স্ত্রী তোসিকোর সঙ্গে রাসবিহারী.
১০০ বছর আগের কথা। টোকিওর রেইনানসাকা থেকে অন্ধকারে ছদ্মবেশী কয়েক জন যুবা এল শিনজুকু শহরে। দোকান-বাড়ি ‘নাকামুরায়া’-র পিছনে ছিল নির্জন একটা ভুতুড়ে ভবন। সেটির দোতলায় এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিল দুই বাঙালি। ওঁদের একজন রাসবিহারী বসু। লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল ওঁর বিরুদ্ধে। বেশ কিছু দিন ভারতের নানা জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর গোপনে তিনি পাড়ি দেন জাপানে।
কোন পরিস্থিতিতে লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার ষড়যন্ত্র আঁটছিলেন রাসবিহারী বসু? আলিপুরের বোমা মামলায় গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ১৯০৮ সালেই কলকাতা ছাড়েন তিনি। দেহরাদূনে গিয়ে ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হেড ক্লার্কের একটি কাজ যোগাড় করেন। সেখানে গিয়ে যতীন মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন) আর ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র আঁটকে থাকেন। ঠিক হয়, ব্রিটিশরাজকে কড়া বার্তা দিতে সরিয়ে দেওয়া হবে লর্ড হার্ডিঞ্জকে। এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় বসন্ত বিশ্বাসকে। অবশেষে, আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দিল্লিতে রাজা পঞ্চম জর্জের সঙ্গে সঙ্গে দেখা করে ফিরছিলেন হার্ডিঞ্জ। সেই সময়ে ভাইসরয়কে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন বসন্ত। বোমা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। সন্দেহভাজনদের তল্লাশিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটিশ পুলিশ।
লাহৌরে গার্ডস সাহেবকে বোমা মেরে হত্যার চেষ্টা ছাড়াও ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাজের আরও অভিযোগ ছিল বসন্তর বিরুদ্ধে। ধরা পড়েন তিনি। ১৯১৫-র ১১মে পঞ্জাব জেলে তাঁর ফাঁসি হল। এ বার ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের পাখির চোখ বসন্তর গুরু রাসবিহারী বসু। হন্যে হয়ে পুলিশ তাঁর খোঁজে নামে। মোটা অর্থের পুরস্কার ঘোষণা হল।
প্রাণে বাঁচতে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন রাসবিহারী। বসন্তর ফাঁসির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়লেন। জাহাজে করে পৌঁছলেন জাপানের কোবে শহরে, পি এন টেগোর ছদ্মনামে। ৮ জুন ট্রেনে কিয়াতো হয়ে টোকিও। ইংরেজি জানা এক পুলিশ নাকি তাঁকে ওখানে থাকা, বাড়ি খুঁজে দেওয়ার কাজে সাহায্য করেন। টোকিওতে তখন বেশ কিছু ভারতীয় গদর পার্টির সদস্য। ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাসবিহারী বিপ্লবী কাজে নেমে পড়লেন। কয়েক মাস বাদে সাংহাই থেকে জাহাজে জাপানে এলেন বাঙলার আর এক বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত। তিনিও জাহাজে এলেন কোবে বন্দরে। এর পরের ইতিহাসটা রীতিমত গল্পের মত।
শিনজুকুর ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আইজো সোমা ও তাঁর স্ত্রী কোক্কো দু’জনেই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক। এক সময়ে এই দ্বিতল ভবনটি ব্যবহৃত হত শিল্পঘর হিসাবে। দুই বিদেশির আশ্রয়ে তাই কারও সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও সোমা-দম্পতি ওই দু’জনের ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখতে সতর্ক করে দিলেন তাঁদের কর্মীদের। চলতে লাগল দুই বঙ্গতনয়ের গোপন কর্মকাণ্ড।
কোক্কো ইংরেজি বুঝতে ও বলতে পারতেন। অচিরেই তিনি দুই বঙ্গতনয়ের অভিভাবিকা হয়ে উঠলেন। তথ্য আদানপ্রদানের দূত আর অনুবাদক হিসাবে অগ্রণী ভূমিকা নিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ কন্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী তোশিকো।
কোন পরিস্থিতিতে, কী ভাবে জাপানে এসেছিলেন রাসবিহারী? জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েক মাস। শেষ রাত।
২০১৬-র ৭ নভেম্বর টোকিওতে জাপান-ভারত একটি চুক্তি হয়। রাসবিহারী-হেরম্বকে জাপান থেকে বার করে দেওয়ার অনুরোধ করে ব্রিটিশ প্রশাসন। ১২ ডিসেম্বর জাপান সরকার ওঁদের জাপান ছাড়ার নির্দেশ দেয়। সোন বুন নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাইলেন রাসবিহারী বসু। ‘ইন্দো দোকুরিৎসু হিৎসুওয়া’ (ভারতের স্বাধীনতার গোপন কথা) বইয়ে সানজো কুসাবিরাকি লিখেছেন, হেরম্বলালের মাধ্যমে এই যোগাযোগ। মতান্তরে, এই পরিচয় হয়েছিল জাপান প্রবাসী গদর পার্টির কর্তা ভগবান সিংয়ের মাধ্যমে।
জাপানে কবিগুরুর সঙ্গে।
মাস তিনেক বাদে মতানৈক্যের জেরে হেরম্বলাল জাপান ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। ব্রিটিশরা রাসবিহারীর খোঁজে তন্নতন্ন অভিযান শুরু করল। তাঁর আত্মগোপন হল আরও কঠোর। কোক্কো পরিবারের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন বছর ত্রিশের রাসবিহারী। তা সত্ত্বেও ডেরা ছাড়তে হল তাঁকে। কিন্তু কোথায় যাবেন?
এই বিপ্লবী-পুলিশ খেলার মধ্যে দিয়ে রাসবিহারী এসে পৌঁছেছিলেন সোমা পরিবারে। আকাশছোঁয়া অনিশ্চয়তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। যুবাটিকে সস্নেহ আশ্রয় না দেওয়ার অর্থ তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তুলে দেওয়া। তাকেশি নাকাজিমা ‘নাকানুরায়া নো বোউসু’ বইতে লিখেছেন এ সব কথা। এই অবস্থায় সোমা দম্পতি ঠিক করলেন সদ্য স্কুল ডিঙোনো তোসিকোর সঙ্গে রাসবিহারীর বিয়ে দেবেন।
নাকামুরা ত্সুনে নামে এক শিল্পীর সঙ্গে তোসিকোর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ত্সুনে যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ায় সেই সম্পর্কে আপত্তি জানান সোমা-দম্পতি। সম্পর্কের ইতি পড়ে। ঠিক হল ১৯১৮-র মে মাসের মাঝামাঝি মিৎসুরু তোয়ামার বাড়িতে রাসবিহারী-তোসিকোর বিয়ে হবে। তারিখ পিছিয়ে হল ৯ জুলাই।
প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বাজছে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জার্মানির গুপ্তচর হিসাবে চিহ্ণিত করেছিল। মিত্রশক্তি তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করল জাপানের উপর। রাসবিহারীর সংগ্রাম তাই আরও বাড়ল। কোক্কো সোমা আত্মজীবনীতে লিখেছেন, অন্তত ১৭ বার বাসাবদল করতে হয়েছে নবদম্পতিকে। বহু বার ওঁদের নিতে হয়েছে ছদ্মনাম।
বিয়ের মাস চারেক বাদে সম্পাদিত হল ভার্সাই চুক্তি। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ। এক দিন কোক্কো মেয়ে-জামাইকে দেখতে গেলেন। এত অন্ধকার ঘর! আলো-হাওয়া ঢোকে না! এ ভাবে, এ রকম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় মানুষ থাকতে পারে? কেঁদে ফেললেন কোক্কো। একরাশ অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, দুশ্চিন্তার মধ্যে এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে তোসিকো। আর তাঁর স্বামী ডুবে গিয়েছেন ভারতকে স্বাধীন করার দুরূহ কর্মযজ্ঞে। আইএনএ তৈরি, নেতাজিকে জাপানে আহ্বাণ— তালিকা অতি দীর্ঘ। দু’বার জাপানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। শান্তিনিকেতনের জন্য চাঁদা তুলে দেন কবিগুরুকে।
ঠাণ্ডা-জ্বরে ক্রমাগত ভুগছিলেন তোশিকো। সঙ্কটের ভ্রূণ অঙ্কুর মেলেছে ওঁর বুকে। সে সময় যক্ষার আধুনিক চিকিৎসা ছিল না। ১৯২৪-এ রোগে ভুগে মারা গিয়েছেন তোশিকোর প্রাক্তন প্রেমিক ত্সুনে। ১৯২৫-এর মার্চ মাসে সব শেষ। চিরতরে চলে গেলেন তোশিকো নিজে।
কোক্কোর মনে হল যেন স্বেচ্ছায় মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে মনের জোর পেলেন রাসবিহারী কতটা ভেঙে পড়েছেন তা জেনে। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত আর নিঃসঙ্গতা ভাঙতে আরও বেশি করে রাসবিহারী জড়িয়ে পড়লেন বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে। মাতৃহারা ছেলে মাসাহিদে আর মেয়ে তেৎসুকো বড় হতে লাগল দিদা কোক্কোর কাছে।
এই অবস্থায় রাসবিহারীকে কিছু যুবতী বিয়ে করার আগ্রহ দেখান। কোক্কো নাকি জামাইকে ফের বিয়ে করার প্রস্তাবও দেন। কিন্তু স্বপ্নের ভাগীদার, একান্ত সচিব হিসাবে আর কাউকে ভাবতে পারেননি ওই দামাল বিপ্লবী। পরের বছর তিনি নাকামুরায় খোলেন ‘ইন্ডিয়ান কারি’ নামে এক রেস্তোরাঁ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন হেরে যায়, রাসবিহারী প্রায় শয্যাশায়ী। দীর্ঘ দিন অসুখে ভুগে মারা যান ১৯৪৫-এর ২০ জানুয়ারি। বয়স হয়েছিল ৫৮। ছেলে মাসাহিদে যোগ দিয়েছিলেন জাপানি বাহিনীতে। ৫ মাস বাদে মার্কিন সেনাদের হাতে মারা যান ওকিনাওয়া যুদ্ধক্ষেত্রে।
১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মেয়ে ইন্দিরা, বোন বিজয়লক্ষ্মী আর কিছু পারিষদকে নিয়ে জাপানে যান। রেনকোজি বুদ্ধ মন্দিরে গেলেও ওঁরা নাকামুরায় যাননি। প্রবীর বিকাশ সরকার তাঁর ‘জানা অজানা জাপান’-এ কথা জানিয়ে লিখেছেন, কোক্কো সোমা নাতনি তেৎসুকো হিগুচিকে নিয়ে নেহরুর কাছে যান। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রায় অকথিত একটা অধ্যায় অশীতিপর কোক্কো প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে শোনান নেহরুকে। রাসবিহারীর কিছু স্মারক তুলে দেন। এর বছরখানেক বাদে মারা যান মহীয়সী কোক্কো। সম্রাট হিরোহিতো জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক দিয়ে স্বীকৃতি জানান রাসবিহারী বসুকে।
একজন অবস্থাপন্ন ঘরের জাপানি যুবতী। আর একজন বাঙালি বিপ্লবী। সংগ্রামের পথ যেন সত্যি বেঁধে দিয়েছিল দু’জনের বন্ধনহীন গ্রন্থি। সেই চলায় স্নেহের ডালি উজাড় করে দিয়েছিলেন আর এক জাপানি মহিলা।
শতবর্ষের ইতিহাসে যেন চাপা পড়ে গিয়েছে সেই অমর প্রেমকথা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy