অনশন প্রত্যাহারের পর ইরম চানু শর্মিলা।
কেউ দেখছেন ‘১৬ বছর ধরে চলতে থাকা পৃথিবীর দীর্ঘতম অনশন আন্দোলন’।
কেউ দেখছেন ‘একটা আবেগঘন মুহূর্ত’।
কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ ‘দীর্ঘ লড়াই শেষে জামিন পাওয়া’।
কেউ মনে করছেন ‘মুখ্যমন্ত্রী হতে চাওয়ার ঘোষণা’টাই সর্বোচ্চ তাৎপর্যের।
নিঃসন্দেহে! ইরম চানু শর্মিলার অনশন প্রত্যাহারের ঘটনা অনেকগুলো কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একটা মাইলফলক এই দিনটা সংশয় নেই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই দিনটার বিভিন্ন উজ্জ্বল অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আরও উঁচু, আরও মহামহিম একটা দৃশ্যপটও তৈরি হয়েছে। অনেকগুলো সুউচ্চ তুষার-শিখর পরিবৃত হয়ে, মহামহিম অস্তিত্ব নিয়ে যেমন আকাশ ভেদ করে দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে যায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ বিন্দুটা, তেমনই মণিপুরে আজ সমুন্নত শির গণতন্ত্রের এক মহান জয় এবং আপাতদৃষ্টিতে গণতন্ত্রের সে জয় দৃষ্টিপথের বাইরে।
গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একটা সরকারই রয়েছে মণিপুরের মসনদে। কিন্তু বহু বছর ধরে মণিপুরবাসী এক ‘অগণতান্ত্রিক’ আইনের বিরুদ্ধে সরব। ইরম চানু শর্মিলার আন্দোলনের জন্মটাও সেই ক্ষোভের আগুন থেকেই। সেই ‘গণতান্ত্রিক অগণতন্ত্রের’ বিরুদ্ধে আন্দোলনের যে পথ শর্মিলা ১৬ বছর আগে বেছে নিয়েছিলেন, তা কিন্তু আদ্যন্ত গণতান্ত্রিক। মণিপুর অনেক রকমের আন্দোলন দেখেছে। ইরম শর্মিলার আগেও অনেকে অনেক রকম পথে আন্দোলন করতে শিখিয়েছেন মণিপুরকে। সে সব পথের অনেকগুলিই সহিংস, সশস্ত্র, প্রাণঘাতী। ইরম চানু শর্মিলা যে দিন সেই পথে না হেঁটে, অহিংস এবং গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই দিনই গণতন্ত্রের এক বিরাট জয় সূচিত হয়েছিল মণিপুরে। দীর্ঘ ১৬ বছর মণিপুরের প্রশাসন তাঁকে বন্দি রেখে এবং বলপূর্বক তরল আহার দিয়ে আন্দোলন রুখে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শর্মিলা যে ভাবে স্বপথে অবিচল থেকেছেন, তাতেও শোনা গিয়েছে গণতন্ত্রের জয়গান। আর আজ, এত দিন পর, অনশন প্রত্যাহার করে নিয়ে আফস্পা-মুক্তির জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের যে সিদ্ধান্ত শর্মিলা নিলেন, তাতে গণতন্ত্র আরও এক বার বিপুল জয় পেল।
ইরম চানু শর্মিলা ঘোষণা করেছেন, তিনি মণিপুরের নির্বাচনে লড়বেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসে রাজ্যকে আফস্পা-মুক্ত করবেন। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে মণিপুরবাসীর সমর্থন চেয়েছেন শর্মিলা। ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এর চেয়ে শুভ দিন আর কী-ই বা হতে পারত?
প্রথমত, বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্রপন্থা, সশস্ত্র হিংসার দীর্ঘ পরম্পরায় দীর্ণ ভারতের উত্তর-পূর্ব। সেই ভূখণ্ডে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অনন্য নজির রাখলেন শর্মিলা।
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ প্রশাসনিক অনমনীয়তা এবং তাঁর প্রতি যথেষ্ট অসংবেদনশীলতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেন না শর্মিলা।
তৃতীয়ত, ভরসা রাখলেন ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই। বিশ্বাস রাখলেন, যা কিছু অগণতান্ত্রিক আজও রয়েছে আমাদের ঘিরে, তা থেকে মুক্তির অমোঘ শক্তি ভারতীয় গণতন্ত্রেই নিহিত।
দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা আজ শর্মিলার ঝুলিতে। পায়ের তলায় শক্ত মাটি এবং নির্মল এক সমর্থনভিত্তি নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির সড়কে পদার্পণ করছেন শর্মিলা। ভারতীয় গণতন্ত্র আজ আরও ঋদ্ধ, আরও মজবুত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy