অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
সীমান্ত সঙ্ঘাতের জেরে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল ২০২০ সালেই। দেশ জুড়ে ডাক উঠেছিল চিনা পণ্য বয়কটের। সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বহু চিনা অ্যাপ। চিনা মালপত্র আমদানিতেও কোপ দেওয়ার বার্তা আসছিল সরকারের তরফে। এত কিছুর পরেও ২০২০ সালেই আমেরিকাকে টপকে ফের ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ হিসেবে উঠে এল চিন। কোভিডের প্রকোপে উদ্ভুত অতিমারি এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও চিনের সঙ্গে প্রায় ৭ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক লেনদেন বয়েছে ভারতের, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৫ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে চিন থেকে পণ্যই কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৮৭০ কোটি ডলারের, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৪ লক্ষ ২৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।
যন্ত্রপাতির জন্য অন্য কোনও দেশের উপর ভরসা করে না থেকে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঘুড়ির মাঞ্জা থেকে দীপাবলির আলো, সস্তার বিদেশি পণ্য ছেড়ে দেশীয় পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে যে ছবি উঠে আসছে, তাতে দেখা গিয়েছে, চিন তো বটেই, আমেরিকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে ভারতকে। সেই তুলনায় ভারত থেকে নামমাত্র পণ্যই কেনার প্রয়োজন পড়ছে ওই দেশগুলির।
কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রক থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে অর্থনৈতিক সংস্থা ব্লুমবার্গ। তাতে দেখা গিয়েছে, চিনের পাশাপাশি আমেরিকা এবং সংযুক্ত আমিরশাহির সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত। কিন্তু চিনের উপর ভারতের নির্ভরশীলতা তুলনামূলক বেশি। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালেও চিনই ছিল ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ। ২০১৯-এ তাদের টপকে গিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু ২০২০ সালে ফের ভারতের শীর্ষ বাণিজ্য সহযোগী দেশ হিসেবে উঠে এসেছে চিন।
ব্লুমবার্গ যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, সেই অনুযায়ী, ২০১৭ সালে চিনের সঙ্গে ৬ লক্ষ ১৩ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার (৮ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার) বাণিজ্যিক লেনদেন হয়েছিল ভারতের। ওই বছর আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৭ কোটি টাকা (৭ হাজার ৮০ কোটি ডলার)। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে ওই বছর ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার (৫ হাজার ৩১০ কোটি ডলার) লেনদেন হয় ভারতের।
২০১৮ সালেও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনে অন্য দেশকে পিছনে ফেলে দেয় চিন। শুধু তাই নয়, আগের বছরের তুলনায় লেনদেনের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যায়। ওই বছর ভারত ও চিনের মধ্যে ৬ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকার (৯ হাজার ৪০ কোটি ডলার)। আমেরিকার সঙ্গে বছর ৬ লক্ষ ২০ হাজার ৩০৬ কোটি টাকার (৮ হাজার ৫৬০ কোটি ডলার) লেনদেন হয় ভারতের। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে সে বছর লেনদেন হয়েছিল ৪ লক্ষ ৩ হাজার ১৫৯ কোটি টাকার (৫ হাজার ৫৬০ কোটি ডলার)।
এর পর ২০১৯ সালে চিনকে পিছনে ফেলে দেয় আমেরিকা। সে বছর ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ৬ লক্ষ ৫২ হাজার ৯১৫ কোটি টাকার (৯ হাজার ১০ কোটি ডলার) লেনদেন হয়। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৬ লক্ষ ১৯ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা (৮ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার)। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে সে বছর ভারতের ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকার (৬ হাজার ৩০ কোটি ডলার) লেনদেন হয়।
২০১৯ থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও প্রকট হয়ে ধরা দেয়। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সেই সময় দেশীয় পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার পর দেশ জুড়ে চিনা পণ্য বয়কটের ডাক ওঠে। তাতে দু’দেশের মধ্যে তিক্ততা দেখা দেয়। সে বছর অক্টোবরে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের ভারত সফরের পর ক্ষতে খানিকটা প্রলেপ পড়লেও, ২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে ড্রাগনের সঙ্গে সঙ্ঘাতে দুই দেশের কূটনৈতিক সঙ্ঘাত আরও তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
সীমান্ত সঙ্ঘাতের জবাবে একাধিক চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে বেজিংয়ের বিরাগভাজন হয় দিল্লি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে তাইওয়ানের একটি সংস্থার হয়ে ভারতে কারখানা নির্মাণে যে চিনা ইঞ্জিনিয়ারদের আসার কথা ছিল, তাঁদের ভিসা প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হয়ে যায়। তার উপর বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপেও পড়শি দেশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে ভারতের। চিনের উহান থেকেই গোটা বিশ্বে করোনা ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ তুলতে থাকে একাধিক দেশ। কিন্তু সেই সময় ভারতের তরফে এ নিয়ে কোনও পক্ষ নেওয়া হয়নি। বরং চিনের এক বিজ্ঞানী সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতের ঘাড়েই দোষ ঠেলেন।
তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় টাকার অঙ্ক কম হলেও ২০২০-তে, ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ হিসেবে ফের নিজের জায়গা ফিরে পেয়েছে চিন। গত বছর দু’দেশের মধ্যে ৫ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যিক লেনদেন হয়। সেই তুলনায় আমেরিকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে ভারতের লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা (৭ হাজার ৫৯০ কোটি ডলার) এবং ৩ লক্ষ ৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা (৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার)।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আমেরিকা, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাও বা ভৌগলিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, পড়শি হিসেবে ভারত ও চিনের পারস্পরিক একটা বোঝাপড়া রয়েছে। তাই ২০২০ সালে সীমান্ত সঙ্ঘাত, অতিমারি এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভারত এবং চিন একে অপরের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরিমাণে কম হলেও অতিমারি পরিস্থিতিতে ভারত থেকে পণ্য আমদানি ১১ শতাংশ বাড়িয়েছে চিনও। গত বছর ভারতের কাছ থেকে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার (১৯০০ কোটি ডলার) পণ্য কিনেছে তারা। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, ণিজ্য ক্ষেত্রে দুই পড়শি দেশের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা খুব শীঘ্র মিলিয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy