২১তম পার্টি কংগ্রেসে সীতারাম ইয়েচুরি এবং প্রকাশ কারাট। মঙ্গলবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি: পিটিআই
রাজনীতিতে কোনও মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক রোজকার ঘটনা। কিন্তু কখনও কখনও নীরবতাও বিতর্ক তৈরি করে। উস্কে দেয় জল্পনা!
প্রকাশ কারাটের ক্ষেত্রে মঙ্গলবার সেটাই ঘটল। দলের ২১তম পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী বক্তৃতায় কংগ্রেস সম্পর্কে নীরব থাকারই নীতি নিলেন সিপিএমের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক। প্রকাশ এ দিন কড়া ভাষায় নরেন্দ্র মোদী সরকার-বিজেপি-আরএসএস’কে আক্রমণ করেছেন। সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের নাম এক বারও উচ্চারণ করেননি! নাম না করেও কংগ্রেসের কোনও সমালোচনা করেননি! বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে আর্থিক নীতিতে কোনও ফারাক নেই বলে যে অভিযোগ সিপিএম নেতারা বরাবর করে থাকেন, সেই আপ্তবাক্যও এ দিন প্রকাশের মুখে শোনা যায়নি! পরমাণু চুক্তি ঘিরে কেন্দ্রের কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার জন্য যে প্রকাশ কারাট এখনও দলে সমালোচনার পাত্র, তাঁরই এমন নীরবতায় বিস্ময় ছড়িয়েছে পার্টি কংগ্রেসে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, বিদায়বেলায় প্রকাশও কি কংগ্রেসের সম্পর্কে সুর একটু নরম করছেন? সীতারাম ইয়েচুরি তথা আলিমুদ্দিনের নেতাদের যেমনটা মনোবাসনা? জমি অধিগ্রহণ বিলের মতো বিষয়ে কংগ্রেসের পাশে থেকেই সংসদের ভিতরে মোদী-সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে বামেরা। নিজেদের সীমিত ক্ষমতা বুঝে, সেই জোট অক্ষুণ্ণ রাখতেই কি এ বার কংগ্রেসকে আক্রমণের পথে যাননি প্রকাশ? নাকি সে সব কিছুই নয়? কেন্দ্রের মোদী-সরকারকে পাখির চোখ করতে গিয়ে এমনিতেই দুর্বল কংগ্রেসকে আর বাড়তি গুরুত্ব দেননি তিনি?
কংগ্রেস না বিজেপি, কে বড় শত্রু— সিপিএমের সামনে অতীতে সেই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কংগ্রেস সম্পর্কে নরম মনোভাব নেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই বলে সিপিএম নেতৃত্বের যুক্তি। পার্টি কংগ্রেসে আলোচনার জন্য তৈরি রাজনৈতিক রণকৌশলে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম নির্বাচনী আঁতাঁতে যাবে না সিপিএম। পলিটব্যুরো নেতা এস আর পিল্লাইয়ের কথায়, ‘‘কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনও স্তরেই কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম রাজনৈতিক সমঝোতা হবে না। কারণ কংগ্রেসের দুর্নীতি ও জনবিরোধী নীতির সুযোগ নিয়েই বিজেপি এই ভাবে ক্ষমতায় আসতে পেরেছে।’’ তাঁর বক্তব্য, পার্টির প্রধান লক্ষ্য এখন দলের নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি এবং বাম ঐক্য মজবুত করা।
পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তারই প্রতিফলন মিলেছে। অন্য তিন বাম দল সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি-র শীর্ষ নেতারা তো বটেই, সেই সঙ্গে এই প্রথম এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের শীর্ষ নেতাদেরও সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী আসরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কারাট কংগ্রেস সম্পর্কে নীরব থাকলেও বাকিরা বিজেপি-র পাশাপাশি সনিয়া গাঁধীর দলকেও তুলোধনা করেছেন। এই বাম ঐক্য গড়ে তোলার জন্য কারাটকে সাধুবাদ জানিয়ে এসইউসি-র প্রভাস ঘোষ বলেন, ‘‘অতীতে এসইউসি বাম জোটে থাকলেও ১৯৭৪-এর পর সেই জোট ভেঙে যায়। পরিস্থিতির প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকারের বিরুদ্ধে এসইউসি আন্দোলনও করেছে। জাতীয় স্তরে ঐক্য চাইলেও এত দিন তা হয়নি।’’ সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো নেত্রী কবিতা কৃষ্ণণ বলেন, ‘‘আমাদের এই কাছাকাছি আসাটা বাম আন্দোলনকে চাঙ্গা করবে।’’
নিজেদের শক্তি কমে যাওয়াতেই চার বাম দলের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়েছিলেন প্রকাশ। নিজে কলকাতায় গিয়ে এসইউসি নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। বাম ঐক্যে সিমেন্টের প্রলেপ দিতে তিনি এ দিনও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন। শুধু বক্তৃতা নয়। বিশাখাপত্তনমে আসা অন্য বাম দলের নেতাদের থাকা-খাওয়ার বিষয়ে নিজে নজর রেখেছেন। আজ প্রত্যেকের বক্তৃতার শেষে উঠে গিয়ে করমর্দন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাঁর সমালোচকেরা বলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের উষ্ণতা দিয়ে রাজনৈতিক দূরত্ব মুছে ফেলার মুন্সিয়ানা কারাটের নেই। বিশাখাপত্তনমে সেই অভাব মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন কারাট।
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, কারাটের বদলে যে-ই সাধারণ সম্পাদক হোন না কেন, এই বাম ঐক্য ভবিষ্যতে ধরে রাখতে হলে কংগ্রেসের সম্পর্কে সুর নরম করা মুশকিল। তা করতে গেলেই লিবারেশন বা এসইউসি বেঁকে বসবে। সাবেকি শরিকেরাও বিদ্রোহ করতে পারে। কারণ সিপিআই-ও কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতায় না যাওয়ারই অবস্থান নিয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতাও বলছে, রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেস প্রার্থী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করতে গিয়ে বাম ঐক্যে চিড় ধরেছিল। সিপিআই-আরএসপি সিপিএমের পাশে থাকেনি।
তা হলে এ দিন উদ্বোধনী বক্তৃতায় ১৩ বার বিজেপি-আরএসএসের নাম করে আক্রমণ করলেও এক বারও কংগ্রেস সম্পর্কে একটি বাক্যও ব্যয় করলেন না কেন প্রকাশ কারাট? তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের যুক্তি, মোদীর নেতৃত্বে বিজেপিকেই এখন বড় বিপদ বলে মনে করছে সিপিএম। যে আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে বামেদের লড়াই, তার পরিচালনাও এখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের হাতেই। এ হেন বিজেপি-র বিরুদ্ধে আক্রমণকে যথাসম্ভব ধারালো করতেই কংগ্রেস সম্পর্কে সমালোচনা উহ্য থেকে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy