গ্রাফিক: শৌভক দেবনাথ।
বিরল এক পরিস্থিতিতে রায় ঘোষণা করতে চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। দেশের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশ আজ। অর্থাৎ, এর আগেও ১৬ বার সাধারণ নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছে ভারত। কিন্তু ইভিএম বদলের চেষ্টার অভিযোগ সমস্বরে তুলে ধরে ভোট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে এ বার যে বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে সম্মিলিত বিরোধী শিবির, ফলপ্রকাশের দিনে এই রকম এক সংশয়ের প্রেক্ষাপট স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বেনজির। ভোটগণনার সময়ে হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রত্যেকটি রাজ্যে যে ভাবে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে দেশের সরকার, তা-ও বেশ চমকে দিয়েছে গোটা দেশকে।
শাসক দলের বিরুদ্ধে কারচুপির চেষ্টার অভিযোগ বিরোধীদের, নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং শাসকের তরফ থেকে তীব্র পাল্টা আক্রমণ বিরোধীকে— এতটা উত্তাপ এবং টানাপড়েন সঙ্গী করে ভোটগণনায় যেতে স্মরণাতীত কালে দেখা যায়নি ভারতকে। এ বার ঘটছে। তার প্রেক্ষিতেই ভোটগণনার সময়ে হিংসার আশঙ্কায় দেশের সরকার।
বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র বা ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে অনেক দিন ধরেই সরব বিরোধী দলগুলি। ইভিএম বাতিল করে ব্যালটে ফেরার দাবি তো অনেক দিন ধরেই উঠছিল। সে দাবি নির্বাচন কমিশন বার বারই নস্যাৎ করেছে। ইভিএম যে হ্যাক করা যায় না,সে কথাও বার বার কমিশন বোঝানোর চেষ্টা করেছে। ‘হ্যাকাথন’ কর্মসূচির বন্দোবস্ত করে কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ইভিএম হ্যাক করে দেখানোর চ্যালেঞ্জও ছুড়েছে। সেই চ্যালেঞ্জে নির্বাচন কমিশনকে টেক্কা দেওয়া যায়নি ঠিকই। কিন্তু ইভিএমে কারচুপির আশঙ্কা নিয়ে অভিযোগ এবং বিতর্ক থামেনি।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার আগে থেকেই এ বার বিভিন্ন বিরোধী দল দাবি করছিল, ইভিএমে কোনও প্রার্থীর ভোটপ্রাপ্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে ভিভিপ্যাট স্লিপে ভোটপ্রাপ্তির হিসেবও। সব বুথেই এই পদ্ধতি অবলম্বনের দাবি তোলা হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন রাজি হয়নি। প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রে ৫টি করে বুথের ভিভিপ্যাট স্লিপ এবং ইভিএম মিলিয়ে দেখা হবে— কমিশন এই সিদ্ধান্তই নেয়। কমিশনের সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জে করেছিল বিরোধীরা। অন্তত ৫০ শতাংশ বুথে ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট স্লিপ মেলাতে হবে, এই দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতও সে দাবি মানেনি। নির্বাচন কমিশনের উপরেই আস্থা রাখে সুপ্রিম কোর্ট।
আরও পড়ুন: ভোটের ফল প্রকাশের পর হিংসা রুখতে রাজ্যে ২০ হাজার আধাসেনা
বিতর্ক তাতেও শেষ হয়নি। ভোট মেটার পরে নতুন অভিযোগ সামনে এসেছে। ইভিএম বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। যে সব ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সরিয়ে ফেলে স্ট্রং রুমে অন্য ইভিএম ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে কংগ্রেস, তৃণমূল, তেলুগু দেশম, এসপি, বিএসপি, ডিএমকে, পিডিপি-সহ বিভিন্ন দলের দাবি। কমিশনের মদতেই বিজেপি এমনটা করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে বিরোধী দলগুলি চাঞ্চল্যকর অভিযোগ এনেছে।
আরও পড়ুন: ইভিএমের পর গণনা ভিভিপ্যাট, ফলপ্রকাশে বিলম্ব এবার
এই চাঞ্চল্যের আগুনে অক্সিজেন জুগিয়েছে ভোট মেটার পরে ট্রাকে করে ইভিএম বহনের কিছু ছবি বা ভিডিয়ো। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পঞ্জাব-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে এই সব ছবি-ভিডিয়ো উঠে এসেছে বলে বিরোধী দলগুলো জানিয়েছে। তার প্রেক্ষিতে ২১টি দলের প্রতিনিধিরা মঙ্গলবার দেখা করেন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের সঙ্গে। ইভিএম বদলের আশঙ্কা প্রকাশ করে স্ট্রং রুমের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি তো তাঁরা জানিয়েছেনই। গণনার প্রক্রিয়াতেও বদল আনার দাবি করেছেন। গণনার শুরুতেই প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রের যে কোনও পাঁচটি বুথের ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট স্লিপ মিলিয়ে দেখতে হবে, কোনও গোলমাল ধরা পড়লে ওই বিধানসভা কেন্দ্রের সব বুথের ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনতে হবে— এই রকমই দাবি তুলেছেন বিরোধী নেতারা।
কমিশন সূত্রের খবর, বিরোধী দলগুলির এই দাবিটি নিয়ে বুধবারের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনা করেছেন কমিশন কর্তারা। দাবিটি খারিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও সেই বৈঠকেই হয়েছে। ইভিএমে ভোটপ্রাপ্তির গণনা হয়ে যাওয়ার পরে লটারির মাধ্যমে প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রের যে কোনও ৫টি করে বুথকে বেছে নিয়ে ওই সব বুথের ইভিএমের হিসেবের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ মিলিয়ে দেখা হবে বলে যে সিদ্ধান্তের কথা কমিশন আগে জানিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্তই বহাল থাকছে বলে জানানো হয়েছে।
কমিশন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে বা সুপ্রিম কোর্ট বিরোধীদের আর্জি খারিজ করে দিয়েছে বলে বিতর্ক থেমে গিয়েছে, এমন নয়। প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ তথা বর্তমানে কংগ্রেস নেতা উদিত রাজ বুধবার প্রশ্ন তুলেছেন, সুপ্রিম কোর্টও এই ‘ইভিএম কারচুপি ষড়যন্ত্রে’ সামিল হয়েছে কি না!
বিজেপি-ও কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাল্টা আক্রমণের স্বর তীব্র করেছে। বিরোধীরা হারের আভাস পেয়েই ইভিএম নিয়ে নানা সংশয় প্রকাশ করছে বলে বিজেপির দাবি। নিজেদের হতাশা ঢাকতে দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে বিরোধীরা বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে— বলছেন বিজেপি নেতারা।
বাংলার বিজেপি নেতাদের স্বর আরও চড়া। ইভিএম পাহারা দেওয়ার নামে বিভিন্ন গণনাকেন্দ্রের বাইরে বা স্ট্রং রুমের কাছে তৃণমূল কর্মীরা যে ভাবে জমায়েত শুরু করেছেন, বিজেপি বুধবার তার তীব্র সমালোচনা করেছে। কমিশনে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে বিজেপি। তার পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ‘‘গণনাকেন্দ্রের সামনে এই ভাবে কর্মীদের জড়ো করার মধ্যে তৃণমূলের কোনও দুরভিসন্ধি রয়েছে।’’ যেখানেই তৃণমূল পিছিয়ে পড়বে,সেখানেই এঁরা গোলমাল পাকাবেন— আশঙ্কা জয়প্রকাশের।
বঙ্গ বিজেপির এই আশঙ্কাকে যে দেশের সরকার উড়িয়ে দিচ্ছে না, তার প্রমাণ মিলেছে এ দিন সন্ধ্যায়ই। ভোটগণনা চলাকালীন বিভিন্ন এলাকায় অশান্তি হতে পারে এবং হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া হতে পারে— এই আশঙ্কা করে সবক’টি রাজ্যকে এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সতর্ক করা হয়েছে মুখ্যসচিবদের। কিন্তু বিরোধী দলগুলিও গণনাকেন্দ্র বা স্ট্রং রুমের সামনে জমায়েত বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর।
ভোট মিটে যাওয়ার পরেও রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে এই রকম তীব্র ভাবে খড়্গহস্ত, ভোটগণনা শুরু হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এমন প্রবল তিক্ততা দুই শিবিরের মধ্যে— এই পরিস্থিতি ভারতীয় গণতন্ত্র কখনও দেখেনি সম্ভবত।
পরিস্থিতি এমনই যে, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইভিএম বদলের চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ তাঁর। দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার গায়ে যাতে অস্বচ্ছতার কালি একটুও না লাগে, সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন প্রণব। ইভিএমের নিরাপত্তা এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্বটা যে কমিশনের কাঁধেই সবচেয়ে বেশি, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
এই রকম এক প্রেক্ষাপটেই আজ প্রকাশ্যে আসছে ভারতের রায়। প্রায় বেনজির এই উত্তাপের মাঝে কতটা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয় ভোটগণনার প্রক্রিয়া, সে দিকে নজর তো থাকছেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে যে সংশয় প্রকাশ করেছে বিরোধী দলগুলো, ভোটগণনার প্রক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য রাখার সময় দেশবাসীর মাথায় থাকবে সেই বিষয়গুলিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy