Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus Lockdown

কোভিড নয়, লকডাউনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের, শিক্ষার

টীকাকরণের অসুবিধা থেকে শুরু করে সঠিক সময়ে  চিকিৎসক না পাওয়া, ঘরবন্দি হয়ে বন্ধু, স্কুল খেলার মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিন কাটাচ্ছে শিশুরা।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২০ ১৯:০৭
Share: Save:

তখন লকডাউনের দ্বিতীয় দফা চলছে। দক্ষিণ শহরতলির বাসিন্দা সৌরভ ঘোষ পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন ৬ মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে। ছেলের টীকাকরণের দিন পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ কোনও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে পাচ্ছেন না যিনি টীকা দিতে পারেন। ছেলের জন্মের পর থেকে যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেন, তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন রোগী দেখবেন না। প্রৌঢ় চিকিৎসক ডায়াবেটিক। কোভিড সংক্রমণের ভয়ে পুরোপুরি ঘরবন্দি। তাই সৌরভবাবু খোঁজ করছিলেন অন্য চিকিৎসকের। আশপাশে খোঁজ করে কোনও সুরাহা করতে পারেননি। লকডাউন চলায় কোনও বড় হাসপাতালেও যেতে পারেননি। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে টীকা নেওয়া হয়নি সৌরভবাবুর ছেলের।

শুধু টীকাকরণ নয়। খেলতে গিয়ে বাইকের গরম একজস্ট পাইপে পা লেগে পুড়ে যায় চার বছরের তমোনাশের। প্রায় আড়াই ইঞ্চি জায়গা জুড়ে ক্ষত তৈরি হয়। কোনও জায়গায় চিকিৎসক না পেয়ে একটি নার্সিংহোমে প্রাথমিক চিকিৎসা হয় তমোনাশের। কিন্তু নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষই জানিয়ে দেন, পরবর্তী ‘ড্রেসিং’ করতে হবে বাড়িতেই।

নরেন্দ্রপুরের এক অভিজাত আবাসনের বাসিন্দা সেন দম্পতি। তাঁরা দু’জনেই বেসরকারি ক্ষেত্রে উঁচু পদে কর্মরত। লকডাউনের সময়ে তাঁদের দু’জনকেই বাড়ি থেকে কাজ করতে হয়েছে। তাঁদের ছেলে সোনারপুরের একটি নামী স্কুলের কেজি-র ছাত্র। লকডাউনের আগের রুটিন অনুযায়ী সকালে স্কুল বাসে চাপিয়ে দিয়ে অফিস চলে যেতেন দম্পতি। দুপুরে বাস থেকে নামিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন ছেলেকে দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত আয়া। তাঁর কাছেই সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটায় তাঁদের ছেলে। বিকেলে পার্ক থেকে শুরু করে যোগ ক্লাসে নিয়ে যাওয়া— ছেলের রুটিনে থাকে অনেক কিছু। কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ার পর সেই আয়া আসতে পারছেন না। বাড়িতে একা ছেলে। বাবা-মা বাড়ি থাকলেও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না তাঁরা। স্কুল বন্ধ। অনলাইন ক্লাস হলেও, পড়াশোনায় যতটা বাবা-মার তদারকি করা প্রয়োজন, তা করতে পারছেন না ওই দম্পতি। ফলে স্কুলের তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছে তাঁদের ছেলে। সেন দম্পতি স্বীকার করেন, ‘‘আমরা বাড়িতে থেকেও নেই। ফলে ছেলেটা বড্ড একা হয়ে গিয়েছে। আবাসনে ওর বয়সী অনেক বাচ্চা আছে। কিন্তু পার্কে যাওয়া বন্ধ। খেলাধুলো বন্ধ।” ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষাদ বাড়ছে মনে।

আরও পড়ুন: আমপান উড়িয়ে নিয়ে যাবে করোনাভাইরাসকে? বিজ্ঞানীরা বলছেন...

টীকাকরণের অসুবিধা থেকে শুরু করে সঠিক সময়ে চিকিৎসক না পাওয়া, ঘরবন্দি হয়ে বন্ধু, স্কুল খেলার মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিন কাটাচ্ছে শিশুরা। ফলে গোটা লকডাউনের সময়ে সরাসরি কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা পরোক্ষভাবে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই লকডাউনের সময়ে। সম্প্রতি শিশু অধিকার সংস্থা ‘চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ’ (ক্রাই) দেশ জুড়ে একটি সমীক্ষা চালায়। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য। স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে সমস্যার পাশাপাশি গোটা দেশ জুড়ে শিশুদের শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গিয়েছে এই সমীক্ষায়।

শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির বড় অংশেরই একই সমস্যা। ফলে একাকিত্বের শিকার হচ্ছে শিশুরা। সেখান থেকে প্রবণতা বাড়ছে মোবাইল বা কম্পিউটার ঘাঁটার। সমীক্ষাতেও উল্লেখ, ৮৮ শতাংশ বাবা-মা জানিয়েছেন যে তাঁদের সন্তানদের মধ্যে টেলিভিশন, মোবাইলে কার্টুন দেখা বা কম্পিউটারে গেম খেলার সময় এবং প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছে কারণ বাইরে খেলাধুলো করার কোনও সুযোগ তারা পাচ্ছে না। অভিভাবকদের একটা বড় অংশ স্বীকার করেছেন, লকডাউনের সময়ে তাঁদের সন্তানদের ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ছোট ছোট বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছে। ক্রাইয়ের সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে গোটা দেশে ৩৭ শতাংশ অভিভাবক ওই অভিযোগ করছেন। তবে তার মধ্যেও দেশের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে এই প্রবণতা অনেক বেশি। ৫১ শতাংশ অভিভাবক সন্তানদের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ক্রাই-এর চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার পূজা মারওয়াহা বলেন, ‘‘লকডাউন শিশুদের উপর কতটা প্রভাব ফেলল তা বোঝাটাই এই সমীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল।” প্রায় ১ হাজার ১০০ অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। তবে ক্রাইয়ের শীর্ষ কর্তারা স্বীকার করেছেন, দেশের শিশুদের আরও একটা বড় অংশ রয়েছে যাঁদের কাছে ডিজিটাল মাধ্যম পৌঁছয়নি। তাঁদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে আরও বেশি। সেই সঙ্গে তাদের প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রও তারা পায়নি। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু বলে দাবি করা হয়েছে এই সমীক্ষায়।

আরও পড়ুন: ঘ্রাণশক্তি দিয়ে করোনা সংক্রমণ পরীক্ষা করবে কুকুর? ব্রিটেনে শুরু হল গবেষণা

তবে লকডাউন ঘিরে যে অন্ধকার দেখা গিয়েছে সমীক্ষায়, তার মধ্যে রয়েছে আলোর রেখাও। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া অর্ধেকের বেশি বাবা-মা জানিয়েছেন, লকডাউনের সময়ে সন্তানদের সঙ্গে তাঁরা আগের থেকে অনেক বেশি সময় বাড়িতে থাকায়, বন্ধন অনেক বেড়েছে। সন্তানদের সঙ্গে তাঁরা অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এই সময়ে। পূজার আশা, লকডাউন শেষ হলেই, এই শিশুদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তাঁরা নিতে পারবেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE