Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ভোটের দায়ে জয় কিসান মোদী-জেটলির

আর কোনও ঝুঁকি না নিয়ে তাই একেবারে কাঁধে লাঙল তুলে, চাষির পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন

অঙ্কন: কুণাল বর্মন

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:২১
Share: Save:

রাহুল গাঁধী গুজরাতের ভোটের প্রচারে কাপাস-বাদাম চাষিদের প্রশ্ন করতেন, ফসলের দাম কত মিলছে? চাষিরা সমস্বরে জবাব দিতেন, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) থেকে অনেক কম। গুজরাতের গ্রামে গ্রামে সেই ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল ভোটের বাক্সে।

পরের লোকসভা ভোটের দেড় বছরও আর বাকি নেই। তার আগে বিজেপি-শাসিত রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ে ভোট। সেখানেও কৃষক আন্দোলনের আগুন জ্বলছে।

আর কোনও ঝুঁকি না নিয়ে আজ তাই একেবারে কাঁধে লাঙল তুলে, চাষির পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বাজেটে গ্রাম-গরিব-চাষির জন্য দেদার টাকা বিলোনোর কথা ঘোষণা করলেন। জানিয়ে দিলেন, এমএসপি হিসেবে উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম দেবে সরকার। ১০ কোটি অভাবী পরিবারের জন্য সরকারি খরচে ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমার ‘চমক’ দিলেন। একে ‘মোদীকেয়ার’ নাম দিয়ে আজ আমেরিকার ‘ওবামাকেয়ার’-এর সঙ্গে তুলনা টেনেছেন জেটলি। বুঝিয়ে দিয়েছেন, লোকসভা ভোটে বিজেপির প্রচারের দুই প্রধান অস্ত্র হবে এমএসপি ও মোদীকেয়ার।

ক’দিন আগেই মোদী বলেছিলেন, এটা ভোটের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট হলেও তা জনমোহিনী হবে না। এ তা হলে কোন বাজেট? জেটলির দাবি, ‘‘জনমোহিনী নয়, এই বাজেট সরকারের সামাজিক দর্শনের বাজেট। প্রধানমন্ত্রী দারিদ্রকে কাছ থেকে দেখেছেন। তার মধ্যে থেকেই উঠে এসেছেন।’’ সূত্রের খবর, বাজেটের অভিমুখ বদল হয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অক্সফ্যামের রিপোর্ট আসার পরেই। সেই রিপোর্টে বলা হয়, দেশের ৭৩% সম্পদ রয়েছে মাত্র ১% ধনীর হাতে। তখনই ঠিক হয় বাজেটের লক্ষ্য হবে ‘আমিরি হঠাও’।

আরও পড়ুন: মাইনে বাড়ল সাংসদদের, তবু অখুশি অনেকে

আর তাই ফসলের দাম, একশো দিনের কাজ, গ্রামোন্নয়ন, গ্রামের বাড়ি, সড়ক, পরিকাঠামোয় টাকা ঢালতে গিয়ে রাজকোষে টান পড়েছে, ঘাটতি বেড়েছে— পরোয়া করেননি জেটলি। এমনকী থাবা বসিয়েছেন শহুরে মধ্যবিত্তের পকেটেও। বিপুল প্রত্যাশা সত্ত্বেও আয়করে বিশেষ রদবদল করেননি। বরং সেস বাড়িয়েছেন। কিন্তু কৃষি সমবায়, ফসল উৎপাদনকারী সংস্থার জন্য কর কমিয়েছেন। চাষিদের জন্য রেকর্ড ঋণের লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন। আলু-টোম্যাটো-পেঁয়াজের দাম ওঠা-নামার ফলে চাষিদের ক্ষতি রুখতে ৫০০ কোটি টাকার ‘অপারেশন গ্রিন’ ঘোষণা করেছেন।

তফসিলি জাতি, উপজাতির কথা উঠে এসেছে জেটলির বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে। স্বামী বিবেকানন্দের উক্তি ধার করে বলেছেন, ‘এ বার নতুন ভারত বেরোক চাষার কুটির থেকে, লাঙল কাঁধে নিয়ে।’ যাঁদের জন্য এ সব কথা বলা, তাঁদের যাতে বুঝতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য প্রথা ভেঙে হিন্দিতেও বলেছেন। হোঁচট খেয়েও দমেননি। তার পরেও মোদী দলীয় সাংসদদের বলেছেন, গ্রামে যান, সহজ ভাষায় বাজেট বুঝিয়ে বলুন।

স্বাস্থ্য এবং কৃষি, এই দু’টি ক্ষেত্রেই সরকারি খরচ শেষ পর্যন্ত কতটা বাড়বে, তা অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। সেই সূত্রেই রাহুল প্রশ্ন তুলেছেন, ফসলের দাম, ১০ কোটি পরিবারের স্বাস্থ্য— ফের ‘জুমলা’ নয়তো? তাঁর মন্তব্য, ‘‘চার বছর হয়ে গেল, এখনও চাষিদের ন্যায্য দামের প্রতিশ্রুতি চলছে। চমকদার প্রকল্প ঘোষণা হচ্ছে। কোনও বরাদ্দ নেই। ভাগ্যিস, এই সরকারের আর এক বছরই রয়েছে।’’

জেটলির বাজেটকে ‘মরীচিকা’ আখ্যা দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, এই বাজেট সাধারণ মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর তামাশা। কারণ, কোনও প্রতিশ্রুতিই পূরণ হবে না।

স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে চাষের খরচের দেড় গুণ ফসলের দাম দেওয়া হবে— গত লোকসভা ভোটের ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু গত চার বছর তা নিয়ে টালবাহানা চলেছে। ঠেলার নাম যে বাবাজি, তা প্রমাণ করে শেষ বছরে সেই দাবি মানতে হয়েছে। যদিও চাষের উৎপাদন খরচ মাপার ক্ষেত্রে স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ না মেনে জেটলি সেই খরচ কমিয়ে হিসেব করতে চাইছেন বলে দাবি করেছেন যোগেন্দ্র যাদবের মতো সমালোচকরা।

আজ বাজেট বক্তৃতায় একেবারে শুরুতেই জেটলি ঘোষণা করে দেন, আগামী খারিফ মরসুম থেকে ফসলের খরচের দেড়গুণ এমএসপি ঠিক হবে। এমএসপি-র থেকে বাজার দর পড়ে গেলে, সেই ফারাকটুকু ভর্তুকি দেওয়া হবে। কী ভাবে তা কার্যকর হবে, সেটা ঠিক করতে নীতি আয়োগ রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসবে। জেটলির যুক্তি, আর্থিক বৃদ্ধি তখনই যুক্তিসঙ্গত হয়, যদি তার সুফল গরিব, চাষির ঘরে পৌঁছে দেওয়া যায়। গ্রামে টাকা ঢাললে রোজগারের পথও তৈরি হবে। চাষিরা ফসলের উচিত দাম পেলেই তাদের আয় দ্বিগুণ করার রাস্তা তৈরি হবে।

এটা সরকারের এত দিনের অবস্থানের ঠিক উল্টো। কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিংহ বলতেন, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে হলে সার, সেচের খরচও কমাতে হবে। শুধু এমএসপি বাড়ালে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়বে। এ বার কি মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা নেই? আর্থিক বিষয়ক সচিব সুভাষচন্দ্র গর্গের দাবি, আশঙ্কা খুবই সামান্য।

সিপিএমের কৃষক সভার নেতা হান্নান মোল্লার বক্তব্য, ‘‘ফসলের খরচের হিসেবের পদ্ধতি নিয়ে বিবাদ রয়েছে। বহু দিন ধরেই চাষিরা তা সংশোধন চাইছেন। তা না করে জেটলি দাবি করছেন, রবি ফসলের জন্যও খরচের দেড় গুণ দাম দিয়েছেন।’’

নতুন কোনও সংস্কারের ঘোষণাও নেই এই বাজেটে। জেটলির যুক্তি, গত চার বছরে যে সব সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে, তা গোটানোই এখন লক্ষ্য।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE