কয়েক লক্ষের মৃত্যু ‘অজানা কারণে’। —ফাইল চিত্র।
অতিমারিতে হিসেব একটু এ দিক ও দিক হতেই পারে। কিন্তু পরিসংখ্যান লুকোনোর কোনও প্রশ্ন নেই। আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের কোভিড পরিসংখ্যান নিয়ে যখন কাটাছেঁড়া চলছে, মৃত্যু কমিয়ে দেখানোর অভিযোগ উঠছে, সেই সময় নয়াদিল্লির তরফে এমনই সাফাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ বার কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যানে বড় রকমের ফাঁকফোকর সামনে এল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় যখন দেশে টালমাটাল অবস্থা, সেই সময় এপ্রিল এবং মে মাসে এমন কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাঁদের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা নেই। সরকারি পরিসংখ্যানেই তাঁদের নামের পাশে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোথাও ‘জ্বর’ এবং কোথাও ‘অজ্ঞাত কারণ’ লেখা রয়েছে। শুধু তাই নয়, শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাকে যখন করোনার উপসর্গ হিসেবে ধরা হচ্ছে, সেই সময় শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ নিয়েও বহু মানুষ মারা গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের করোনা পরীক্ষা হয়েছিল কী হয়নি, সে ব্যাপারে কোনও তথ্য নেই সরকারের কাছে।
শহরাঞ্চল এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৩ সালে জাতীয় স্বাস্থ্য প্রকল্প (ন্যাশনাল হেল্থ মিশন) শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার। ওই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হেল্থ ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম (এইচএমআইএস), যার মাধ্যমে প্রায় ২ লক্ষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যাবতীয় পরিষেবা এবং কাজকর্মের হিসেব রাখা হয়। আর তাতেই কেন্দ্রের কোভিড পরিসংখ্যান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ এইচএমআইএস-এর কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, অতিমারির আগে ২০১৯ সালের মে মাসে যত জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন ২০২১-এর মে মাসে তার চেয়ে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ বেশি মারা গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মে মাসে করোনায় মারা গিয়েছেন ১ লক্ষ ২০ হাজার ৭৭০ মানুষ। ওই একই মাসে অজ্ঞাত কারণে তার প্রায় আড়াই গুণ বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন।
জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের ওয়েবসাইটে মূলত গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে। তবে কিছু বেসরকারি এবং শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তথ্যও রয়েছে সেখানে। অনেক ক্ষেত্রেই শহরাঞ্চলের মৃত্যুর নথি সময়ে জমা পড়ে না তাদের কাছে। সে ক্ষেত্রে মৃত্যুর শংসাপত্র মিলিয়ে আলাদা হিসেব করা হয়। কিন্তু করোনা হানা দেওয়ার পর তাদের পরিসংখ্যানেই আকাশ পাতাল তফাত দেখা গিয়েছে। করোনা হানা দেওয়ার আগে ২০১৯ সালে প্রত্যেক মাসে দেশে গড়ে দুই থেকে দু’লক্ষ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানিয়েছে তারা। কিন্তু ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে তা বেড়ে ৩ লক্ষ ১০ হাজারে পৌঁছয়। মে মাসে তা আরও বেড়ে হয় ৫ লক্ষ ১১ হাজারে। ২০২০ সালের মে মাসের তুলনায় যা ১৭৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের মে মাসের তুলনায় বেশি প্রায় ১৫০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, মে মাসে ৩ হাজারের বেশি সন্তানসম্ভবা মহিলার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে যা কি না ২০১৯ সালের মে মাসের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেশি।
ওই তথ্যে ঘেঁটে আরও দেখা গিয়েছে যে, ২০২১ সালের মে মাসে দেশে প্রায় ৪ লক্ষ ৯২ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ২ লক্ষ ৫০ হাজারের মৃত্যুর কারণই জানা যায়নি। মৃত্যু শংসাপত্রে তাঁদের নামের পাশে ‘অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু’ লেখা রয়েছে। বাকিদের অধিকাংশের নামের পাশে মৃত্যুর কারণ লেখা রয়েছে জ্বর এবং শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা। মৃতদের কারও করোনা পরীক্ষা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে কোনও তথ্য দেওয়া নেই। কিন্তু মে মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন তুঙ্গে, তখন কেন বিশদ তথ্য নেই তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ছত্তীসগঢ়ের গ্রামীণ স্বাস্থ্য বিভাগের আধিকারিক যোগেশ জৈন বলেন, ‘‘এই সমস্ত মৃত্যুকে কোভিডে মৃত্যু হিসাবেই ধরা উচিত। মে মাসে যখন করোনায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছিল, সেই সময় নিশ্চয়ই ম্যালেরিয়ায় এত লোকের মৃত্যু হয়নি।’’ হিসাবের এই গরমিল নিয়ে কেন্দ্রের এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন, ‘‘কোভিডে মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেন্দ্র শুধু যাবতীয় তথ্য এক জায়গায় এনে তা প্রকাশ করে। যাবতীয় তথ্য আসে রাজ্য সরকারগুলির কাছ থেকে। ফলে সেই সব হিসাবে গণ্ডগোল থাকলে কেন্দ্রের প্রকাশিত হিসাবেও গরমিল থাকতে বাধ্য।’’
ভারতে কোভিডে মৃত্যু কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকেও একাধিক বার অভিযোগ সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদিও এই অভিযোগ মানতে নারাজ। অতিমারিতে হিসাবের ‘সামান্য ভুল’ হয়ে থাকতে পারে বলে দাবি তাদের। যদিও সমালোচকদের দাবি, গরমিলের প্রাতিষ্ঠানিক দায় এড়াতে পারে না কেন্দ্র। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের ওয়েবসাইটে সিংহভাগ বেসরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। গ্রামীণ এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যই তারা প্রকাশ করে। সে ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যার ধারেকাছেও পৌঁছনো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy