সাংবাদিক বৈঠকে হরীশ রাওয়ত। মঙ্গলবার দেহরাদূনে। ছবি: পিটিআই
দেহরাদূনের নাটক আরও জমিয়ে দিল উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট।
পাহাড়ি রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরে আজ আদালতের রায় চমকে দিল সকলকে। যে রায় বলছে, রাষ্ট্রপতির শাসন বহাল থাকবে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই সদ্য অপসারিত মুখ্যমন্ত্রী হরীশ রাওয়ত বিধানসভায় নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন। আগামী ৩১ মার্চ, বৃহস্পতিবার বিধানসভায় ভোটাভুটি হবে। কংগ্রেসের যে ন’জন বিক্ষুব্ধ বিধায়কের সদস্যপদ স্পিকার খারিজ করে দিয়েছিলেন, ভোট দেবেন তাঁরাও। তবে কি স্পিকারের সিদ্ধান্তকে খারিজই করে দিল হাইকোর্ট? তা-ও নয়। ওই ন’জনের ভোট গোনা হবে আলাদা ভাবে।
প্রাথমিক ভাবে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও কংগ্রেস-বিজেপি কারও কাছেই স্পষ্ট নয়, এতে তাদের লাভ হল না ক্ষতি। দু’দলই হিসেব কষতে বসেছে। দু’পক্ষই দাবি করছে, আদালতের রায়ে তাদেরই জয় হয়েছে। কিন্তু সকলেই মানছেন হাইকোর্টের নির্দেশ একগুচ্ছ প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে দিয়েছে। রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে আদালতের নির্দেশে আস্থা ভোটের নজির যে নেই তা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসনে থাকা কোনও রাজ্যে বরখাস্ত হওয়া সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় শক্তিপরীক্ষা দিচ্ছেন— এমন নজির আছে কি না মনে করতে পারছেন না কেউ।
দু’সপ্তাহ আগে উত্তরাখণ্ডে শাসক দল কংগ্রেসের ন’জন বিদ্রোহী বিধায়ক বিজেপিকে সমর্থন করায় সঙ্কটে পড়েছিল হরীশ রাওয়তের সরকার। রাজ্যপাল গত ২৮ মার্চের মধ্যে আস্থা ভোটের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক আগের দিনই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেছে মোদী সরকার। এর বিরুদ্ধেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন রাওয়ত। আদালত তাঁকে গরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ দেওয়ায় রাওয়ত আজ দাবি করেছেন, বৃহস্পতিবারে ভোটে তাঁদেরই জয় হবে। হরীশের বক্তব্য, ‘‘যাঁরা রাজ্যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের মুখে চড় কষিয়ে দিল আদালতের রায়।’’ আবার আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি অজয় ভাট মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে ন’জন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস বিধায়কের সদস্যপদ স্পিকার খারিজ করে দিয়েছিলেন, তাঁদেরও ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছে আদালত। স্পিকারের ওই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল বলে এ দিনও অভিযোগ করে বিজেপি।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আজ আদালতে যুক্তি দেওয়া হয়, হরীশ রাওয়ত ক্ষমতায় থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছিলেন। কারণ, বাজেট পাশের সময়েই গরিষ্ঠতা ছিল না সরকারের। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে শীর্ষ আদালতে আবেদন জানানোর প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে আদালত যে রাষ্ট্রপতি শাসনের বিরুদ্ধে রায় দেয়নি, তাতে বিজেপি নেতৃত্ব খুশি। রাষ্ট্রপতি শাসনে থাকা এই রাজ্যের আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে মোদীর সরকার আজ সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে ছেদ টেনেছে। এতে উত্তরাখণ্ডের সরকারি কাজর্কম চালানোর জন্য অর্থ জোগাতে অধ্যাদেশ জারি করতে পারবে কেন্দ্র।
আইনজীবীদের অনেকেই বলছেন, রাষ্ট্রপতি শাসন জারি রেখেও এমন ভোটাভুটির অনুমতি দেওয়াটা প্রায় নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে ১৯৯৮ সালে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় এই ধরনের ভোটাভুটির নির্দেশ দিয়েছিল। রাজনৈতিক অচলবাবস্থা তৈরি হয়েছিল তৎকালীন রাজ্যপাল রমেশ ভাণ্ডারীর এক নির্দেশে। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে কল্যাণ সিংহকে সরিয়ে জগদম্বিকা পালকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদালত নির্দেশ দেয়, বিধায়করাই ভোটাভুটি করে তা ঠিক করুন কল্যাণ না জগদম্বিকা কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। শেষ পর্যন্ত কল্যাণ জেতেন। জগদম্বিকাকে সরে দাঁড়াতে হয়। কংগ্রেসে ছেড়ে সেই জগদম্বিকা এখন বিজেপির সাংসদ।
উত্তরপ্রদেশে ওই ভোটাভুটি যখন হয়, তখন কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন ছিল না। প্রশ্ন উঠছে, উত্তরাখণ্ডে এই ভোটাভুটির অর্থ কী? এমনও নয় যে এই ভোটাভুটিতে যাঁরা জিতবেন তাঁরা এর ভিত্তিতে রাজ্যপালের কাছে সরকার গড়ার দাবি জানাতে পারবেন। ভোটাভুটির সময় হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার পর্যবেক্ষক হিসেবে বিধানসভায় হাজির থাকবেন। তবে আদালত যে স্পিকারের বিধানসভা পরিচালনার অধিকারেও হস্তক্ষেপ করছে, তেমনটাও নয়। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, ভোট হবে গোপন ব্যালটে। ফল ঘোষণা করা হবে না। মুখবন্ধ খামে তা হাইকোর্টের কাছেই জমা পড়বে। ফলে আইনজীবীরা মনে করছেন, পরিষদীয় অর্থে এটাকে আস্থা ভোট বলা যাবে না। আদালত শুধু শক্তির সমীকরণটা জেনে নিতে চাইছে। যাতে রাষ্ট্রপতির শাসন ও স্পিকারের সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল, তা নিয়ে চূড়ান্ত আইনি সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিধায়ক কেনাবেচা বন্ধ থাকে।
আদালতের এই রায় শুনে বিজেপির আইনজীবী নেতারাও হকচকিয়ে যান এ দিন। নলিন কোহালি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি শাসনের মধ্যে এমন রায় অভূতপূর্ব।’’ রাওয়তের আইনজীবী, কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি দাবি করেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার পরেও যে আস্থা ভোটের নির্দেশ দেওয়া যায়, আদালত সেই যুক্তি মেনে নিয়েছে। শুধু বিধায়ক কেনাবেচার অভিযোগে কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যায় না।’’
কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীরা অভিযোগ তুলেছেন, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজ্যে রাজ্যে তাঁদের সরকার ফেলার চেষ্টা চলছে। কংগ্রেস-শাসিত অরুণাচলপ্রদেশ রাষ্টপতি শাসন জারি হয়েছে গত ২৪ জানুয়ারি। অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের দাবি, বিহার ভোটের আগে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে, কংগ্রেসের বিধায়কদের টাকা দিয়ে তাঁর সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। হিমাচলপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহেরও অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে তাঁর সরকারে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy