বাসযাত্রার সূচনার আগে সেই বাসে উঠে বসলেন ত্রয়ী। ঢাকায় শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।
ভারত বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না, পই-পই করে বলে দিয়েছিলেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার।
কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ভেসে গেল যাবতীয় বিধিনিষেধ। শনিবারের বিকেলবেলা। বাংলাদেশের ঘড়িতে তখন প্রায় চারটে। আগরতলাগামী বাসে উঠলেন দুই প্রধানমন্ত্রী— নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা। তাঁদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
ঠিক তখনই বাসের পিছন থেকে ভেসে এল মন্তব্য—‘‘মোদীজি, আপকে লিয়ে তো বেসবরি সে ইন্তেজার থা!’’ শুনে একগাল হাসলেন মোদী। বাসের করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা এগিয়ে গেলেন। তার পরে বললেন, ‘‘হম ভি ইস হি ইন্তেজার মে থে।’’
এই বাসটিই কলকাতা থেকে ঢাকা এসেছে। ফ্ল্যাগ-অফের আগে এ দিন দুপুর থেকেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে তিনটি বাস অপেক্ষা করছিল। তিনটিরই রুট আলাদা। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা, আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা এবং ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি। সামনে লাল কার্পেট পাতা। আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনটি বাসের যাত্রা শুরুর আগে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিনটি বাসেই উঠলেন। খোশগল্পে যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সেরে গেলেন।
ভিআইপি-রা আসার অন্তত মিনিট চল্লিশ আগেই আগরতলাগামী বাসটিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধি ও সংবাদমাধ্যমের লোকজনকে অপেক্ষা করতে বলেন স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। সেই বাসে উঠেই হাসিমুখে যাত্রীদের নমস্কার করলেন তিন নেতা-নেত্রী। তার পরেই মোদী বললেন, ‘‘আপনাদের যাত্রা শুভ হোক। আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাতের একটা সুযোগ পেয়ে বেশ লাগছে।’’
প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পরে তাঁরা পরিচয়-পর্ব সারলেন বাসে উপস্থিত প্রত্যেক সরকারি অফিসারের সঙ্গে। আলাপ করালেন পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের চেনাবার ভার নিলেন, মমতা নিজেই। আমাদের দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘‘এরা সবাই সাংবাদিক। কলকাতা থেকে বাসেই এসেছে!’’ শুনে মোদী এগিয়ে গেলেন যাত্রীদের দিকে। একে একে সবার সঙ্গেই হাত মেলালেন। সহাস্যে বললেন, ‘‘আপনে বুলায়া। দেখিয়ে হম হাজির হো গ্যায়ে!’’ এক যাত্রী বলে ওঠেন, ‘‘বিশ্বাসই হচ্ছে না আপনারা এসেছেন!’’ শুনে তাঁর পিঠ চাপড়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘কী, এ বার বিশ্বাস হয়েছে তো!’’
সরকারি অনুষ্ঠানের গুরুগম্ভীর আবহ যেন তাতেই ভেঙে খান খান হয়ে গেল। বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য অপেক্ষা-পর্বে একটা কথাই বার বার বুঝিয়েছিলেন বাসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশি পুলিশ অফিসারেরা। ‘‘আমাদের এবং আপনাদের প্রধানমন্ত্রীকে আপনারা কোনও প্রশ্ন করতে পারবেন না। কিন্তু ওঁরা প্রশ্ন করলে অবশ্যই উত্তর দেবেন।’’ দুই প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর খোলামেলা মেজাজ দেখে অবশ্য প্রশ্ন না-করে থাকা গেল না।
এই সফরের পরে কি ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে? প্রশ্নটা ছিল শেখ হাসিনার জন্য। একটু থেমে হাসি মুখে তাঁর জবাব, ‘‘নিশ্চয়ই হবে। দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুন্দর হবে। সেটাই আমরা চাই।’’ এর পর নিজে থেকেই হাসিনা বলেন, ‘‘আমরা ভুলি কী করে যে, একাত্তরের যুদ্ধে ভারতবাসীরা কী ভাবে আমাদের সাহায্য করেছিলেন, পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।’’
মুক্তিযুদ্ধের কথা যে এখনও ভোলেননি, তা হাসিনার চোখেমুখেই স্পষ্ট। আর আভাস মিলল, এই প্রীতির আবহে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট দুই দেশই। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, এ দিনই কলকাতা-চট্টগ্রাম, শিলিগুড়ি-ঢাকা এবং মালদহ-রাজশাহি বাস পরিষেবা চালু নিয়ে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা আরও কিছুটা এগিয়েছে।
ঢাকা থেকে এই বিকেলের বাস ছাড়ার লগ্নটিও তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করলেন বিশিষ্টরা। তাঁরা যাতে বাসে উঠে কিছু ক্ষণ বসতে পারেন, তা মাথায় রেখেই সামনের দিকের কয়েকটি আসন খালি রাখা হয়েছিল। মোদীই আসনগুলি দেখিয়ে হাসিনা ও মমতাকে বললেন, ‘‘চলুন বসা যাক!’’ বসার আগে বাসের ভিতরে লাল গোলাপ আর রজনীগন্ধার সাজসজ্জা দেখিয়ে মমতাকে হাসিনা বললেন, ‘‘কী সুন্দর সাজিয়েছে!’’ বাসের প্রথম সিটে পাশাপাশিই বসলেন, দুই প্রধানমন্ত্রী— মোদী ও হাসিনা। অন্য দিকের সিটে মমতা।
একটা সময় পরে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিন জন নেমেও গেলেন বাস থেকে। এগিয়ে গেলেন অন্য দু’টি বাসের দিকে। দুটিতেই খানিক ক্ষণ সময় কাটানোর পর ফ্ল্যাগ-অফ পর্ব। সবুজ পতাকা নেড়ে তিনটি বাসের যাত্রা শুরুর সাক্ষী থাকলেন মোদী, হাসিনা ও মমতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy