ভোলকার-তেলে পা পিছলে গিয়েছিল নটবর সিংহের! সনিয়া গাঁধী হাত ধরেননি। আজ জয়ন্তী নটরাজনের হাতটাও টুক করে ছেড়ে দিলেন!
মনমোহন জমানায় কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন জয়ন্তী। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইচ্ছাকৃত ভাবে শিল্পের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র ঝুলিয়ে রাখতেন তিনি। বিজেপির অভিযোগ ছিল, ছাড়পত্র দিতে তখন ‘জয়ন্তী ট্যাক্স’ নিত পরিবেশ মন্ত্রক। এ ব্যাপারে দু’-দু’টি সিবিআই মামলার চাপে পড়ে জয়ন্তী যখন আজ বিস্ফোরক তথ্য ফাঁস করলেন, তাঁর থেকে দূরত্ব বাড়াতে দু’দণ্ডও সময় নিলেন না কংগ্রেস হাইকম্যান্ড।
লোকসভা ভোটের ঠিক আগে, ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর, জয়ন্তীকে পরিবেশ মন্ত্রক থেকে হঠাৎই সরিয়ে দিয়েছিলেন মনমোহন। সে দিনই বিকেলে একটি বণিকসভার সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন রাহুল গাঁধী। নীতিপঙ্গুতা কাটানোর বার্তা দিয়ে শিল্পমহলকে খুশি করতে বলেছিলেন, পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে আর বিলম্ব হবে না। অথচ সনিয়া গাঁধীকে একটি চিঠি লিখে এবং আজ সাংবাদিক বৈঠক করেন জয়ন্তী বলেন, “এ হল অন্ধ দ্বিচারিতা। বিভিন্ন শিল্প প্রকল্পে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে রাহুলের দফতর থেকে ক্রমাগত চিঠি পাঠানো হতো। যে চিঠি এক প্রকার নির্দেশ বলে গণ্য করাই কংগ্রেসের সংস্কৃতি। তার ওপর, সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের বায়নাক্কাও থাকত।” জয়ন্তীর ক্ষোভ, তাঁকে মন্ত্রক থেকে সরিয়ে দিয়ে এমন ভাব দেখানো হয়েছিল যে, সবটাই ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত। বণিক মহলের সামনে তাঁকেই দায়ী করা হয়েছিল। এমনকী, রাহুলের দফতর থেকে সাংবাদিকদের ফোন করে বলা হয়েছিল, জয়ন্তীই দোষী।
রাজনৈতিক ওজনে ও ভারে নটবরের তুলনায় শিশু জয়ন্তী। বর্ষীয়ান ওই কংগ্রেস নেতা থেকে দূরত্ব বাড়াতে তাই সময় নিয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু জয়ন্তীকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে গালমন্দ করে ঝেড়ে ফেলতে আজ এক মুহূর্তও দেরি করেননি গাঁধী পরিবারের সেনাপতিরা। চেন্নাইতে আজ জয়ন্তী যখন সাংবাদিক বৈঠক করছেন, তখন পাল্লা দিয়ে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, ভোপাল ও ওড়িশায় মুখ খুলেছেন আনন্দ শর্মা, দিগ্বিজয় সিংহ, সলমন খুরশিদ, বীরাপ্পা মইলিরা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য তাতে বিস্মিত নন। বরং তাঁদের অনেকেরই মত, এটাই ‘টিপিক্যাল’ গাঁধী পরিবার। যাঁদের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভ্যাস ভালো হলে কৃতিত্ব নেওয়া, কিন্তু প্যাঁচে পড়লেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলা। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। তেলের বিনিময়ে খাদ্য কাণ্ডে নটবর সিংহ ফেঁসেছিলেন। সে সময় সনিয়া গাঁধীর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বিদেশ মন্ত্রকের প্রাক্তন এই আমলাকে বিদেশমন্ত্রী করা হয়েছিল সনিয়ারই নির্দেশে। কিন্তু বৃদ্ধ পারিবারিক বন্ধুর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করতে দ্বিধা করেননি রাজীব-পত্নী। টুজি কাণ্ডের নায়ক এ রাজাকে দ্বিতীয় ইউপিএ মন্ত্রিসভায় নিতেই রাজি হননি মনমোহন সিংহ। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বাধ্য করেছিলেন সনিয়া। কিন্তু রাজার কেলেঙ্কারি ফাঁস হতেই সব দায় চাপে মনমোহন-চিদম্বরমের ওপর। এমনকী, হালফিলে কপিল সিব্বলকে তৃণমূল সরকারের হয়ে মামলা লড়তেও সবুজ সঙ্কেত দেন হাইকম্যান্ডই। কিন্তু রাজ্য নেতারা কপিলের মুণ্ডপাত করলে সেই হাইকম্যান্ডই দূরত্ব বাড়িয়ে বলেন, কংগ্রেস কর্মীদের ভাবাবেগ আঁচ করা উচিত ছিল কপিলের।
গাঁধী পরিবারের সমালোচকদের মতে, এমন সব শহিদের তালিকায় সর্বশেষ নামটি জুড়ল জয়ন্তীর। তাঁর সঙ্গে গাঁধী পরিবারের সম্পর্কের গভীরতা এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়! ষাটের দশকের গোড়ায় তাঁর ঠাকুরদা এম ভক্তবৎসলম ছিলেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী। যুব কংগ্রেস দিয়ে জয়ন্তীর রাজনীতি শুরু। সেই সময়ই দ্রুত রাজীব গাঁধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শ্রীপেরামবুদুরে আত্মঘাতী হামলায় যখন রাজীবের মৃত্যু হয়, তখন সভাস্থলে কিছুটা দূরে ছিলেন জয়ন্তী। গাঁধী পরিবারের ঘনিষ্ঠরা বলেন, রাজীবের শেষ মুহূর্তের কথা বারবার জয়ন্তীর কাছে শুনতে চাইতেন সনিয়া। একবারও লোকসভা ভোটে না লড়ে, চার বারের রাজ্যসভার সাংসদ, স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, কংগ্রেস মুখপাত্র ও কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়ে ওঠা পর্যন্ত জয়ন্তীর উত্থানের রহস্যটা এর পর আর রহস্য নয়।
কিন্তু শেষটা তো করুণ হল! কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতা বলেন, গাঁধী পরিবারের অপরিণামদর্শিতা ও ভুলের দৃষ্টান্ত ভূরিভূরি। কিন্তু তা প্রকাশ পেতেই কাউকে না কাউকে বলির পাঁঠা হতে হয়েছে। আজ যে জয়শঙ্করকে সামনে রেখে নতুন করে বিদেশমন্ত্রক সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, সেই তাঁকেই কিন্তু দু’বছর আগে সাউথ ব্লকে চেয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ২০১৩ সালে রঞ্জন মাথাই অবসর নেওয়ার পরে মনমোহনের প্রথম পছন্দ ছিল এই জয়শঙ্করই। তিনি তখন ছিলেন চিনের রাষ্ট্রদূত। তাঁকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে একাধিকবার আলোচনাও করেছিলেন মনমোহন। কিন্তু মনমোহনের এই পছন্দে বেঁকে বসেন সনিয়া গাঁধী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সুজাতা সিংহ ছিলেন ১০ জনপথের ঘরের মেয়ে। তাঁর বাবা প্রাক্তন আইবি প্রধান টিভি রাজেশ্বর গাঁধী পরিবারের দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন। সনিয়া সরাসরি মনমোহনকে জানিয়ে দেন, জয়শঙ্করকে নয়, সুজাতাকেই পরবর্তী বিদেশসচিব হিসেবে দেখতে চান তিনি। সূত্রের খবর, পরবর্তী সময়ে ইউপিএ সরকারের শেষ পর্বে যখন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে, চিনের অনুপ্রবেশে জেরবার হয় সীমান্ত, তখন সুজাতা সিংহর নিস্ক্রিয়তা নিয়ে মন্ত্রিসভার একটি বড় অংশের ক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু তখনও তাঁকে কিছু বলতে পারেননি মনমোহন। ১০ জনপথ সূত্রের খবর, সে সময়ে সনিয়া গাঁধীও কার্যত উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন সুজাতার প্রতি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও কমিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সেই জয়শঙ্করকেই বিদেশসচিব পদে বহাল করলেন নরেন্দ্র মোদী, সুজাতাকে মেয়াদের ছ’মাস আগেই সরিয়ে দিয়ে।
কংগ্রেসে থাকলেও গাঁধী পরিবারের বৃত্তের বাইরে চলে যাওয়া আর এক নেতা বলেন, এই ধারা ইন্দিরা গাঁধীর জমানা থেকেই কিছুটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইন্দিরা অবশ্য নিজে দৃঢ়তার সঙ্গে যে কোনও ভুল ত্রুটির সামগ্রিক দায়িত্ব নিতেন। কিন্তু তাঁকে পরিবৃত করে রাখতেন যে তোষামোদকারী নেতারা, তাঁরা চাইতেন ওঁকে আড়াল করে রাখতে। এমনকী, দেশে জরুরি অবস্থা প্রয়োগের জন্য ইন্দিরা দায় নিলেও তাঁর অনুগামীরা বলতেন, সংবিধানের আওতায় এমন দাওয়াই রয়েছে উনি জানতেনই না। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ই ওঁকে আইনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের এই নেতার কথায়, ইন্দিরার ওই অনুগামীদের অনেকেই পরবর্তীকালে সনিয়ার পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। হতে পারে তাঁদের পরামর্শেই অনিয়ম বা ত্রুটির দায় নিতে সনিয়া ও রাহুল এতটা নড়বড়ে। তবে তাঁদের সেই কৌশলও বারবার বেআব্রু হয়ে যাচ্ছে। যেমন হল আজ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy