ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
তিনি কি খুনি? তিনি তো মা। মা-ই খুনি? তবে তো নিকৃষ্টতম!
২০১৫ সালের অগস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছিল এ সব কথা। সে সব প্রশ্ন এখনও হাওয়ায় উড়ছে। ঘটনার তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে সেই মাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা মত। পরিচিত-অর্ধ পরিচিতেরা তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে নানা কথা বলেছেন, বলেন।
এ সব কথা শুনলে প্রথম কার মুখ মনে পড়ে? তাঁর জীবনের ছ’বছরেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে জেলে। চাকচিক্যের জীবন থেকে ঠিক যতটা দূরে যাওয়া সম্ভব, ততটাই যেতে হয়েছিল। পরিবার, সন্তান, বন্ধু, কাজ— সমস্ত থেকে বিচ্যুত সময় কাটিয়েছেন। নিজের সন্তান শিনা বরাকে অপহরণ করে খুনের অভিযোগ এখনও রয়েছে তাঁর উপরে। তবে জামিন পেয়ে এখন তিনি বাড়িতে। নিজের মতো করে জীবনটা গুছিয়ে নিচ্ছেন। নতুন করে জীবন শুরু করছেন মিডিয়া জগতের প্রাক্তন কর্তা পিটার মুখোপাধ্যায়ের প্রাক্তন স্ত্রী ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।
এমন ভাবে কারও পরিচয় দেওয়া হলে মান করতে পারে সচেতন সমাজ। মান হতে পারে ইন্দ্রাণীরও। তবে আট বছর আগে যে দিন পিটারদের দক্ষিণ মুম্বইয়ের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করা হল তাঁকে, তার পর থেকে এ ভাবেই পরিচিত ইন্দ্রাণী। তার আগে অবশ্য সংবাদমাধ্যমের কর্ত্রী থেকেছেন তিন সন্তানের এই মা, গুয়াহাটির পরী বরা। দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় নামও উঠেছে পরী থেকে ইন্দ্রাণী হয়ে ওঠা সেই তিনির।
যত দিন তিনি জেলে ছিলেন, তত দিন চারধারে তাঁকে নিয়ে কম কথা হয়নি। যার অধিকাংশই ইন্দ্রাণীর পক্ষে নয়। এ বার তিনিও কথা বলছেন। গুচ্ছ গুচ্ছ সাক্ষাৎকার দেওয়ায় বিশ্বাসী নন। জেলে বসে করোনাকালে নিজের স্মৃতিকথা লিখেছেন ইন্দ্রাণী। সম্প্রতি তা প্রকাশিতও হয়েছে। মুম্বইয়ে নিজের বাড়িতে বসে শিনা, সংসার, পিটার এবং তাঁর বই ‘আনব্রোকেন: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বললেন তিনি।
শেষের কথাটা শুরুতে বলে নেওয়া যাক। ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার পর আনন্দবাজার অনলাইন ইন্দ্রাণীকে প্রশ্ন করেছিল, লেখা তো বাংলায় বেরোবে। তিনি পড়তে পারেন তো? ঝরঝরে বাংলায় ইন্দ্রাণী বললেন, ‘‘আমি বাংলা পড়তে পারি, লিখতেও পারি। এমনকি, গোটা সাক্ষাৎকারটাই বাংলায় দিতে পারতাম।’’ মাতৃভাষা অসমিয়া ছাড়া ইংরেজি তো জানেনই, তার সঙ্গে হিন্দি আর স্প্যানিশও জানা আছে তাঁর।
জেল থেকে বেরোনোর পরে ক’দিন সময় কাটিয়েছেন নতুন করে চারপাশটার সঙ্গে পরিচিত হতে। সঙ্গে নিজের বইটিও শেষ করেছেন মন দিয়ে। সোমবার আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘লেখালিখি আগে করতাম না। তবে জেলে বসে ডায়েরি লিখতে শুরু করি। লেখার অভ্যাস করায় অসম্ভব আরাম হয়। খানিকটা থেরাপির মতো। আসলে জেলে ব্যস্ততা কম ছিল। তখন পুরনো অনেক কথা মনেও পড়ত। সে সব লিখতে ইচ্ছা করে। ভালও লাগে। এর পর আরও লিখব।’’ ইতিমধ্যেই নতুন বইয়ের কাজও শুরু করে দিয়েছেন ইন্দ্রাণী। তবে এ বই নিজের দিকটা বলার জন্য নয়। এ শুধুই তাঁর স্মৃতি। দাবি ইন্দ্রাণীর। আগেই তো কিছু সাক্ষাৎকারে বলে দিয়েছেন যে, দুর্মুখদের ক্ষমা করেছেন।
জীবনে অনেক ভুল করেছেন বলে মনে করেন। হালকা হাসির সঙ্গে বলেন, ‘‘ঠিকও করেছি নিশ্চয়ই। তবে ভুলও করেছি। মানুষ যেমন করে।’’ এক সময়ে তাঁকে ‘মানুষ’ বলতেও রাজি ছিল না সমাজের একাংশ। তাই যেন একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছেন মেয়ে শিনাকে খুনে অভিযুক্ত মা। যিনি বিশ্বাস করেন, শিনা এখনও বেঁচে আছেন। দাবি করেন, তাঁর বিশ্বাস অমূলক নয়। প্রমাণ পেয়েছেন পরিচিত কেউ কেউ। তাঁরাই তো আদালতে সে সব জমা দিয়েছেন। তবে তাঁকে এত শাস্তি পেতে হত না যদি একটা ভুল না করতেন। তা হলেই সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেত না।
কী সেই ভুল? ইন্দ্রাণী বললেন, ‘‘পিটারকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে। ওটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। চিনতে পারিনি।’’
ছিলেন গুয়াহাটির মেয়ে। বিয়ে করেছিলেন কলকাতার ব্যবসায়ী সঞ্জীব খন্নাকে। জীবন বদলে যায় মুম্বইয়ে পিটারের সঙ্গে আলাপ হয়ে। খুন করুন না করুন, ইন্দ্রাণীর নিন্দা তো করেছেন ঋষি কপূর থেকে শোভা দে-র মতো কত কত তারকা! তা-ও তো কম কথা নয়। আর সে সবের আগের সময়ের তো কথাই নেই। কত কী করেছেন! দেশের মিডিয়া জগতের অতি পরিচিত নামগুলির মধ্যে ছিলেন পিটার-ইন্দ্রাণী। এত কিছু যিনি করেছেন, তিনি কিনা নিজের স্বামীকে চিনতে ভুল করলেন? ইন্দ্রাণীর কাছে উত্তর আছে। বলেন, ‘‘ভালবাসতাম পিটারকে। মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলার বদঅভ্যাস আছে আমার। সেটাই বড় ভুল হয়ে গিয়েছে।’’
তবে ক্ষোভ, দুঃখ নিয়ে বাঁচতে ভালবাসেন না ইন্দ্রাণী। ২০১৫ সালের আগে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন সাজগোজ, খানাপিনা, আনন্দ— সবই পছন্দ তাঁর। নিজের বইয়ে লিখেওছেন সে সব কথা। ২০ বছর আগের কোনও নৈশভোজে কোন পোশাক পরে গিয়েছিলেন, তার খুঁটিনাটিও মনে রাখেন। ভালবাসেন নিজেকে সুন্দর করে রাখতে। নিজের জীবন সুন্দর করে সাজাতে। তার জন্য কম খাটেন না। যত দূর সম্ভব চেষ্টা করতে পারেন। জেল থেকে বেরিয়ে আবারও সে চেষ্টায় মগ্ন ইন্দ্রাণী। সকলে ছেড়ে গেলেও হারতে বাধ্য নন তিনি। বলেন, ‘‘সকলের সব হয় না। কারও শুধু পরিবার হয়। কারও কেরিয়ার। কারও কারও দুটোই হয়।’’
পরিবার আর নেই ইন্দ্রাণীর। কয়েক বছর আগে পিটারের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। শ্বশুরবাড়িও মুখ ফিরিয়েছে। পুত্র মিখেল তাঁর নামে নানা অভিযোগ এনেছেন। মেয়ে শিনার উধাও হয়ে যাওয়া নিয়েই তো এত কাণ্ড! রইল বাকি ছোট কন্যা ভিধি। কিন্তু তিনিও তো মাকে নিয়ে বই লিখেছেন। মান-অভিমানের কথা উঠে এসেছে সেই বইয়ে। তবে রইল কে? কাকে নিয়ে নতুন করে জীবন গড়বেন? ভিধির কথা উঠতেই মাতৃত্ব ছলকে পড়ে ইন্দ্রাণীর ভিতর থেকে। বলেন, ‘‘ওই বইটা যখন লিখেছিল, তখন ও অনেক ছোট। আমি এখন আর ও সব মনে রাখিনি। আমাকে তখনও আইনজীবীরা বলেছিলেন, ওই বই প্রকাশ করতে না-দিতে। কিন্তু আমি বাধা দিইনি। ওতে বিশ্বাস করি না।’’
সে সময়ে পিটারের পরিবার ভিধির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে ছিল। সে প্রভাবও পড়েছে মেয়ের উপর। মনে করান ইন্দ্রাণী। বলেন, ‘‘এখন আমার পরিবার বলতে আমার মেয়ে ভিধি আর বন্ধুবান্ধব।’’ তবে ইদানীং মাঝেমধ্যে আর একটা কথাও মনে হয় তাঁর— সঞ্জীবের পরিবারই ছিল তাঁর আসল আপন। ‘‘ওঁরা আমাকে ভালবাসা দিয়েছেন। অন্য কোথাও তেমনটা পাইনি,’’ শান্ত ভঙ্গিতে বলেন ইন্দ্রাণী।
হেরে যাওয়ায় বিশ্বাসী নন। বাড়ি বসে থাকাতেও নন। কবে সব শেষ হবে, তবে কাজ করবেন, সেটা ভাল লাগে না তাঁর। তাই কাজ শুরু করেছেন নতুন করে। মূলত সমাজসেবা। জেলখাটা মেয়েদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরানো। সে কাজে তাঁর সঙ্গী বিজেপি নেতা তথা স্বেচ্ছাসেবক অর্জুন দত্তজি মেঘে। শুধু কাজেও আটকে থাকেন না ইন্দ্রাণী। সামগ্রিক ভাবে সুন্দর জীবনে বিশ্বাস রাখেন। তাই এখন যোগাসন শেখেন। নাচ শেখেন। বেড়াতে যান। পুজোও করেন। পরিপূর্ণ জীবন পেতে যেমন অনেকেই নানা দিক থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন, ঠিক তেমন।
সম্প্রতি সমাজমাধ্যমেও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তবে পোস্টের সংখ্যা হাতেগোনা। যদিও অনুরাগীর সংখ্যা আকাশছোঁয়া। সেখানে নিজের শৌখিন জীবনের নানা ঝলক দেন পিটারের প্রাক্তন স্ত্রী। আলিবাগের রিসর্টের ছবি থেকে নাচের পাঠ— নানা রকম দৃশ্য দেখা যায় সেখানে। তাঁকে নজরে রাখে লক্ষ লক্ষ চোখ। অনুরাগীদের সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন চর্চিত অভিনেত্রী সানি লিয়নও।
নিন্দকেরা যে যা-ই বলুন, ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় খোলা হাওয়ার স্বাদ নিচ্ছেন। জানাচ্ছেন, মামলা ঠিক পথেই চলছে। শিনাকে যদি কোনও দিনও দেখতে পেতেন কোথাও, তবে সোজা ওঁকে ধরে নিয়ে হাজির করতেন আদালতে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy