ফাইল চিত্র।
কালো কোট পরা দুই ‘আইনজীবীর’ হাতের ফাইলগুলো দেখেই প্রথম বার সন্দেহটা হয়েছিল তুষার মানের। দিল্লির রোহিণী আদালতে প্র্যাকটিস করা আইনজীবী তুষার বলছিলেন, ‘‘ভাবছিলাম, এরা কী রকম উকিল? হাতে ফাইল আছে, অথচ ফাইলে কোনও কাগজ নেই! ফাঁকা ফাইল নিয়ে কোনও আইনজীবী আদালতে আসে?’’
তুষারের সন্দেহ আরও বাড়ে ২০৭ নম্বর আদালত কক্ষে বিচারক গগনদীপ সিংহের এজলাসে ফের ওই দু’জনকে দেখে। তিনি বলছিলেন, ‘‘বিচারক আসা মাত্রই আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু ওই দু’জন বসেই রইল। তখন ভেবেছিলাম, আইনকে এরা কোনও সম্মানই করে না। তার পর তো ওই দু’জনই গুলি চালাতে শুরু করল। বিচারক নিজের চেম্বারের দিকে দৌড়লেন। আমরাও দৌড়ে আদালত থেকে বেরিয়ে এলাম।’’
পরের ঘটনা গোটা দুনিয়া জানে। আইনজীবীর ভেক ধরা ওই দু’জনের গুলিতেই গত কাল আদালতের মধ্যে মারা যায় দিল্লির গ্যাংস্টার জিতেন্দ্র মান ওরফে গোগী। তার পর কোর্ট চত্বরে দিল্লি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা পড়ে রাহুল ও মরিস নামে দুই খুনি। এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, ‘‘বিচারক একটা ফাইল পড়ছিলেন। এমন সময়ে গোগীকে আদালতে আনা হল। পুলিশ গোগীকে তার মাথার সাদা টুপিটা খুলতে বলল। গোগী সবে টুপি খুলে মাস্ক পরতে যাবে, ঠিক তখনই ওই দু’জন গুলি চালাল।’’
একটি জেলা কোর্ট চত্বর পুরোদস্তুর গ্যাংওয়ারের অকুস্থলে বদলে গেল কী করে, সেই প্রশ্নটাই এখন সবচেয়ে জোরালো হয়ে উঠেছে। মেটাল ডিটেক্টর থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে পিস্তল নিয়ে আদালতে ঢুকল দুই আততায়ী? গোগীর সঙ্গে থাকা দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স টিম তাকে বাঁচাতে পারল না কেন? প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের হামলার আশঙ্কা (যা ছিল বলেই শোনা যাচ্ছে) সত্ত্বেও কেন জেল থেকে ভিডিয়ো কনফারেন্সে তার হাজিরার ব্যবস্থা করা গেল না? গ্যাংওয়ারের বদলে এটা জঙ্গি হামলাও তো হতে পারত! রোহিণী বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইন্দর সিংহ সরোহা বলছিলেন, ‘‘পুরোটাই নিরাপত্তার গাফিলতি। রোহিণী কোর্টে গ্যাং সংক্রান্ত অনেক মামলার শুনানি হয়। এখানে দিল্লি হাই কোর্টের মডেলে নিরাপত্তা দরকার। কোর্টে আসা মামলাকারীদের জন্য পাস চালু করা, কোর্টে ঢোকার আগে সমস্ত গাড়ির তল্লাশি, এমনকি আইনজীবীদেরও তল্লাশি করা দরকার।’’
কিন্তু তল্লাশিতে কি আইনজীবীরাই রাজি হন? এক পুলিশ অফিসার বললেন, ‘‘দেখা গিয়েছে, আইনজীবীরাই চান না, তাঁদের দেহতল্লাশি করা হোক। এটা শুধু রোহিণী নয়, অন্য নিম্ন আদালতেরও সমস্যা। তবে আমরা রোহিণীর বার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তাঁরা সহযোগিতা করছেন।’’ এ দিন চোখে পড়ার মতোই নিরাপত্তা বেড়েছে রোহিণী আদালতের। পুলিশ জানিয়েছে, আইনজীবী থেকে শুরু করে সকলকেই তল্লাশির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। শুধুমাত্র বৈধ স্টিকার লাগানো গাড়িকেই ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হবে। সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো, আদালতের প্রতিটি তলায় সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি মেটাল ডিটেক্টরের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
আজ অবশ্য দিল্লির সমস্ত জেলা আদালতের আইনজীবীরা কর্মবিরতি পালন করেছেন। জরুরি মামলা ছাড়া আর কোনও কাজ হয়নি আদালতে। নিম্ন আদালতগুলির নিরাপত্তা বাড়ানোর আর্জি জানিয়ে এ দিন সুপ্রিম কোর্ট এবং দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন দু’জন আইনজীবী। গত জুলাইয়ে ধানবাদের একটি আদালতের বিচারক উত্তম আনন্দ অটোর ধাক্কায় প্রাণ হারানোর পরে আদালত ও বিচারকদের সুরক্ষার বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই মামলার সূত্রেই বিশাল তিওয়ারি নামে এক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়ে বলেছেন, নিম্ন আদালতগুলির নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হোক। দাগি অপরাধীদের শুনানি ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমেই করা হোক। দিল্লি হাই কোর্টে আইনজীবী দীপা জোসেফ আবেদন জানিয়েছেন, আদালত চত্বরে প্রত্যেক আইনজীবীর পরিচয়পত্র পরীক্ষা করা হোক। সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লি হাই কোর্টের সম মানের নিরাপত্তার কড়াকড়ি চালু হোক নিম্ন আদালতেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy