Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বায়না রাখবে কে, জানে না পিতৃহারা মেয়ে

তিন বছরের মেয়েটার বাঁ পা ফুঁড়ে দিয়েছে একে-৫৬ এর বুলেট। ব্যান্ডেজ বাঁধা পা আর চোখের পাশে ক্ষত নিয়ে কাপড়ে বাঁধা অবস্থায় মায়ের কোলে ঝুলছে। নিজের যন্ত্রণা ভুলে ফ্যালফ্যাল করে বাবার শবদেহের দিকে তাকিয়ে ফরমাইনা বসুমাতারি।

 হামলার আগে মনজয়। যে চায়ের দোকানে সে বসেছিল, সেখানে কেউ মোবাইলে তার ছবিটি তোলেন। সেই ছবি পুলিশের হাতে এসেছে।

হামলার আগে মনজয়। যে চায়ের দোকানে সে বসেছিল, সেখানে কেউ মোবাইলে তার ছবিটি তোলেন। সেই ছবি পুলিশের হাতে এসেছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ধুবুরি ও গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

তিন বছরের মেয়েটার বাঁ পা ফুঁড়ে দিয়েছে একে-৫৬ এর বুলেট। ব্যান্ডেজ বাঁধা পা আর চোখের পাশে ক্ষত নিয়ে কাপড়ে বাঁধা অবস্থায় মায়ের কোলে ঝুলছে। নিজের যন্ত্রণা ভুলে ফ্যালফ্যাল করে বাবার শবদেহের দিকে তাকিয়ে ফরমাইনা বসুমাতারি। হাসপাতাল থেকে অটোয় চাপিয়ে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে বাবা দণ্ডা বসুমাতারির অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে।

২৪ ঘণ্টা আগে ছবিটা ছিল একেবারেই উল্টো। গত কয়েক দিন ধরে একজোড়া নতুন জুতো আর হাতের খারুর (বালা) জন্য বাবার কাছে বায়না করছিল সে। মেয়ের মন রাখতেই তাঁকে কোলে করে পেশায় গাড়িচালক দণ্ডা গত কাল সকালে অটোয় চেপে হাজির হয়েছিলেন বালাজান তিনালির বাজারে। কিন্তু অটো থেকে নামতেই নাগাড়ে গুলি ছুটে আসতে থাকে। এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া দণ্ডা মেয়েকে কোলে নিয়েই ছিটকে পড়েন রাস্তায়। স্ত্রী মমতা কোনও মতে অটোর আড়ালে লুকোন। বাবার হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে ফরমাইনা। গুলি ঢোকে তার পায়েও। মাটিতে আছড়ে পড়ে কেটে যায় চোখের পাশে। সামনে তখন উদ্যত রাইফেল হাতে জঙ্গি। সেই অবস্থায় বাজারেরই কোনও এক মহিলা হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে পালান। হাসপাতালে ছটফট করা মেয়েটা আজ জানতে পারে, তার সব বায়না পূরণ করা বাবা আর নেই। এই ‘নেই’ কতটা গভীর তা হয়তো বছর তিনেকের ফরমাইনা এখন বুঝতেই পারছে না।

স্বজন হারানোর ছবিটা এ দিন কোকরাঝাড়ের বিভিন্ন স্থানে প্রায় একই রকম। বড়ো জঙ্গি সংগঠনের গুলিতে এত জন বড়োর মারা যাওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। তাই জঙ্গিদের প্রতি বিদ্বেষের মাত্রাটা এবারে সার্বিক। গত কালের জঙ্গি হানায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪। আজ ভোরে হাসপাতালে তেজেন হাজোয়ারি নামে এক বৃদ্ধ মারা যান। জখম কয়েকজনকে গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল হাসপাতালে তাঁদের দেখতে যান। বড়ো স্বশাসিত পরিষদের উপ প্রধান খাম্ফা বরগয়ারি বলেন, “এই গণহত্যার নাম স্বাধীনতা যুদ্ধ হতে পারে না। শান্ত বড়োভূমিকে অশান্ত করার এই চেষ্টা ঘৃণার যোগ্য।” নিরাপত্তার খামতি প্রসঙ্গে খাম্ফা বলেন, “নিরাপত্তার নামে সব রাস্তায়, সব মোড়ে সেনা বা আধা-সেনা মোয়াতেন করা সম্ভব নয়।” জঙ্গি হানার প্রতিবাদে আবসুর নেতৃত্বে এ দিন কোকরাঝাড়ের ছাত্রছাত্রীরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে মিছিল বের করে।

সকালে ঘটনাস্থলে যান বনমন্ত্রী তথা এক সময়ের জঙ্গি নেত্রী প্রমীলারানি ব্রহ্ম। তিনি ঘটনার দায় এনডিএফবি সংগ্রামপন্থীদের উপরে চাপিয়ে বলেন, “জঙ্গিরা জানত বাজার এলাকায় সব জাতি-ধর্মের মানুষ থাকে। গুলি চললে বড়োরাও মারা যাবেন। তার পরেও যে এলাকায়, যে ভাবে তারা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাতে ঘটনার পিছনে অন্য কারও মদত আছে বলেই মনে হয়েছে।” প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে নিহত মনজয় ইসলারি ওরফে মাউদাং আত্মঘাতী হানাদারের মতোই আচরণ করছিল। তার এক বা একাধিক সঙ্গী থাকলেও তাদের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। কিন্তু সঙ্গীরা গুলি চালানো শুরু করার পরেও মনজয় খোলা মুখে, রাইফেল কাঁধে অটো থেকে নেমে একটি দোকানে বসে। সেই সময় এক ব্যক্তি তার ছবিও তোলে। যা পুলিশের হাতে এসেছে। পরে আগুয়ান জওয়ানদের দেখে সে হাতের রাইফেল উঁচিয়ে তাদের হুমকি দেয়, চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে! সাধারণত জঙ্গিরা যা করে না।

সেনাবাহিনী দাবি করেছে অটো থেকে নেমে দুই জঙ্গি গুলি চালিয়েছিল। পুলিশের দাবি, জঙ্গিরা সংখ্যায় ছিল তিন জন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও জানান, নিহত জঙ্গি মনজয় ছাড়া আরও এক ক্রিম রঙের গেঞ্জি পরা জঙ্গি গুলি চালাচ্ছিল। কিন্তু ঘটনার পরে অস্ত্র নিয়ে কোথায় গা-ঢাকা দিল ওই এক বা দু’জন জঙ্গি তার হদিস ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও বের করতে পারেনি পুলিশ বা সেনা। তাদের ধারণা, ঘটনাস্থলের খুব কাছেই, গ্রামের কোনও বাড়িতে আগে থেকে তাদের লুকনোর ব্যবস্থা করা ছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Kokrajhar Militant attacks CM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE