নির্বাচনী প্রচারে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে তেলঙ্গানা প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান রেবন্ত রেড্ডি। রবিবার কামারেড্ডিতে। ছবি: পিটিআই।
শুধু জুবিলি হিলসই নয়, সিংহবাহন দুর্গার এই ‘পেদাম্বা’ রূপ, গোটা রাজ্যেই আরাধ্য। স্থানীয় বিশ্বাস, এই 'পেদাম্বা গুড়ি' মন্দির হল বিপদনাশিনী। দর্শন নয়, পাশ দিয়ে একবার গেলেই আপনার শত্রুনাশ হবে।
তেলঙ্গানার ভোটবাজারে এই মন্দির এলাকা দেখি ভোর থেকেই জমজমাট। পাশের গলি, পেদাম্বা লেন-এ যে অত্যাধুনিক প্রাসাদ, তাঁর মালিকের দর্শনের জন্য এই ভিড়। পেদাম্বা দেবী সেই বাড়ির মালিকের, অর্থাৎ প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান রেবন্ত রেড্ডির শত্রু বিনাশ করতে পারবেন কিনা, তা আগামী ৩ ডিসেম্বর বোঝা যাবে। কিন্তু ফলাফল যাই হোক, গোটা তেলঙ্গানা জুড়ে গত ন'বছরে যা ভাবা যায়নি, মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের বিরুদ্ধে সেই জোরালো হাওয়া বইয়ে দিতে পেরেছেন এই কংগ্রেস নেতা।
এখানকার এক সাংবাদিক বলে দিয়েছিলেন, ওনাকে ধরতে গেলে ভোরবেলা বাড়ির সামনে পৌঁছে যেতে। কারণ ওই সময়েই পুরনো কংগ্রেসী ধাঁচে দরবার বসাচ্ছেন রেবন্ত। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারলেই বিরাট চত্বর। সেখানে ভোরবেলা হাজিরা দিচ্ছেন কয়েকশো মানুষ। নানা রকম ধান্দায়। থাকছেন কিছু স্থানীয় সাংবাদিকও। রেবন্ত চপারে চষে ফেলছেন গোটা রাজ্য। ফলে সকালটুকুই যা অবকাশ।
রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ যখন তেলঙ্গানায় ঢোকে, মশাল হাতে রেবন্তর শক্ত চোয়ালের ছবি প্রথম নজর কাড়ে সর্বভারতীয় প্রচারমাধ্যমের। তেলুগু দেশম থেকে কংগ্রেসে আসা এই নেতার ইউএসপি, লড়াকু মনোভাব। শেষ পর্যন্ত না দেখে সূচ্যগ্র জমি না ছাড়ার মানসিকতা। রাহুল এবং প্রিয়ঙ্কাও তাঁর পাশে যতটা পারছেন, থাকছেন। অন্য চার রাজ্যের তুলনায় এখানে বেশি সময় কাটাচ্ছেন ভাই-বোন। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব এখানে যে জয়ের স্বপ্ন দেখছে, তার অন্যতম রূপকার এই রেবন্তই।
“নেতারা যখন বিজেপিতে থাকেন, তখন তাঁদের রামের মতো দেখায়, তাই তো! আপনি তো দিল্লি থেকে এসেছেন, এটা আরও ভাল জানবেন! আর যখনই তিনি কংগ্রেস বা অন্য দলে যোগ দেন, তখনই তাঁকে দেখায় দশাননের মতো।” স্পষ্ট হিন্দি উচ্চারণ, ছোটখাটো চেহারা, আপাদমস্তক শাদা পোশাক এবং কপালে গাঢ লাল টিপে বোঝা মুশকিল এঁর মধ্যে কত হর্স পাওয়ারের ব্যাটারি ভরা রয়েছে! দিল্লি থেকে এসেছি বলে আলাদা খাতির করে ভিতরের ঘরে নিয়ে বসানোর নির্দেশ দিয়েছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তেলঙ্গানার বাইরেও নিজের বার্তা দেওয়ার মনবাসনা রয়েছে তাঁর। আর সেই সাতসকালেই গরম বিরিয়ানি এসেছে সাংবাদিকের জন্য, যাঁর তখনও প্রথম কাপ চা-ই খাওয়া হয়নি!
জি বিবেক, পি শ্রীনিবাসের মতো প্রথম সারির নেতাদের কথা বলছেন রেবন্ত, যাঁরা যথাক্রমে বিজেপি এবং বিআরএস থেকে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন সম্প্রতি। আর তার পরই তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। এক নাগাড়ে বললেন, “বিজেপির এক সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন গদ্দাম বিবেক। কিন্তু যখন তিনি বুঝলেন তলায় তলায় বিজেপি হাত মিলিয়েছে বিআরএস-এর সঙ্গে, তিনি তৎক্ষণাৎ যোগ দিলেন কংগ্রেসে। ব্যস তখনই তিনি রাবণ! ইডি তাঁর বাড়ি তল্লাসি করে নানা ভাবে হেনস্থা করছে। কিন্তু বিআরএস-এর নেতাদের টাকা নয়ছয় করার প্রমাণ আমরা যখন ইডি-র কাছে জমা দিচ্ছি, তারা কর্ণপাতও করছে না। আসলে আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়, লড়ছি ইডি আর ইনকাম ট্যাক্স বিভাগের সঙ্গে।”
এটা ঘটনা যে, কেসিআর-এর ‘রায়তু বন্ধু’ যোজনা ২০১৮ সালের ভোটে অসামান্য সাফল্য এনে দিয়েছিল বিআরএস-কে। কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো এই যোজনা আসলে খয়রাতিরই নামান্তর। প্রতিটি কৃষককে প্রতি একর প্রতি শস্য পিছু বছরে দশ হাজার টাকার অনুদান। এটা দেওয়ার কথা বছরের গোড়ায়, অর্থাৎ জানুয়ারিতে। গত বারের ভোটে এই নভেম্বর মাসেই ভোটাররা যখন লাইনে দাঁড়িয়ে, তখন তাঁদের (যাঁরা কৃষক) অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকিয়েছে কেসিআর সরকার। রেবন্তর কথায়, “এ বারেও সেটাই করছে। আমরা নির্বাচন কমিশনকে বলে এসেছি, কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না। ওরা ভোটের মুখে টাকা দেওয়া শুরু করেছে। কেন্দ্র বলছে, আমরা বিআরএস সরকারকে সাহায্য করছি তাদের বাজেট পুরোটা শেষ করে দেওয়ার জন্য। যাতে সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। বুঝুন অবস্থাটা!”
কংগ্রেসও অবশ্য খয়রাতির প্রতিশ্রুতিতে পিছিয়ে নেই। জনসভায় রেবন্ত ঘোষণা করেছেন, ‘আপনারা যে টাকা পাচ্ছেন নিয়ে নিন। আমরা এসে আপনাদের এই প্রকল্পকেই বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করব। বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা জানুয়ারিতেই পেয়ে যাবেন।’
কেসিআর-এর পুত্র কেটিআর সম্প্রতি ব্যঙ্গ করেছেন, পরিবারবাদে মগ্ন কংগ্রেস এখানকার ভূমিপুত্র (উত্তর তেলঙ্গানার মন্থনী গ্রামের) পি ভি নরসিংহ রাওকে সম্মান করেনি। এটা বলতেই ভিতরের আগ্রাসী সত্তাটা বেরিয়ে এল রেবন্তর। “কেটিআর এক জন গর্দভ! ওঁর কথা গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ারই কোনও মানে নেই। একটি গ্রামের সরপঞ্চ থেকে পি ভি-কে প্রধানমন্ত্রী করেছে কংগ্রেস। এআইসিসি-র সভাপতি করেছে। তেলুগু ভাষী এখানকার ৪ কোটি এবং বাইরের ১৮ কোটি মানুষের তিনি আজ গর্ব। কেটিআর কি তাঁর পরিবারের বাইরে কাউকে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত বানানোর কথা ভাববেন কোনও দিন?” তাঁকে প্রশ্ন করা হল, কেটিআর-এর আরও অভিযোগ, রেবন্ত এবং রাহুল গান্ধী ঠিক মতো কোনও পেশাদার কাজই করেননি। সে রকম শিক্ষাগত যোগ্যতাও তাঁদের নাকি নেই। চড়া উত্তর রেবন্তর, “উনি নিজে আমেরিকা গিয়ে কী করেছিলেন, আমরা কেউ জানি না। ওনার বাবা না থাকলে একজন চাপরাশি হওয়ার যোগ্যতাও কেটিআর-এর নেই।”
ঝাঁঝালো বক্তৃতা যে রেবন্তর প্রধান অস্ত্র, তা বোঝাই যায়। হায়দরাবাদ থেকে একশো কুড়ি কিলোমটার দুরে কামারেড্ডি নির্বাচনী ক্ষেত্রে হাইভোল্টেজ লড়াই চলছে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কেসিআর-এর। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কংগ্রেস যে বিআরএস-এর থেকে টাকার থলির ওজনে পিছিয়ে রয়েছে, এমনটা নয়। কংগ্রেসও টাকা ঢালছে। কিন্তু বুথ মানচিত্র এবং টাকা বণ্টনের ব্যাকরণ, কেসিআর-এর হাতের তালুর মধ্যে। তিনি এবং তাঁর দল যে ভাবে তেলঙ্গানার বুথ-রাজনীতি জানেন, তার ধারেকাছে নেই কংগ্রেস বা অন্য কোনও দল। তৃণমূল স্তরের সংগঠন, টাকার বণ্টন, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জনচরিত্র, তাদের পছন্দ, অপছন্দ, দুর্বলতা, নেশা — সে সব নখদর্পণে বিআরএস শীর্ষ নেতৃত্বের। তাঁরা জনসভার যে বক্তৃতা তৈরি করছেন, তা সমসাময়িক, নিখুঁত। রেডিয়ো সম্প্রচারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তৈরি ভাষ্য নিয়ে কাজ করছেন, এমন একজন সরকারি পদস্থ ব্যক্তির কথায়, “বিআরএস যেখানে নিখুঁত ভাবে তাদের যোজনাগুলির মাহাত্ম্য তথ্য ও পরিসংখ্যান দিচ্ছে, কংগ্রেস সেখানে যেন অনেকটাই এলোমেলো, আবেগ নির্ভর। তারা জওহরলাল নেহরু এবং ইন্দিরা গান্ধীতেই যেন আটকে থাকছে। আবার অক্টাভিয়ান হিউমের কথাও আনছে! বিআরএস প্রচারে কাজে লাগাচ্ছে এখানকার তথ্যপ্রযুক্তির সেরা মস্তিষ্ককে।”
সব মিলিয়ে, সিংহবাহন দেবী পেদাম্বা জেলা থেকে জেলায় ছুটে বেড়ানো এই রেবন্তর কতটা বিপদনাশ করেন, তা নিয়ে শেষ কথা বলা চলছে না কোনও মতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy