জয়ের পরে আপের সদর দফতরের বাইরে অরবিন্দ কেজরীবাল। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
একেবারে ঝেঁটিয়ে সাফ!
বুথ-ফেরত সমীক্ষা বলেছিল, অরবিন্দ কেজরীবাল সরকার গঠন করবেন। কিন্তু রাজধানীতে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বা বিজেপি তিনটি আসন পেয়ে টিমটিম করবে, এমন ইঙ্গিত সেখানে ছিল না। ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭ আসন জিতে দিল্লি বিধানসভা ভোটের ইতিহাসে রেকর্ড গড়বে আম আদমি পার্টি (আপ)— এমনটা তো নয়ই!
কোন জাদুতে এমন ঘটল? নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে মাত্র ন’মাস আগে বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছে। তার পরেও কেন রাজধানীর দখল নিতে পারল না তারা?
দিল্লিতে আজকের ফলাফলের নিরিখে তাই সবথেকে বড় প্রশ্নটি হল, এই ভোট কি এক অর্থে মোদীর প্রতি কোনও বার্তা? মোদী সরকারের ন’মাসের কাজের প্রতিফলনও কি ঘটেছে এই ফলাফলে? ইউপিএ সরকারের দুর্নীতি আর নীতিপঙ্গুত্বের পরে মোদীর সরকার নিয়ে এমনিতে বিপুল প্রত্যাশা মানুষের। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই, এখনও পর্যন্ত সরকারের কাজকর্মে সেই প্রত্যাশা পূরণের উপলব্ধি কমই। বরং গর্জন যত, বর্ষণ ততটা হয়নি বলেই মনে করতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। তার উপরে যোগ হয় বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা সংক্রান্ত অভিযোগ— তা সে গোষ্ঠী-সংঘর্ষই হোক, গির্জায় আক্রমণই হোক বা হিন্দুদের চার সন্তানের দাওয়াই। কেজরীবালের বিরুদ্ধে বিজেপির নিরন্তর ব্যক্তিগত আক্রমণও ভাল চোখে নেননি দিল্লিবাসী।
এ সব সত্ত্বেও আজ কেজরীবালের সাফল্য কিন্তু এসেছে প্রধানত রাহুল গাঁধীর কংগ্রেসের সৌজন্যে। ভোটের অনুপাত বিশ্লেষণ করলেই ছবিটা অনেকাংশে পরিষ্কার হয়ে যায়। দিল্লির মানুষ বিজেপির বিকল্প হিসাবে কংগ্রেসকে গ্রহণ করেননি। গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট ছিল শতকরা ২৫ ভাগ। লোকসভায় ছিল ১৫ শতাংশ। এ বার সেটা কমে হয়েছে মাত্র শতকরা ৯ ভাগ। আর আপ-এর ভোট গত বিধানসভায় পাওয়া ২৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২ শতাংশ। লোকসভা নির্বাচনেও যা ছিল ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক দিকে কংগ্রেসের ধারাবাহিক অবক্ষয়, অন্য দিকে আপ-এর শক্তিবৃদ্ধি। বিজেপি-বিরোধী ভোটকে একাই এককাট্টা করতে সক্ষম হয়েছেন কেজরীবাল। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বাল্লিমারান, ওখলা বা চাঁদনি চকের মতো আসনে কংগ্রেসের ভোট হু হু করে কমেছে। সেই ভোট চলে গিয়েছে কেজরীর ঝুলিতে।
এমনটা যদি না ঘটত, তা হলে কিন্তু বদলে যেতে পারত অঙ্কটা। যেমনটা দেখা গিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের উত্তরপ্রদেশে। সেখানে ৮০টি আসনের ৭১টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। অথচ শতকরা হিসাবে দলের ভোট প্রাপ্তি ছিল ৪২ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভোট মুলায়ম সিংহ, মায়াবতী ও কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল। ফলে আসন সংখ্যায় বিজেপির ধারেকাছে কেউ ঘেঁষতে পারেনি। এ বারে যেমন দিল্লির মুস্তাফাবাদ আসনে সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগিতেই আগে বেরিয়ে গিয়েছে বিজেপি। আপ সেখানে তিন নম্বরে।
২০১৩-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৩.১ শতাংশ ভোট। সেই তুলনায় এ বার বিজেপির ভোট কমেছে নগণ্য পরিমাণ। বিজেপি পেয়েছে ৩২.২ শতাংশ ভোট। বেশির ভাগ আসনে আপের পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপিই।
কিন্তু ২০১৩-র বিধানসভা ভোটে মোদী-ঝড় ছিল না, যেটা ছিল লোকসভা নির্বাচনে। তখন বিজেপি দিল্লিতে তার ভোট বাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ৪৬ শতাংশে। সেই তুলনায় এ বার তাদের ভোট ১৪ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ? মোদী-অমিত জুটি যে বাড়তি জনসমর্থন জোগাড় করেছিলেন লোকসভায়, সেটা বিজেপি ধরে রাখতে পারেনি।
কেন? প্রত্যাশা পূরণে মোদী সরকারের আংশিক ব্যর্থতার পাশাপাশি দিল্লি বিজেপির অন্তর্কলহও একটা বড় কারণ। যে কারণে সাবেক বিজেপির মধ্যে থেকে সর্বজনগ্রাহ্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী তুলে ধরাই যায়নি। শেষ মুহূর্তে আপ থেকে কিরণ বেদীকে দলে এনে চার দিনের মাথায় তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করে চমক দিতে চেয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু সেটা দিল্লি বিজেপি শিবিরে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। জনমত
সমীক্ষা দেখাতে থাকে, দ্রুত শক্তি বাড়াচ্ছেন কেজরী। এখন দলের মধ্যে কাটাছেঁড়া চলছে, কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের পরপরই কি ভোট করে নিলে ভাল হতো? কিরণকে আরও আগে আনার সিদ্ধান্ত হলে কি এই ভরাডুবি এড়ানো যেত? দিল্লিবাসীর হাতে হাতেও ঘুরছে এসএমএস “মোদী সরকারের ন’মাস পূর্ণ হয়েছে। কেজরীবাল জন্মগ্রহণ করেছেন!” অথবা “কিরণ বেদী ওয়জ আ মাস্টারস্ট্রোক, হার মাস্টার গট আ স্ট্রোক!”
তা হলে এ বারের নির্বাচন কি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভোট? নাকি কেজরীবালের পক্ষে ইতিবাচক ভোট?
গত বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভোটের জেরে ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইন্দিরা-রাজীব থেকে মনমোহন এমনকী বিজেপির বিরুদ্ধেও নেতিবাচক ভোটের একাধিক উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু এ বারের নির্বাচন যতটা না মোদী-বিরোধী, তার চেয়ে ঢের বেশি কেজরীবাল নামে এক রাজনৈতিক আইকনকে ক্ষমতায় ফেরানোর অনুষ্ঠান। রেডিওতে কেজরীবাল বারংবার তাঁর প্রচারে বলেছেন, “গত বার আমার সংখ্যা কম ছিল। তাই চলে গিয়েছিলাম। আমায় সংখ্যা দিন। আমি উন্নয়ন করে দেখাব।”
এক অসমাপ্ত কর্মসূচি পূরণের স্বপ্ন দেখিয়ে এ বার মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। কৌশল রচনাতেও যে তিনি যথেষ্ট পটু, বুঝিয়ে দিয়েছেন তাও। দিল্লিতে বিজেপির প্রধান ভরসা ছিল বৈশ্য ভোট। কেজরীবাল নিজে রাজস্থানের বৈশ্য। এলাকায় এলাকায় সেই প্রচারের সুযোগও তিনি নিতে ছাড়েননি। মানুষের কাছে বার্তা দিয়েছেন, তিনি গরিবের বন্ধু, সৎ। আমজনতার প্রতিনিধি। যাঁর আচরণের মধ্যে অহঙ্কারের কোনও ছাপ নেই। প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নেই। শুধু নিম্নবর্গ নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যেই ক্রমশ নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে গিয়েছেন কেজরী। অভিজাত দক্ষিণ দিল্লি, নিম্নবিত্ত পূর্ব দিল্লি, বাহারি দিল্লির জাঠ থেকে মধ্যবিত্ত-সংখ্যালঘু— সব অংশের মানুষই এ বার ঢেলে ভোট দিয়েছেন আপে।
ভোট প্রচারের শেষ বিকেলে দিল্লির কনট প্লেস ছেয়ে গিয়েছিল আপ-টুপি পরা মাথায়। চোখে পড়ছিল না অন্য কোনও চিহ্ন! ঝাড়ু-ঝড়ের পূর্বাভাস হয়তো সে দিনই লেখা হয়ে গিয়েছিল। আজ সেই ঝড় প্রকাশ্যে এসেছে। দিল্লি জানিয়ে দিয়েছে, ‘অব কি বার আপ কি সরকার!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy