিই কেবল কেন সুপ্রিম কোর্টে তোলা হল, সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলের।
অন্য দিকে সিবিআই তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আজ সলিসিটর জেনারেল জানান, ৭ অক্টোবর সিবিআই চার্জশিট পেশ করেছে। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে নিহত চিকিৎসকের মা-বাবাকে নিয়মিত জানানো হচ্ছে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট দেখে জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত তদন্তে সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট দায়ের করা হয়েছে। চার্জশিট বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। চার্জ গঠন নিয়ে ৪ নভেম্বর থেকে শিয়ালদহের এসিজেএম আদালতে শুনানি হবে। তদন্তের অগ্রগতি রিপোর্টে সিবিআই ইঙ্গিত করেছে, খুন-ধর্ষণের ঘটনায় অন্য কারও জড়িত থাকার প্রশ্নটি আরও তদন্তসাপেক্ষ। এ বিষয়ে সিবিআই মামলার অন্যান্য পক্ষের থেকেও তথ্য পেয়েছে। তিন সপ্তাহ পরে ফের সিবিআই তদন্তের রিপোর্ট জমা দেবে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে ডাক্তার সংগঠনের আইনজীবীরা কোনও প্রশ্ন তোলেননি। অথচ জুনিয়র ডাক্তারেরা তদন্তে আস্থা নেই বলে দাবি করেছেন, সেই দাবি নিয়ে রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
আর জি কর কাণ্ডের পরে হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে সুপ্রিম কোর্ট জাতীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিল। আজ সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে, কেন ৭ সেপ্টেম্বরের পরে টাস্ক ফোর্সের কোনও বৈঠক হয়নি? সলিসিটর জেনারেল বলেন, সমস্ত রাজ্য ও হাসপাতালের থেকে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। চারটি উপগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এখন বিভিন্ন বিষয়ে সেই সমস্ত পরামর্শ, মতামত ভাগ ভাগ করে খতিয়ে দেখা হবে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, টাস্ক ফোর্সকে কাজের গতি বাড়াতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। তিন সপ্তাহ পরে এই মামলার পরবর্তী শুনানিতে সম্ভাব্য সুপারিশের ইঙ্গিত দিতে হবে।
রাজ্য সরকার আজ সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল-সহ রাজ্যের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সিসিটিভি, রেস্ট রুম, শৌচাগার, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা তৈরির যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার ৯০ থেকে ৯৮ শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে। ২৮টি মেডিক্যাল কলেজে কাজ শেষ হয়েছে। আর জি করে কাজের জন্য সিবিআইয়ের থেকে দেরিতে অনুমতি মেলায় কাজ শেষ হয়নি। তবে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবে।
ডাক্তারদের জয়েন্ট প্ল্যাটফর্মের হয়ে আইনজীবী করুণা নন্দী বলেন, তাঁদের সংগঠনের ২৫ হাজার ডাক্তার বলছেন, রাজ্য সরকার হলফনামা দিয়ে যে তথ্য দিচ্ছে, বাস্তবের সঙ্গে তার সঙ্গতি নেই। তিনি অভিযোগ তোলেন, রাজ্য সরকার ১২৩ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। কিন্তু এনআরএস হাসপাতালের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, চলতি অর্থ বছরে মাত্র ১ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সলিসিটর জেনারেল এ নিয়ে কটাক্ষ করেন।
সুপ্রিম কোর্টে হাজির রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, অর্থ বছরের মাঝখানে কাজ শুরু হয়েছে বলে আর্থিক পরিচালনা ব্যবস্থা সফটওয়্যারের নিয়ম মেনে প্রথমে এক টাকা বরাদ্দ রেখে কাজ শুরু হয়েছে। প্রয়োজন মতো সেখানে অর্থ বরাদ্দ করা হবে। সেই ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। সব টাকাই খরচ করা হবে। ঠিকাদারদের টাকা দেওয়া হবে। এর পরেও ডাক্তারদের হয়ে করুণা নন্দী অভিযোগ তোলায় প্রধান বিচারপতি বলেন, রাজ্য সরকার যখন হলফনামা দিয়ে বলছে, কাজ হয়েছে, তখন তা মেনে নিতে হবে। খুব বেশি হলে সুপ্রিম কোর্ট কাউকে যাচাই করার জন্য পাঠাতে পারে। রাজ্য সরকারের সমস্ত কাজ নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না।
রাজ্য সরকারের আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদী বলেন, কাজ কত খানি হয়েছে, তার প্রমাণ হিসেবে তাঁরা ছবিও জমা দিয়েছেন। ইন্টিগ্রেটেড হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থা পরীক্ষামূলক ভাবে চালু হয়েছে। ১ নভেম্বরের মধ্যে তা পুরো চালু হবে।
জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের হয়ে ইন্দিরা জয়সিংহ বলেন, ছোট বা জেলার হাসপাতাল থেকে যখন রোগীদের বড় হাসপাতালে ‘রেফার’ করা হচ্ছে, তখন যেন হাসপাতালে বেড রয়েছে কি না, সেই রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে কি না, তা দেখা হয়। না হলে রোগীদের হেনস্থা হয় এবং সেই ক্ষোভ এসে পড়ে ডাক্তারদের উপরে। ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তি মেনে নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিষয়টি নজরে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy