Advertisement
২০ অক্টোবর ২০২৪
Gurpatwant Singh Pannun

‘খলিস্তানি’ বিতর্কে মোদীর জবাব দাবি করছে তৃণমূল, সিপিএম ‘জাতীয়তাবাদী’, তারা কি পথ হারাইয়াছে!

খলিস্তানি বিতর্কে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র দুই শরিক কংগ্রেস এবং তৃণমূল কেন্দ্রের বিবৃতি দাবি করলেও আর এক ‘সহযোগী’ সিপিএম দাঁড়িয়েছে মোদী সরকারের পাশে।

‘RAW’ directed plot to murder sikh separatists in US and Canada, TMC seeks reply from centre, CPM supports stand of New Delhi

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:০০
Share: Save:

খলিস্তান বিতর্কে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে ‘কোণঠাসা’ করতে ময়দানে নেমেছেন তৃণমূলের সাংসদেরা। কিন্তু সিপিএমের পলিটব্যুরো বিবৃতি জারি করে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পাশে’ দাঁড়িয়েছে! ঘটনাচক্রে, বাংলায় এই দু’টি দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুযুধান। দু’টি দলেরই ‘প্রতিপক্ষ’ বিজেপি। কিন্তু খলিস্তান প্রসঙ্গে তৃণমূল সেই বিরোধিতা বজায় রাখলেও সিপিএম রাখতে পারেনি। ‘আন্তর্জাতিক’ প্রশ্নে সিপিএম বিজেপির পক্ষ নিয়ে ফেলেছে। তারা বোঝাতে চেয়েছে, তারাও ‘জাতীয়তাবাদী’। যে সূত্রে প্রশ্ন উঠছে, সিপিএম কি ‘দিশাহীন’ হয়ে পড়ল!

খলিস্তানপন্থী নেতা গুরপতবন্ত সিংহ পন্নুনকে খুনের চেষ্টার মামলায় ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং)-এর কোনও ভূমিকা আছে কি না, সে বিষয়ে সংসদে মোদী সরকারের বিবৃতি দাবি করেছেন তৃণমূলের তিন সাংসদ মহুয়া মৈত্র, সাগরিকা ঘোষ এবং সাকেত গোখলে। কিন্তু বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র দল সিপিএম দাঁড়িয়েছে মোদী সরকারের পাশে। তৃণমূল যখন তার বিজেপি বিরোধী অবস্থানে অনড়, তখন সিপিএমের এই ‘জাতীয়তাবাদী অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, সিপিএম কি আদর্শগত ভাবে ‘দিশাহীনতার শিকার’? দলের পলিটব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসুর অবশ্য ব্যাখ্যা, ‘মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ’ থেকে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে অবস্থান নেওয়া হয়েছে।

আমেরিকার তদন্তকারী সংস্থা এফবিআই আদালতে সম্প্রতি দাবি করেছে, ভারতে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত সংগঠন ‘শিখ ফর জাস্টিস’ (এসএফজে)-এর নেতা পন্নুনকে হত্যার চেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন ভারত সরকারের প্রাক্তন আধিকারিক বিকাশ যাদব এবং তাঁর সঙ্গী নিখিল গুপ্ত। বিকাশ আদতে ‘র’-এর এজেন্ট বলেও দাবি করে তাঁকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ঘোষণা করেছে এফবিআই। যদিও পন্নুনকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে মোদী সরকার। ঠিক যেমনটা তারা করেছিল কানাডায় খলিস্তানি জঙ্গি হরদীপ সিংহ নিজ্জরের খুনের ঘটনায় ‘র’-এর ভূমিকা নিয়ে জাস্টিন ট্রুডো সরকারের অভিযোগ প্রসঙ্গে।

যদিও তৃণমূল তাদের ‘ভবি’ ভোলেনি। এফবিআই প্রধানের বিবৃতির পরেই গুজরাত পুলিশের বিরুদ্ধে ভুয়ো সংঘর্ষে সোহারাবুদ্দিন শেখকে খুনের অভিযোগের সঙ্গে পন্নুনকাণ্ডের তুলনা টানেন তৃণমূলের লোকসভা সাংসদ মহুয়া। তিনি লেখেন, ‘‘এখন আমেরিকায় বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ‘র’ আধিকারিক। আমাদের দেশে কি ‘শাহ এন্ড কোম্পানি’-র মনে হচ্ছে পৃথিবীটা গুজরাত আর সোহরাবুদ্দিন-কৌশল হল পথ! কী মর্মান্তিক।’ পাশাপাশিই তিনি বলেন, ‘‘আইনের তোয়াক্কা না করে আমেরিকায় খুনের অভিযোগ ‘র’-কর্তার বিরুদ্ধে! আমাদের দেশের বিরুদ্ধে এ সব কী অভিযোগ উঠছে?’’ তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ সাগরিকা ঘোষ লেখেন, ‘‘আমেরিকা জানিয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি ‘র’-এর প্রাক্তন কর্তা বিকাশ যাদব। তাঁর বিরুদ্ধে সুপারি কিলার নিয়োগ করে খুন করানোর চেষ্টার অভিযোগ। বিকাশ কি ফেঁসে গিয়েছেন? ওঁর পিছনে কে রয়েছে? মোদী সরকারের উচিত এই গুরুতর অভিযোগ নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেওয়া।’’ তৃণমূলের আর এক রাজ্যসভা সাংসদ সাকেত গোখলেও ‘র’-এর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে সংসদে কেন্দ্রের বিবৃতি দাবি করেছেন। একই দাবি জানিয়েছেন কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারিও।

মহুয়া-সাগরিকা মোদী সরকারের সমালোচনা করায় ইতিমধ্যেই বাংলার বিভিন্ন বিজেপি নেতা-নেত্রী তাঁদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে কাঠগড়ায় তুলতে শুরু করেছেন। কিন্তু তাতে মহুয়াদের অবস্থানের কোনও নড়চড় হয়নি। বরং তাঁরা আরও জোরালো ভাবে ওই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। যা থেকে স্পষ্ট, তৃণমূল তাদের ‘সর্বাত্মক’ বিজেপি বিরোধিতা থেকে সরছে না। সংসদের অধিবেশনেও তারা ওই বিষয়ে সরব হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

বিতর্কের এই আবহে সরাসরি মোদী সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে সিপিএম। দলের পলিটব্যুরোর বিবৃতিতে সরাসরি ‘খলিস্তানি’ শব্দ প্রয়োগ করে বলা হয়েছে, ‘কানাডার মাটিতে ভারত বিরোধী খলিস্তানিদের তৎপরতা জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’ ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য মেনে সাধারণ ভাবে বিদেশনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনও বিরোধী দল প্রকাশ্যে সরকারি সিদ্ধান্ত বা ‘বিতর্কিত বিষয়’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। ‘কৌশলগত’ অবস্থানের বিষয়ে প্রকাশ্য বিবৃতির দাবি তুলে সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টাও করে না। কিন্তু কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মতো ‘জাতীয়তাবাদী’ দল যখন খলিস্তানি বিতর্কে মোদী সরকারকে কোণঠাসা করতে সক্রিয়, তখন সিপিএম কেন ‘ভিন্নসুর’?

সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য নীলোৎপল বলেন, ‘‘সব কিছুকে আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা চলে না। এটা স্পর্শকাতর বিষয়। আমরা মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র বিষয়টিকে দেখছি।’’ পাশাপাশিই অবশ্য তাঁর মন্তব্য, ‘‘খলিস্তানি এবং আরএসএস— দুই শক্তির বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই। অতীতেও খলিস্তান আন্দোলনের সময়ে পঞ্জাবে আমাদের ৩০০-র বেশি কর্মী খুন হয়েছিলেন। সিপিআই এবং কংগ্রেসেরও অনেকে খুন হয়েছিলেন। আমরা কখনওই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সম্পর্কে অবস্থান নিতে দোদুল্যমানতা দেখাই না।’’

ষাটের দশকের গোড়ায় জওহরলাল নেহরুর জমানায় লাদাখ এবং অরুণাচলের সীমান্তে চিন সেনার হামলার সময় প্রশ্ন উঠেছিল তৎকালীন অবিভক্ত সিপিআই নেতৃত্বের একাংশের ‘অবস্থান’ নিয়ে। গোটা দেশ জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে ভাসলেও ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, বিটি রণদিভে, পি সুন্দরাইদের গলায় ‘অন্য সুর’ শোনা গিয়েছিল। পরে মূলত সেই শিবিরের নেতারাই তৈরি করেছিলেন সিপিএম। ষাটের দশকের শেষপর্বে সিকিমের নাথু লা সীমান্তে সংঘাত এবং চলতি শতকে ভুটানের ডোকলাম লাগোয়া ট্রাইজংশনে কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত চিনের একতরফা আগ্রাসনেরও প্রকাশ্যে নিন্দা করেনি সিপিএম। বেজিংয়ের নিন্দা না করে দলের তরফে ‘সংযত প্রতিক্রিয়া’ দেখানো হয়েছিল ২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ানে লালফৌজের হামলায় ২০ ভারতীয় সেনার মৃত্যু নিয়েও। হঠাৎ তাই স্তিমিত হয়ে পড়া খলিস্তান সমস্যা নিয়ে সিপিএমের ‘উদ্বেগ’ প্রশ্নের মুখে। প্রসঙ্গত, বিধানসভা ভোটের আগে জম্মু ও কাশ্মীরে ধারাবাহিক জঙ্গি অনুপ্রবেশের চেষ্টা এবং নাশকতা নিয়েও এমন কড়াভাষায় প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়নি সিপিএমকে।

অবশ্য পঞ্জাব এবং উত্তর-পূর্বের জঙ্গি সমস্যা নিয়ে অতীতেও সিপিএম নেতৃত্ব ‘কঠোর’ অবস্থান নিয়েছেন। ত্রিপুরায় আশির দশকে টিএনভি এবং নব্বইয়ের শেষপর্বে এনএলএফটি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতে নেমেছিলেন সিপিএম নেতা-কর্মীরা। ১৯৯৮ সালে জঙ্গিদের হামলায় খুন হয়েছিলেন ত্রিপুরার তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী বিমল সিংহ। খলিস্তান বিতর্কে সিপিএমের মোদী সরকারের পাশে দাঁড়ানো সেই ‘জঙ্গিবিরোধী অবস্থানে’রই পুনরাবৃত্তি বলে দলের একাংশের যুক্তি। তবে এই ঘটনার নেপথ্যে রাজনীতির ‘অন্য অঙ্ক’ রয়েছে বলেও দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে। কানাডার পার্লামেন্টে ‘খলিস্তান সমর্থক’ হিসাবে পরিচিত নেতাদের পাশাপাশি রয়েছেন ন’জন বাম সদস্যও। ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী’ হিসাবে পরিচিত ওই সদস্যদের মধ্যে কয়েক জনের সঙ্গে সিপিএমের ‘ঘনিষ্ঠ’ যোগাযোগ আছে। অনেকে বলছেন, সেই ‘আন্তর্জাতিক যোগাযোগ’ই শেষ পর্যন্ত ‘জাতীয়তাবাদী’ করে তুলল সিপিএমকে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE