ব্যক্তিপরিসরের অধিকার জীবন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজ এক ঐতিহাসিক রায়ে এ কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্টের ৯ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছে, সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় জীবন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষিত। ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকে তার থেকে আলাদা করে দেখা চলে না। এক জন মানুষ কী খাবে বা কী পরবে অথবা সে ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক ভাবে কার সঙ্গে মেলামেশা করবে, তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের নেই।
কেন্দ্রীয় সরকার জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আধারকে বাধ্যতামূলক করে তোলায় ব্যক্তিপরিসরের অধিকার ঘিরে জলঘোলা শুরু হয় । আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবির মতো ব্যক্তিগত তথ্য সরকারের হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে আপত্তি তোলেন অনেকে। সরকার পাল্টা বলে, ব্যক্তিপরিসরের অধিকার তো মৌলিক অধিকার নয়। খোদ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সংসদে বলেছিলেন, বিষয়টি ধোঁয়াটে এবং আকারবিহীন। বস্তুত, ১৯৫৪ সালে এম পি শর্মা মামলায় সুপ্রিম কোর্টেরই ৮ বিচারপতির বেঞ্চ এবং ১৯৬১ সালে খরক সিংহ মামলায় ৬ বিচারপতির বেঞ্চ রায় দিয়েছিল, ব্যক্তিপরিসরের অধিকার সাংবিধানিক অধিকার নয়। এ দিন সেই দুই রায় খারিজ হয়ে গিয়েছে। খারিজ হয়েছে ১৯৭৬ সালের শিবকান্ত শুক্ল মামলার রায়ও।
আধার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বলে, আধারের বাধ্যবাধকতা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যক্তিপরিসরের অধিকার আদৌ মৌলিক অধিকার কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু আগের রায় যদি কোনও কারণে খারিজ করতে হয়, তা হলে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বৃহত্তর বেঞ্চে। সেই কারণেই প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃত্বে তৈরি হয় ৯ বিচারপতির বেঞ্চ।
তবে শুধু আধার নয়— ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে ব্যক্তিপরিসরের সীমা ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফেসবুক ও হোয়াটস অ্যাপের বার্তা চালাচালি, কেনাকাটা থেকে মধুচন্দ্রিমার হোটেল বুকিং, কোনও তথ্যই গোপন থাকছে না বলে অভিযোগ। এই সব তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা বা বিজ্ঞাপনের কাজে যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে, তেমনই তৈরি হচ্ছে সরকারি নজরদারির সুযোগও।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের রায়কে আজ ‘ঐতিহাসিক’ বলে কুর্নিশ জানিয়েছে গোটা দেশ। এ দিন প্রধান বিচারপতি খেহর, বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি আব্দুল নাজির এবং বিচারপতি আর কে অগ্রবাল মিলিত ভাবে একটি রায় দিয়েছেন। সেটি লিখেছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। আলাদা আলাদা ভাবে পাঁচটি রায় দিয়েছেন বাকি পাঁচ বিচারপতি। কিন্তু ছ’টি রায়ের মূল কথা একটাই। প্রবীণ আইনজীবী সোলি সোরাবজির মতে, ‘‘যে রায়ে মানুষের মৌলিক অধিকারের ব্যাপ্তি পায়, তাকে সমাদর জানাতেই হবে। বিচারপতিরা যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছেন, তা-ও সাধুবাদের যোগ্য।’’
আরও পড়ুন:বাবার রায়ে গলদ খুঁজে ইতিহাস গড়লেন ছেলে
আধারের বাধ্যবাধকতার উপরে এই রায়ের প্রভাব পড়বে কিনা, সে ব্যাপারে সরাসরি মন্তব্য করেনি সুপ্রিম কোর্ট। সে বিচার হবে আলাদা ভাবে, সুপ্রিম কোর্টেরই সাংবিধানিক বেঞ্চে। কিন্তু এই রায়ের ভিত্তিতেই যে সেই বিচার হবে, তা মানছেন অধিকাংশ আইনজীবীই। আর তার ফলে দু’দিন আগেই তাৎক্ষণিক তিন তালাক বাতিল নিয়ে বুক বাজানো নরেন্দ্র মোদীর সরকার আজ খানিক বিপাকে। বিড়ম্বনায় বিজেপি-ও। কারণ বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিও সুপ্রিম কোর্টে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য না-করার পক্ষেই সওয়াল করেছিল।
এই সুযোগ কাজে লাগাতে ময়দানে ঝাঁপিয়েছে কংগ্রেস। দলের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধীর মন্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ফ্যাসিবাদী শক্তির জন্য জোর ধাক্কা। নজরদারির মাধ্যমে দমনের যে নীতি বিজেপি নিয়েছে, এই রায় তাকে প্রত্যাখ্যান করল।’’ প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেছেন, ‘‘১৯৪৭-এ যে স্বাধীনতা মিলেছিল, তা আরও সমৃদ্ধ হল, আরও ব্যাপ্তি পেল।’’ অবস্থা সামলাতে কেন্দ্রের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ দাবি করেছেন, তাঁরা ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের পক্ষেই ছিলেন।
পাশাপাশি, বিজেপির পাল্টা যুক্তি, ব্যক্তিপরিসরের অধিকার সব কিছুর ঊর্ধ্বে নয়। তাতে যুক্তিসঙ্গত সীমারেখা থাকবেই। বস্তুত, সুপ্রিম কোর্টই বলেছে, ব্যক্তিপরিসরের অধিকার নিরঙ্কুশ নয়। তার কথায়, ‘‘কোনও আইন যদি ব্যক্তি পরিসরে হস্তক্ষেপ করে, তবে তাকে মৌলিক অধিকারের অনুমোদনযোগ্য বিধিনিষেধের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হতে হবে। যে আইন বলে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে, তা যাতে নিয়মানুগ, ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করে তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।’’ এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই সোলি সোরাবজি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘ব্যক্তি স্বাধীনতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে নয়। তাতে যুক্তিসঙ্গত সীমারেখা থাকবে।’’ তা ছাড়া, ব্যক্তিপরিসরের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাও ঠিক করে দেয়নি কোর্ট।
এ দিনের রায়ের পর প্রশ্ন উঠেছে, সমকামিতাকে অপরাধের তকমা দেওয়া ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার ভবিষ্যৎ কী হবে! তা ছাড়া, মোদী জমানায় বিরোধীদের ফোনে আড়ি পাতা থেকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে নাক গলানোর অভিযোগ উঠেছে। গোটা দেশের মানুষের ডিএনএ তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিচ্ছে মোদী সরকার। এর প্রত্যেকটির সঙ্গেই ব্যক্তিপরিসর লঙ্ঘনের প্রশ্নটি জড়িত। আজকের পরে যে কেউ তাঁর ব্যক্তিপরিসরে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায়ের আলোতেই তখন তার বিচার হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy