Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Kutubuddin Ansari

‘হিন্দু মানে ত্রাস নয়, বিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিয়েছিল কলকাতা’

কুতুবুদ্দিন আনসারি। সেই কুতুবুদ্দিন, গুজরাত দাঙ্গার ভয়াবহ দিনগুলোতে একটা দিকের মুখ হয়ে উঠেছিলেন যিনি।

কুতুবুদ্দিন আনসারি।

কুতুবুদ্দিন আনসারি।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
অমদাবাদ শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:১৭
Share: Save:

দেওয়াল ঘেঁষা চাপা গলি পেরিয়ে, দড়িতে ঝুলতে থাকা জামা-কাপড়ের পাশ কাটিয়ে ঘরটার সামনে পৌঁছলাম। এক চিলতে সরু সিঁড়ি, অন্ধকার। উপরে উঠে লম্বাটে ঘর। ঘরে ঢুকতেই হাত বাডি়য়ে দিলেন তিনি আর মুহূর্তে চমকে উঠলাম। নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল আশপাশ। রং-চটা দেওয়াল, তিনটে সেলাই মেশিন, ইতস্তত ছড়ানো কাপড়ের টুকরো, সাদা টেবিল, কাঁচি, ফিতে, টুল, জল খাওয়ার জন্য সফট ড্রিঙ্কসের পুরনো সবুজ বোতল— সব মিলিয়ে যেতে থাকল। এমনকী গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা একটা গোটা মানুষও এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে নেই। আমার সামনে এখন ১৫ বছর আগে দেখা সেই দুটো চোখ। এখনও একই রকম। একই রকম বাঙ্ময়, জীবনের জন্য একই রকম আকুতি তাতে। মাঝখানে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। আতঙ্কের সেই প্রত্যক্ষ ছাপটা শুধু অদৃশ্য তাই।

কুতুবুদ্দিন আনসারি। সেই কুতুবুদ্দিন, গুজরাত দাঙ্গার ভয়াবহ দিনগুলোর মুখ হয়ে উঠেছিলেন যিনি। গুজরাতের ভোট কভার করতে এসে এই মুহূর্তে তাঁর মুখোমুখি আমি।

তার আগে ফোন করেছিলাম কুতুবুদ্দিনকে। নিজের পরিচয় জানিয়ে বলেছিলাম, একবার দেখা করতে চাই। মিডিয়া এবং বহির্জগৎ সম্পর্কে ইদানীং স্পর্শকাতর কুতুবুদ্দিন এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কারণটা বুঝলাম এত ক্ষণে, ঘরে ঢুকতেই।

৯ অগস্ট ২০০৩, সপরিবারে হাওড়া স্টেশনে নামলেন কুতুবুদ্দিন। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। বললেন, ‘‘আপ কলকত্তা সে আয়ে হ্যায়, সমঝ মে নহি আ রহা হ্যায়, ক্যায়সে স্বাগত করুঁ আপকো।’’ দাঙ্গার সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর পরেপরেই কন্যা এবং অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী-সহ তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল কলকাতা। অতএব কৃতজ্ঞতার একটা বোধ থেকেই তিনি এমন কথা বললেন, এমনটাই মনে হল আমার। পরে বুঝলাম, এর চেয়েও বেশি কিছু আছে। কিন্তু সে কথা পরে। তার আগে এখন আমার হাতে জলের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছেন কুতুবুদ্দিন আনসারি।

স্ত্রী, ছেলের সঙ্গে কুতুবুদ্দিন এখন। ছবি: ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়।

অমদাবাদের মধ্যে দুটো অমদাবাদ রয়েছে। সবরমতীর এক পারে আধুনিক, ঝাঁ-চকচকে, বিপুল বৈভবের এক নগরী। অন্য পারে রয়েছে পুরনো শহর, ঘিঞ্জি, নোংরা, সঙ্কীর্ণ, পূতিগন্ধময়। সেই প্রান্তেই দীর্ণতর এক বসতি সোনি কি চালি। কুতুবুদ্দিনের বাড়ি সেখানেই এক ঘুপচি গলিতে। এক মেয়ে রুকাইয়া, দাঙ্গার সময় যাকে নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল কলকাতায়, গত বছরেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার। বাড়িতে এখন স্ত্রী তাহেরা বানো, ক্লাস টেনে পড়া ছেলে জিশান, ক্লাস ফাইভে পড়া ছোট মেয়ে জাকিয়া। পৈতৃক ভিটের অংশ বিক্রি করে পাওয়া টাকায় পাশেই ছোট্ট একটা বাড়ি তুলেছেন কুতুবুদ্দিন। বাড়ি বলতে একতলায় দেড়খানা ঘর। বড় ঘরের আয়তন মেরেকেটেও ১০ ফুট বাই ১০ ফুট হবে না। দোতলায় লম্বাটে ছোট ঘরেই সেলাইয়ের মেশিনগুলো, মাসিক আয়ের সংস্থান হয় যেখান থেকে। জিএসটি-র কল্যাণে গত কয়েকটা মাস ধরে যেখানে টান পড়েছে ভাল রকমই।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি কুতুবুদ্দিন আনসারি...

ফিরে আসি আবার সেই চোখে। ২০০২-এ অমদাবাদ শহরে দাঙ্গার দ্বিতীয় দিনে যখন আশেপাশে সর্বত্র আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে দাঙ্গাবাজরা, বাড়ির একতলাতে আগুন লাগো-লাগো প্রায়। বাড়ির সামনেই রাস্তায় দাঙ্গাবাজদের তুমুল চিৎকার, সুনসান এলাকায় শুধুই তাণ্ডবের উল্লাস। সেই সময় দোতলার ঘরে পরস্পরকে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপছেন তিনটে প্রাণী— কুতুবুদ্দিন, তাঁর বছর পাঁচ-ছয়ের মেয়ে এবং পেটে সন্তান এসে যাওয়া স্ত্রী। দরজার ছোট্ট একটা ফুটোয় চোখ রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন কুতুবুদ্দিন। বেঁচে থাকবেন কি না, বুঝতে পারছিলেন না। ওই ফুটো দিয়েই দেখতে পেয়েছিলেন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের একটা ভ্যান এগিয়ে আসছে। ‘‘সাব মুঝে বচাও’’— চিৎকার করে উঠেছিলেন ঘরের ভিতর থেকে। থেমে গিয়েছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের ভ্যান। ভিতরে অফিসার ও জওয়ানরা। এবং ছিলেন কয়েক জন সাংবাদিক। সাংবাদিকদের ওই দলে ছিলেন রয়টার্সের ফোটোগ্রাফার অর্ক দত্ত। ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন দু’জন অফিসার। মুহূর্তে দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলেন কুতুবুদ্দিন। হাতজোড় করে তীব্র আকুতি জানালেন— ‘‘সাব হমে বচা লো।’’ অর্কর ক্যামেরা কাজ শুরু করে দিয়েছিল ভ্যানের মধ্যে থেকেই। জন্ম নিল একটা ছবি, গড়ে উঠল ইতিহাস। কুতুবুদ্দিন আনসারি গুজরাত দাঙ্গায় আক্রান্তদের মুখ হয়ে দাঁড়ালেন। বাকিটা সবার জানা।

আরও পড়ুন: দেশের ভিতরেই ‘বর্ডার’! এক দিকে হিন্দু, অন্য দিকে মুসলমান

কাজে ব্যস্ত কুতুবুদ্দিন। অমদাবাদে ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

সে দিন ওই র‌্যাফের ভ্যানেই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন সপরিবার কুতুবুদ্দিন। তখনও শহর জুড়ে আগুন, কার্ফু, দাঙ্গা, আর্তনাদ এবং দুষ্কৃতীদের উল্লাসধ্বনি। তীব্র গ্লানি, ঘৃণা, মনুষ্যত্বের প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা গ্রাস করে নিচ্ছিল গোটা মন। আজন্ম লালিত হিন্দু-মুসলিম ভাইচারার যে বোধ, তাকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখছিলেন চারপাশে। বুঝতে পারছিলেন, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ওই বোধ তাঁর মনেও। যে মূল্যবোধগুলো নিয়ে বড় হয়ে উঠেছিলেন, ২৯ বছর বয়সেই তার বিনাশ দেখতে শুরু করেছিলেন কুতুবুদ্দিন। এমন সময়েই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরল। কুতুবুদ্দিন বলছিলেন, ‘‘ওই সময় আমি কলকাতায় না যেতে পারলে, আমি কী হয়ে যেতাম, নিজেই জানি না। ওই রকম রক্ত দেখা দিনগুলো পেরিয়ে যে ভাবে ওই শহর আমাকে কাছে টেনে নিল, সে কথা আমি সারা জীবনেও ভুলব না।’’

কলকাতায়, তিলজলার আশ্রয়ে কুতুবুদ্দিনের পরিবার (২০০৩)। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

এখানেই শেষ নয়। কুতুবুদ্দিন বলছেন, ‘‘আসলে কী জানেন, কলকাতা আমার জীবনের ভাবনাটাকেই ঘুরিয়ে দিল। যখন দেখলাম কিশোরভাই, লালজিভাই, মোহনভাইয়ের মতো লোকেরা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন, কাঁধে হাত রেখে বলছেন— আমরা তোমার পাশে আছি, তখন মনে হল, সব হিন্দু তো এক নয়। এঁরাও তো হিন্দু। মনুষ্যত্ব তা হলে মরে যায়নি।’’ যে মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল, যে ভাইচারার বোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, তার পুনর্জন্ম হল। কুতুবুদ্দিন মনে করেন, এই নতুন জীবনটা দিল কলকাতাই। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে কুতুবুদ্দিনের, সেই দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে। নিজের বাম উরুতে চাপড় মেরে বলেন, ‘‘জানেন, এইখানে বসে আমার ছ’বছরের মেয়ে ওই ছবিটা দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করত, বাবা তুমি কাঁদছ কেন? বিশ্বাস করুন, আমি যদি সেই সময়ে গুজরাতে থাকতাম, আমি ওকে বলেই দিতাম, এই দাঙ্গা, এই খুন-খারাবি, সমস্ত কথাই।’’ কিন্তু তত দিনে হৃদয়ে কলকাতা বসে গিয়েছে কুতুবুদ্দিনের। এবং সেই জন্যেই তিনি মেয়েকে বলেননি কিছুই। তাঁর মনে হয়েছিল, এত কম বয়সে ওই মেয়ের মনে কোনও বিষের বাষ্প যেন না ঢুকে পড়ে। শুধু বলেছিলেন, ‘‘বেটি, এক দিন বড় হয়ে তুমি নিজেই জানবে সব কিছু। এখন তোমার জানার দরকার নেই। আর কাঁদছি কোথায়? এই দেখ, আমি তো হাসছি। বলে ওর সামনে এক মুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম।’’ ওই হাসি কুতুবুদ্দিনকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কলকাতা।

আরও পড়ুন: ভোট দিয়ে ‘প্রচার’ মোদীর

সে দিন হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার সময়। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

কলকাতা ফিরিয়ে দিয়েছিল জীবনের প্রতি আগ্রহ। এমন সময় গুজরাত থেকে খবর এল, মা অসুস্থ। মা বললেন, বেটা তুমি চলে এস। ফিরে এলেন কুতুবুদ্দিন। ফিরে এলেন মা, বড় দাদা, আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী এবং সর্বোপরি গুজরাতের মাটির কাছে। কিন্তু যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হল না কলকাতার সঙ্গে। এখনও নিয়মিত কথা, মেয়ের বিয়েতে আমন্ত্রণ, ও দিক থেকেও ইদ পরবে শুভকামনা চলতেই থাকে অনর্গল। তবু কোথাও কম থেকে যায় বোধ হয় কুতুবুদ্দিনের। বেরিয়ে আসার সময় তাই বলেন, ‘‘সব সময় মনে হয়, কলকাতায় এক বার যাই। জেনে রাখুন, আমরা সবাই মিলেই যাব।’’ বুকে জড়িয়ে ধরেন। যেন ফিরিয়ে দিতে চান কিছু। আসলে তো ওই আলিঙ্গনটাও ওঁকে নতুন করে দিয়েছিল এই কলকাতাই।

গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE