Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
National News

মোদী-আবের ‘বুলেট’ জোট, যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট বার্তা চিন-পাকিস্তানকে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আজ বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাস করলেন। ভারত-জাপান দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও বাড়ানোর কথা ঘোষণা করলেন দুই প্রধানমন্ত্রী।

এই ছবি চাপ বাড়াচ্ছে ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের উপরে। ছবি: এএফপি।

এই ছবি চাপ বাড়াচ্ছে ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের উপরে। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৭:৪৮
Share: Save:

গুজরাতের সবরমতী স্টেশন থেকে ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাস করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। বুলেট ট্রেন নিঃসন্দেহে একটা বড় মাইলফলক হতে হতে চলেছে ভারতের উন্নয়নে। কিন্তু জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত সফরে নরেন্দ্র মোদীর লক্ষ্যটা আরও বড়। শিনজো আবেকে পাশে নিয়ে নরেন্দ্রী মোদী বৃহস্পতিবার উত্তর এবং পশ্চিমের দুই প্রতিবেশীকে আরও গুরুতর একটা বার্তা দিয়ে দিলেন। ভারতের দ্রুত উন্নয়নে জাপান তো শরিক হবেই, সন্ত্রাসবাদ, পরমাণু শক্তির আস্ফালন এবং অন্য যে কোনও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ভারত-জাপান হাত মিলিয়ে কাজ করবে— মোদী-আবে খুব স্পষ্ট করে এই বার্তা দিলেন এ দিন। লস্কর, জইশের মতো জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ের কথাও ঘোষণা করলেন তাঁরা। ভারত-জাপানের এই যৌথ বিবৃতি ইসলমাবাদের উপর চাপ তো বাড়ালই। বাড়িয়ে দিল বেজিঙের অস্বস্তিও। বলছেন কূটনীতিকরা।

প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা খরচে তৈরি হচ্ছে মুম্বই আহমেদাবাদ বুলেট ট্রেন প্রকল্প। জাপানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, ২০২৩ সাল নাগাদ এই পর্কল্প শেষ হবে। কিন্তু ভারত সরকার জানাচ্ছে, ২০২২ সালের মাঝামাঝিই শেষ করা হবে কাজ। কারণ স্বাধীনতার ৭৫ বছর ২০২২ সালে। সে বছরের ১৫ অগস্টই বুলেট ট্রেনের উদ্বোধন চান মোদী। এই প্রকল্পের জন্য ভারতকে ৮৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জাপান। তবে অত্যন্ত কম সুদে, মাত্র ০.১ শতাংশ হারে। প্রকল্পটির জন্য জাপান থেকে অন্তত ১০০ জন ইঞ্জিনিয়ার এবং বিশেষজ্ঞ ইতিমধ্যেই ভারতে চলে এসেছেন। খুব দ্রুত প্রকল্পের কাজ এগোবে বলে রেল মন্ত্রক জানাচ্ছে।

বোতাম টিপে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাসে দুই প্রধানমন্ত্রী। ছবি: রয়টার্স।

বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলন্যাসের পরে বৃহস্পতিবার শিনজো আবে যে ভাষণ দিয়েছেন, তার কয়েকটা লাইন কিন্তু খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে, বুলেট ট্রেন প্রকল্প ভারত-জাপান দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ছোট্ট একটা অংশ। নয়াদিল্লি এবং টোকিওর নজর আসলে এশিয়ার বুকে অন্য কোনও শক্তিকে একতরফা দাপট কায়েম করতে না দেওয়া। তাই শিলান্যাসের পরেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘‘জাপানের জন্য শক্তিশালী ভারত ভাল আর ভারতের জন্য ভাল শক্তিশালী জাপান।’’

গত তিন বছরে শিনজো আবে এবং নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে এটি দশম সাক্ষাৎ। ভারত এবং জাপান পারস্পরিক সহযোগিতাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়, এই পরিসংখ্যানই তা অনেকটা স্পষ্ট করে দেয়। নরেন্দ্র মোদী এই দিনকে ভারত এবং জাপানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ঐতিহাসিক দিন’ আখ্যা দিয়েছেন। জাপানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মোদী বলেছেন, ‘‘জাপান আজ প্রমাণ করল ভারত-জাপান মৈত্রীর প্রতি তারা কতটা দায়বদ্ধ।’’

আরও পড়ুন: ‘বুলেট’ নিয়ে লড়াই মোদীর সঙ্গে কংগ্রেস, শিবসেনার

ভারতের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, ভারত এবং জাপানের মধ্যে এই দফায় মোট ১৫টি চুক্তি ও মউ স্বাক্ষর হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের চোখ কিন্তু মূলত সে দিকেই। সামরিক এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত-জাপান সমঝোতা আরও বাড়ার যে ইঙ্গিত শিনজো আবের এই ভারত সফর থেকে মিলছে, সে দিকেই তাকিয়ে চিন, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশ। উত্তর কোরিয়া যে ভাবে পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, কঠোরতম ভাষায় তার নিন্দা করেছেন মোদী-আবে। ভারত-জাপান যৌথ বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়াকে যে ভাষায় বার্তা দেওয়া হয়েছে, পিয়ংইয়ং-এর বিরুদ্ধে ততটা কড়া বয়ান নয়াদিল্লি আগে কখনও দেয়নি। জাপানের নিরাপত্তার প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নেই যে ভারতের এই কঠোর অবস্থান, তা নিয়ে কূটনীতিকদের সংশয় নেই। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও যে ভারত-জাপান হাত মিলিয়ে লড়বে, তাও যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আল কায়দা, আইএস, জইশ-ই-মহম্মদ, লস্কর-ই-তৈবা-সহ বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াই আরও জোরদার করতে পঞ্চম জাপান-ভারত কনসাল্টেশন আয়োজনের কথাও মোদী এবং আবে ভাবছেন বলে জানানো হয়েছে।

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত ও জাপান হাত মিলিয়ে কাজ করবে এবং সামরিক সহযোগিতা আরও বড়াবে বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বেজিঙের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। ছবি: পিটিআই।

মোদী-আবের যৌথ বিবৃতিতে লস্কর-ই-তৈবা এবং জইশ-ই-মহম্মদের নাম করে যে ভাবে কড়া বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তা পাকিস্তানের উপর চাপ আরও বাড়াবে। এই দুই জঙ্গি সংগঠন পাকিস্তানি ভূখণ্ড থেকেই কাজ চালায়। আমেরিকা বার বার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে ইসলামাবাদকে। সম্প্রতি বেজিঙে আয়োজিত ব্রিকস সম্মেলন থেকেও এই দুই পাক জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা আদায় করে নিয়েছে ভারত। এ বার জাপানের গলাতেও একই সুর। শুধু লস্কর আর জইশের বিরুদ্ধে লড়ার অঙ্গীকার করেই থামল না জাপান। যৌথ বিবৃতিতে জানাল, মুম্বই এবং পঠানকোটের জঙ্গিহানায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে পদক্ষেপ করতেই হবে।

বেজিং অবশ্য সবচেয়ে বিব্রত হচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে শিনজো আবের মন্তব্যে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী।’’ অনেককে চমকে দিয়ে আবে আরও বলেছেন, ‘‘আমাদের মধ্যে যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে, এই পৃথিবীতে আর কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক ততটা সম্ভাবনাময় নয়।’’ ভূ-কৌশলগত, কূটনৈতিক, সামরিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক কারণেই যে ভারত এবং জাপান পরস্পরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মিত্র হতে পারে, আবে এ দিন সে কথাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

আরও পড়ুন: পরমাণু বোমা মেরে সমুদ্রে ডোবানো হবে জাপানকে, হুমকি উত্তর কোরিয়ার

ভারত-জাপানের এই দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচি নিয়ে চিনের প্রতিক্রিয়া মোটেই ইতিবাচক নয়। এই সব কর্মসূচি আসলে ভারত-জাপানের ‘মরিয়া মানসিকতা’র পরিচয় দিচ্ছে, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে এই রকমই লেখা হয়েছে বৃহস্পতিবার। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত এবং জাপান পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে বা জাপান এবং ভারতের সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বা ‘শক্তিশালী ভারত-শক্তিশালী জাপান’ তত্ত্বের কথা এ দিন যে ভাবে বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছে মোদী ও আবের মুখে, তাতে বেজিঙের অস্বস্তি বাড়তে বাধ্য। গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং এশিয়া-প্যাসিফিকে নিজেদের একচ্ছত্র দাপট প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চিন বার বার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে যাদের কাছ থেকে, সেই দুই দেশ ভারত এবং জাপানই। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার স্বার্থে সেই দুই দেশ যখন একজোট হওয়ার কথা জোর দিয়ে ঘোষণা করছে, তখন বেজিঙের রক্তচাপ বাড়াই স্বাভাবিক, বলছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

উত্তর কোরিয়া প্রশ্নেও চাপ বাড়ল চিনের উপর। কিম জং উনের আস্ফালনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। ফলে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে তাদের অসন্তোষ স্বাভাবিক। কিন্তু এই দুই দেশকে বাদ দিলে, আমেরিকা ছাড়া আর কেউ উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে সে ভাবে মাথা ঘামাত না। এ দিন কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে ভারতও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বেনজির কড়া অবস্থানের কথা জানিয়ে দিল। ভারতের মতো বড় শক্তি তথা এশীয় শক্তি এ বার সরাসরি উত্তর কোরিয়া বিতর্কে নাক গলানোর ইঙ্গিত দিতে শুরু করায় চিনের অস্বস্তি বাড়তে বাধ্য। মিত্র উত্তর কোরিয়াকে আন্তর্জাতিক অসন্তোষের হাত থেকে রক্ষা করা চিনের পক্ষে আরও একটু কঠিন হয়ে উঠল। শিনজো আবের এই ভারত সফরে এশিয়ার রাজনীতিতে চিন-পাকিস্তান-উত্তর কোরিয়ার বিপরীতে ভারত-জাপান দক্ষিণ কোরিয়া সমীকরণ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE