রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রার কাঁধে চেপেই কি কংগ্রেসের কর্নাটক জয়? — ফাইল ছবি।
হিমাচল প্রদেশের পর কর্নাটকেও বড় জয়ের পথে কংগ্রেস। ঘড়ির কাঁটা দুপুর আড়াইটে পেরিয়েছে। দিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দফতরে অকাল দীপাবলির আবহে সাংবাদিকদের সামনে এসে দাঁড়ালেন রাহুল গান্ধী। ঢোল-নাকাড়ার শব্দ আর কংগ্রেস কর্মীদের গলা ফাটানো ‘রাহুল গান্ধী জিন্দাবাদ’ স্লোগানের বহরে বিশেষ কিছুই ভাল করে শোনা গেল না। তবুও রাহুল বললেন। নাতিদীর্ঘ সম্বোধনে সনিয়া-তনয় যা বললেন তার নির্যাস, ‘‘ঘৃণার বাজারে ভালবাসার (মোহব্বতের) দোকান খুলে গিয়েছে। কর্নাটকবাসীকে অভিনন্দন।’’
দেশ জুড়ে বিজেপির রমরমার সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’ কংগ্রেস হাতিয়ার করেছিল রাহুলেরই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’কে। অবশেষে রাহুলের সেই পদযাত্রার ফয়দা পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন কংগ্রেসের একাংশ। শনিবার ভোটগণনা শুরু হয় সকাল ৮টায়। ৮টা ৩৮ মিনিটে কংগ্রেসের টুইটার হ্যান্ডল থেকে ৫০ সেকেন্ডের একটি ভিডিয়ো পোস্ট করা হয়। ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুলের হেঁটে চলার ছবির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় ‘অ্যাম ইনভিনসিব্ল’ গানের বাছাই চারটি লাইন। যে লাইনগুলির মাধ্যমে রাহুলকে ‘অপ্রতিরোধ্য’ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। তখনই কর্নাটকে মহাগুরুত্বপূর্ণ ভোটের ফলাফলের সুর বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কর্নাটক জয়ের পিছনে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র কৃতিত্বকেই শিরোনামে তুলে আনছে কংগ্রেস।
২০২২-এর ৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণের কন্যাকুমারী থেকে ভারত জোড়ার পদযাত্রা শুরু করেছিলেন রাহুল। ১২টি রাজ্য, দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি তাঁর পদযাত্রা শেষ হয় জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগরে। সেই যাত্রার মধ্যে কর্নাটকও ছিল। মোট ২২ দিন জুড়ে।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর চামরাজনগর জেলার গুন্ডালুপেট দিয়ে কর্নাটকে প্রবেশ করেছিল ভারত জোড়ো যাত্রা। তার পর চামরাজনগর, মাইসুরু, মাণ্ড্য, টুমকুর, চিত্রদুর্গা, বেল্লারি এবং রাইচুড় হয়ে তা ঢোকে মহারাষ্ট্রে। মোট ২২ দিনে রাহুল পেরোন কর্নাটকের ৫০০ কিলোমিটার পথ। কর্নাটক বিধানসভায় বাজিমাত করার পিছনে এই ৫০০ কিলোমিটার পদযাত্রাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে কংগ্রেস। কারণ, ওই ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে পড়েছিল ৫১টি বিধানসভা আসন। বিকেল পর্যন্ত যা ফলাফল পুরোপুরি প্রকাশিত, তাতে দেখা যাচ্ছে ওই ৫১ আসনের ৩৬টিতেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। মাত্র ১৫টি আসনে পিছিয়ে তারা। সেই নিরিখে রাহুলের ‘স্ট্রাইক রেট’ ৭১ শতাংশ।
রাহুলের ভারত জোড়ো শুরু হওয়ার পর হিমাচল এবং গুজরাতের ভোট হয়েছে। হিমাচলে রাহুল এক দিনও প্রচারে যাননি। গুজরাতেও নমো-নমো করে প্রচার সেরেছিলেন। কিন্তু কর্নাটকে তিনি সময় দিয়েছিলেন। সে ভারত জোড়ো যাত্রাতেই হোক বা বিধানসভা ভোটের প্রচারে। রাহুলের সঙ্গে প্রচারে গিয়েছিলেন তাঁর বোন প্রিয়ঙ্কাও। ফলে সে অর্থে কর্নাটক ছিল রাহুলের ‘পরীক্ষা’। শনিবারের ফলাফল বলছে, সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ তিনি। বহু দিন পর দিল্লির কংগ্রেস দফতরে ঢাক-ঢোলের শব্দ। সঙ্গে সবুজ আবির খেলার ছবি। যা সাম্প্রতিক অতীতে প্রায় ভুলতে বসেছিলেন ‘হাত’ চিহ্নের কর্মী-সমর্থকেরা।
প্রত্যাশিত ভাবেই কংগ্রেস মনে করছে, ভারত জোড়ো যাত্রা যে উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু, কর্নাটক ভোটের ফলাফলে তারই প্রতিধ্বনি হয়েছে। কর্নাটকের মানুষ বিজেপির ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত জোড়ো যাত্রার সময় বিজেপিকে আক্রমণ করে রাহুল বলেছিলেন, ‘‘নফরত্ কি বাজ়ার মে মোহব্বত কি দুকান খোলনে চলে হ্যায়।’’ (ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে চলেছি), রাহুলের মুখে সেই কথাই শোনা গিয়েছে কর্নাটক জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর।
কংগ্রেসের নেতারা মনে করছেন, ভারত জোড়োর মাধ্যমে কর্নাটকে দ্বিধাবিভক্ত প্রদেশ কংগ্রেসকে একজোট করার ‘অসাধ্যসাধন’ করতে পেরেছেন রাহুল। সব বিভেদ ভুলে কোমর বেঁধে ময়দানে নেমে জয় নিশ্চিত করেছেন রাজ্য রাজনীতির দুই নায়ক— প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সিদ্দারামাইয়া এবং প্রদেশ সভাপতি ডিকে শিবকুমার। রাহুলের পদযাত্রা যে এলাকা দিয়ে গিয়েছে, সেই এলাকার তৃণমূল স্তরের কংগ্রেস কর্মীরা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। ভোটের ফলাফল দেখে অনেকে মনে করছেন, সেই উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা রাজ্যেই। একেবারে তলার স্তরের সংগঠনের সেই ‘গা-ঝাড়া’ দিয়ে ওঠার ফসলও ভাঁড়ারে পুরেছে কংগ্রেস। সংগঠন এত দিন ছিল বিজেপির একচেটিয়া। এ বার কর্নাটকে সেই ‘বুথ স্তরের সংগঠন’ গড়ার ঘরানায় দলকে সক্রিয় করে বিজেপিকে জবাব দিয়েছে কংগ্রেস। তাতে অনুঘটকের কাজ করেছে রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা।
তবে এর বিরোধী অভিমতও রয়েছে। যে মতামত বলছে, রাহুলের পদযাত্রা ‘নির্ধারক শক্তি’ হিসাবে কাজ করলেও কর্নাটকে বিজেপি সম্পর্কে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ মনোভাবও প্রবল ছিল। নইলে শুধু রাহুলের যাত্রা দিয়ে এতটা ভাল ফলাফল করা সম্ভব ছিল না। ওই অভিমতের প্রবক্তারা বলছেন, মানুষ রাহুলের সঙ্গে হেঁটেছেন ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশিই প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি এবং দুর্নীতির জোড়া ফলায় বিদ্ধ হয়েছে বিজেপি। যার কোনও জবাব ছিল না নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের কাছে। অনেকেই মনে করছেন, দুর্নীতি এবং মুদ্রাস্ফীতি প্রতিরোধে গ্রহণযোগ্য প্রতিশ্রুতির জায়গায় টিপু-বজরংবলীর লড়াই গ্রহণ করেনি কর্নাটকবাসী। যাকে রাহুল বর্ণনা করেছেন ‘ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান’ বলে! তারই ফলে দীর্ঘ দিন পর রাজধানীর ২৪ নম্বর আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরে অকাল দীপাবলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy