Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Education Policy

দক্ষিণ দখলেই কি ধ্রুপদী প্রসঙ্গ?

বুধবার মন্ত্রিসভার ছাড়পত্র পাওয়া ওই নীতি বলছে, ভাষা হিসেবে সংস্কৃত বিপুল ঐতিহ্য ও সম্পদশালী। অথচ একই সঙ্গে তা অসম্ভব আধুনিক।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২০ ০৫:৩২
Share: Save:

হৃদয়ে হিন্দি। কিন্তু দক্ষিণে দাপট বাড়াতে মুখে ধ্রুপদী ভাষার কথা। হিন্দুত্বের আকর বেদ যে ভাষায় লেখা, সেই সংস্কৃতে জোর। পাশাপাশি, ‘ইংরেজি আওড়ানোর জোরে’ সমাজের ‘এলিট’ শ্রেণিতে উঠে আসার সম্ভাবনার শিকড়ে কুঠারাঘাত। মোদী সরকারের নতুন শিক্ষানীতিতে বিভিন্ন ভাষার উপরে আপেক্ষিক গুরুত্ব আরোপের অঙ্কে রাজনীতির এই মাপজোকও খুঁজে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

বুধবার মন্ত্রিসভার ছাড়পত্র পাওয়া ওই নীতি বলছে, ভাষা হিসেবে সংস্কৃত বিপুল ঐতিহ্য ও সম্পদশালী। অথচ একই সঙ্গে তা অসম্ভব আধুনিক। গ্রিক, লাতিনের মতো পুরনো ভাষার থেকেও বেশি সাহিত্য তার ঝুলিতে। তেমনই তার ভিত্তিতে চর্চা হয়েছে গণিত, দর্শন, রাজনীতি, চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে শুরু করে সঙ্গীত পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের। তাই স্কুল এবং উচ্চশিক্ষার সমস্ত স্তরে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে সংস্কৃত পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে শিক্ষানীতিতে।

সেই প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে ধ্রুপদী ভাষার প্রসঙ্গ। প্রায় দেড়-দু’হাজার বছর ধরে বহমান, প্রাচীন কাল থেকে উচ্চমানের সাহিত্যসম্পন্ন অথচ অন্য ভাষা থেকে ‘প্রায় কোনও শব্দ ধার না-করা’ ছয়টি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে। সংস্কৃত ছাড়া বাকিগুলি হল: তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়লম‌ এবং ওড়িয়া। শিক্ষানীতি অনুযায়ী, আগামী দিনে ইচ্ছে হলে এই সব ভাষা নিয়েও চর্চা করার সুযোগ দেওয়া হবে স্কুল-পড়ুয়াদের।

কিন্তু প্রাক্তন সংস্কৃতিসচিব জহর সরকারের মতে, এ আসলে বিজেপির ‘দাক্ষিণাত্য জয়ের’ চেষ্টা। তাঁর কথায়, “বিজেপি জানে, দক্ষিণে তাদের জমি পোক্ত নয় এখনও। সেখানকার বাসিন্দাদের বড় অংশ তাদের থেকে মুখ ফেরায় হিন্দিভাষীদের দল বলে। তাই ধ্রুপদী ভাষা সারা দেশে পড়ানোর কথা বলে দক্ষিণকে রাজনৈতিক বার্তা দিতে চায় বিজেপি।”

আরও পড়ুন: নতুন ব্যবস্থায় ৪ বছরের স্নাতকে সংশয়

বিরোধী শিবিরের মতেও, শিক্ষানীতির খসড়ায় প্রথমে সকলকে হিন্দি পড়ানোর কথা বলে প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়েছিল শিক্ষা মন্ত্রক। ফুঁসে উঠেছিল দক্ষিণের রাজ্যগুলি। এখন পাঁচ দক্ষিণী ভাষাকে সর্বভারতীয় পাঠ্যক্রমে মঞ্চ দেওয়ার কথা বলাটা সেই ক্ষতে প্রলেপ‌ দেওয়ারই চেষ্টা। এক ছাত্র নেতার কথায়, “যে কোনও মঞ্চে শিক্ষামন্ত্রী হিন্দি ছাড়া কথা বলেন না। শোনা যায়, তাঁর টেবিলে পৌঁছনো যাবতীয় ফাইলে নোট হিন্দিতে লেখা বাধ্যতামূলক। বিজেপির লক্ষ্যও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান।” তাই অনেকেরই ধারণা, স্কুলের পড়াশোনায় কৌশলে হিন্দির গুরুত্ব বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়েই যাবে মোদী সরকার। আপাতত ধ্রুপদী ভাষা নিয়ে এই ঘোষণা নির্বাচনী রাজনীতি মাথায় রেখে।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন অনিল সদগোপালের অভিযোগ, “সংস্কৃতের সমান মর্যাদা দেওয়া দূর, তামিল-সহ ধ্রুপদী ভাষাগুলির সঙ্গে সৎ-সন্তানের মতো ব্যবহার করেছে শিক্ষানীতি। কারণ, সংস্কৃত বিজেপির কাছে উচ্চবর্ণের (ব্রাহ্মণদের) জ্ঞান আহরণের ভাষা। তার সম্মান তাদের কাছে মূলত সেই কারণেই। যে কারণে প্রাচীন ভাষা পালিকেও তেমন গুরুত্ব দেয় না তারা।”

ভাষা হিসেবে সংস্কৃতের ঐতিহ্য, সাহিত্য, প্রসার ইত্যাদি নিয়ে এমনিতেই সংশয় নেই। তার উপরে পৌরাণিক মন্ত্রের ভাষা হিসেবে তার ‘বাড়তি’ কদর হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে। বিভিন্ন মঞ্চে এই ভাষার গুণগানে মুখর হয়েছেন খোদ মন্ত্রী। এমনকি দাবি করেছেন, সুরক্ষিত ভাষা হিসেবে আগামী দিনে সুপার কম্পিউটারে তাকে ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। তাই শিক্ষানীতিতে দশ বার সংস্কৃতের উল্লেখ অনেকের কাছেই প্রত্যাশিত।

পড়ুয়াদের যাতে বুঝতে অসুবিধা না-হয় সে জন্য শিক্ষানীতিতে পঞ্চম (সম্ভব হলে অষ্টম) শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা/ স্থানীয় ভাষায় ক্লাসে পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে জোরাজুরি নেই। তা ছাড়া, বিষয় হিসেবে ইংরেজি থাকছেই। কিন্তু জহরবাবুর মতে, এ-ও আর এক ‘শ্রেণি সংঘাতের’ ফল। তাঁর কথায়, “দেহাতি হিন্দুস্তানি বনাম ইংরেজি বলিয়ে-কইয়ে সম্ভ্রান্ত--- এই দু’য়ের মধ্যে সংঘাত চলে আসছে রামমনোহর লোহিয়ার সোশ্যালিস্ট পার্টির সময় থেকে। পরবর্তী কালে তা কব্জা করেছে বিজেপি। লাটিয়ান্স দিল্লির প্রতিনিধি, হার্ভার্ড-শিক্ষিত ইত্যাদি তকমায় যে ইংরেজি (অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশে) শিক্ষিত প্রভাবশালী শ্রেণি শাসক দলের চক্ষুশূল, এই সিদ্ধান্ত তাদের নতুন প্রজন্ম তৈরি বন্ধের লক্ষ্যে।”

বিদেশ-শিক্ষিত সমালোচকদের প্রতি অসূয়া থাকলেও, অনিলের মতে, “শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণির পর থেকে আর মাতৃভাষায় পড়ানোর কথা উল্লেখই করা হয়নি। অর্থাৎ, ভারতের কোনও ভাষাতেই তা সম্ভব বলে, সরকার মনে করে না।”

অন্য বিষয়গুলি:

Education Policy BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy