ভোটের দিন প্রার্থীরা উত্কণ্ঠায়, কার বোতামে কত ভোট পড়ছে! পুলিশ কর্তারা চিন্তায়, কোথাও গণ্ডগোল বেধে গেল কিনা। নির্বাচন কমিশন ব্যস্ত সুষ্ঠুভাবে ভোটপর্ব সম্পন্ন করতে। সেই সময় কাছাড় জেলায় অন্য এক পরীক্ষা দিচ্ছিল শিলচর এনআইটি এবং কাছাড় জেলা প্রশাসন। ‘পোলফ্রেন্ড’ নামে এক অ্যাপসের পরীক্ষা। জেলা প্রশাসনের অনুরোধে অ্যাপসটি তৈরি করেছে শিলচর এনআইটি।
জেলাশাসক এস বিশ্বনাথনের পরীক্ষার কারণ, তিনিই নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এটি ব্যবহারের অনুমতি নিয়েছেন। সেই থেকে কমিশন এই অ্যাপস-এর কাজকর্মে নজর রাখছিল। শেষ পর্যন্ত কাজে না এলে তাঁকেই কমিশনের কাছে কৈফিয়ত দিতে হতো।এনআইটি আক্ষরিক অর্থেই পরীক্ষা দিল। সফল হলে মূল কৃতিত্ব যেমন তাঁদের হবে, তেমনই ব্যর্থ হলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল।
ভোটের ফলাফল জানার জন্য প্রার্থীদের ১৯ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু অ্যাপসের পরীক্ষার ফল নির্বাচন কমিশন জানিয়েই দিয়েছে। কমিশনের তথ্য-প্রযুক্তি শাখার অধিকর্তা বি এন শুক্ল ফোন করে কথা বলেছেন জেলাশাসক বিশ্বনাথনের সঙ্গে। এমন অ্যাপস ব্যবহারের জন্য তিনি তাঁকে অভিনন্দন জানান। শিলচর এনআইটি-রও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে কমিশন। এ বার একে সফল ‘পাইলট প্রোজেক্ট’ ধরে কমিশন ‘পোলফ্রেন্ড’-এর সার্বিক ব্যবহারের কথা যে ভাবছে, তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন শুক্ল। বিশ্বনাথন আশাবাদী, বর্তমান ভোটপর্ব মিটে গেলেই কমিশন এ নিয়ে কাজকর্ম শুরু করবে।
কী এই পোলফ্রেন্ড? বিশ্বনাথন জানান, ভোটের সময় ইভিএমের সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খালি মেশিন বা ভোটসুদ্ধ ইভিএমগুলি কোথায় কী অবস্থায় আছে তা জানতে প্রিসাইডিং অফিসারকে মোবাইলে ধরা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু জেলার সমস্ত প্রিসাইডিং অফিসারদের মোবাইলে ধরতে কন্ট্রোল রুমে কর্তব্যরত কর্মীদের বেশ পরিশ্রম করতে হয়। এর পরও সবাইকে সব সময় পাওয়া যায় না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র তথা জেলাশাসক বিশ্বনাথন ভাবলেন, ইভিএমগুলি কখন কোথায় যাচ্ছে, তা জানার জন্য কি কোনও ব্যবস্থা হতে পারে না! কথা বললেন এনআইটি-র ডিরেক্টর এনভি দেশপাণ্ডের সঙ্গে। ডেকে নেন ইলেকট্রনিক অ্যান্ড কম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ওয়াসিম আরিফকে। দু’জনেরই প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে ভোটের দিন কী কী করতে হয়, কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়, সে সব তাঁদের জানা।
আজ এনআইটি-তে বসে আরিফ জানান, ‘‘একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরে কাজ শুরু করি। নিজের বিভাগের চতুর্থ বর্ষের দুই ছাত্র হর্ষবর্ধন লাধা ও যোগেশ চহ্বাণ এবং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আকলাঙ্ক জৈন ক’দিন থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যায়। শেষে বেরোয়, শুধু ইভিএম-র খোঁজ কেন, এই অ্যাপসে এ ছাড়াও আরও বহু কাজ হতে পারে।’’
ভোটকর্মীরা ইভিএম পেল কিনা, ভোটকেন্দ্রে ইভিএম রওনা হল কিনা, কখন পৌঁছল, ভোটকেন্দ্রটির অবস্থা কেমন, পরদিন ভোটের জন্য তৈরি কিনা, ভোট শুরু করার সময় জানা এবং দু’ঘণ্টা পর মোট কত ভোট পড়ল, সবই জানা যাচ্ছে এই অ্যাপসের মাধ্যমে। ভোটযন্ত্র নিয়ে রওয়ানা হওয়ার সময় এবং জমা দেওয়ার সময়ও এই অ্যাপসেই ধরা থাকবে।
বিষয়টি পছন্দ হয় জেলাশাসক বিশ্বনাথনের। তিনি সমস্ত তথ্য দিয়ে তাঁদের সাহায্য করতে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার প্রেরণা শর্মাকে দায়িত্ব দেন। চলতে থাকে গবেষণাধর্মী কাজকর্ম। বারাণসীর হর্ষ, দিল্লির যোগেশ এবং চণ্ডীগড়ের আকলাঙ্ক জানান, এই কাজে ঝুঁকি ছিল। যে সব তথ্যের ভিত্তিতে অ্যাপস তার কাজ করবে, ঠিক সেগুলি পরীক্ষার সময় ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি ছিল ইভিএম নম্বর এবং প্রিসাইডিং অফিসারদের মোবাইল নম্বর জানা। কারণ ইভিএমের নম্বরই ছিল প্রতিটি সিমের পাসওয়ার্ড। ইভিএম পেয়ে ওই নম্বর ব্যবহারের পরই অ্যাপস তার কাজ শুরু করবে। কিন্তু ভোটসামগ্রী বিতরণের আগে কোন প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে কোন ইভিএম যাবে, কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। এর পরও পরীক্ষায় উতরে যাওয়ায় খুশি সব পক্ষ।
এস বিশ্বনাথন ও প্রেরণা শর্মা জানান, এনআইটি বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করায় কাজটি সম্ভব হয়েছে। নতুন অ্যাপস তৈরির পর প্রিসাইডিং অফিসারদের মোবাইলে না হয় নিজের সিমকার্ডের বদলে এটি ঢুকিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু তাঁরা তা চালাবেন কী করে! এ জন্য প্রশিক্ষণের দায়িত্বও এনআইটি নিজের কাঁধে তুলে নেয়।
প্রথম বর্ষের ২০জন ছাত্রকে লাগানো হয়। প্রথমে সেক্টর অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কারণ প্রিসাইডিং অফিসাররা কোনও সমস্যার কথা বললে তা একই সঙ্গে সেক্টর অফিসার, জেলাশাসক ও কন্ট্রোল রুমের মোবাইল স্ক্রিনে দেখা যাবে। ওই ছাত্ররাই পরে প্রশিক্ষণ দেন জেলার ১২৮১জন প্রিসাইডং অফিসারকে।
এমনকী, ভোটের দিন এ কাজে এনআইটি-র সার্ভারই ব্যবহার করা হয়। কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ডিরেক্টর দেশপাণ্ডে, ওয়াসিম আরিফ সারাক্ষণ বসে থাকেন। যে কোনও সমস্যার সমাধানে তাঁরাই এগিয়ে আসেন। অ্যাপস তৈরি ও ব্যবহারের পুরো প্রক্রিয়ায় জেলা প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের এক কানাকড়িও খরচ হয়নি, জানালেন বিশ্বনাথন।
প্রেরণা জানান, ‘‘এই কাজ করতে গিয়ে বেশ মজার ব্যাপারও ঘটেছে। কোনও কোনও প্রিসাইডিং অফিসার বুথে না গিয়েই পৌঁছে যাওয়ার মেসেজ পাঠাচ্ছিলেন। তাঁদের তখন জানিয়ে দিই, আপনি পৌঁছননি। আরও দুই কিলোমিটার দূরে রয়েছেন। তাঁরা বিস্মিত হয়ে যান, ম্যাডাম কী করে জেনে গেলেন!’’
বেশ ক’জন প্রিসাইডিং অফিসারের স্মার্টফোন ছিল না। তাঁরা অ্যাপসের সাহায্যে জেলাশাসক সব সময় খোঁজ রাখবেন জেনে দ্রুত ফোন বদলান। কেউ কেউ মোবাইল কিনে সোজা হাজির হন জেলাশাসকের অফিসে। স্মার্টফোন চালানো শিখিয়ে দেওয়ার আর্জি জানান। এর উপকারও মিলেছে। লক্ষীপুরের এক বুথে গণ্ডগোলের আশঙ্কা দেখা দিলে এই অ্যাপসের সাহায্যেই দ্রুত রক্ষী পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। এক সঙ্গে তিন জায়গায় ওই বার্তা যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে রক্ষী পৌঁছয়। ভোটিং মেশিন খারাপ, ব্যাটারি বদলাতে হবে ইত্যাদি খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিয়েছেন তাঁরা, জানান বিশ্বনাথন।
তবে সমস্যা একেবারে যে নেই, তাও নয়। অনেক জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক না-পাওয়ায় ‘পোলফ্রেন্ড’ কাজ করেনি। সে ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসারদের দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়েছে। বহু চেষ্টা করেও তাঁরা রিপোর্ট করতে পারছিলেন না। পরে অবশ্য সেক্টর অফিসাররা গিয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করেন। বিশ্বনাথনের কথায়, ‘‘প্রিসাইডিং অফিসার যোগাযোগ করতে না পারলেও কন্ট্রোল রুমে বসে তাঁর ইভিএমের অবস্থান জানতে পারছিলাম আমরা। এ এক বড় ব্যাপার। এই প্রয়োজনেই তো অ্যাপসের কথা উঠেছিল।’’
তাই কাছাড়ের জেলাশাসক আশা করছেন, নির্বাচন কমিশন ‘পোলফ্রেন্ড’-র সার্বিক ব্যবহার চাইবে। আশায় শিলচর এনআইটি-ও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy