গঙ্গাকে প্রণাম করে লোকসভা ভোটের প্রচার শুরু করেছিল নরেন্দ্র মোদী। ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও বারাণসীতে গিয়ে গঙ্গা প্রণাম করে এসেছেন তিনি। গঙ্গা সংস্কার বিষয়ে আস্ত একটা দফতরই তৈরি করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কিন্তু তার পরেও বুধবার প্রশ্ন তুলল সুপ্রিম কোর্ট, গঙ্গাকে বাঁচানোর অভিপ্রায় কি সত্যিই আছে সরকারের?
গঙ্গা দূষণ রোধে কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলে করা একগুচ্ছ মামলাকে একত্র করে শুনানি চলছে সুপ্রিম কোর্টে। বুধবার সেই মামলায় বিচারপতি তীর্থসিংহ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে, দেশের এই প্রধান নদীকে আদৌ তারা বাঁচাতে চায় কি না। অন্য প্রকল্প তড়িঘড়ি রূপায়ণ করলেও গঙ্গা দূষণ রোধে কেন্দ্রের সেই উদ্যম নেই এমন মন্তব্যও করেছে সর্বোচ্চ আদালত।
গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে কেন্দ্র কী কী পরিকল্পনা নিয়েছে, কোন প্রকল্পের কতটা অগ্রগতি হয়েছে তা জানিয়ে আগামী দু’ সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা জমা দিতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বিচারপতি ঠাকুর বলেন, “গঙ্গা সংস্কারের বিষয়টি তো শাসক দলের ইস্তাহারেই ছিল। তা হলে রূপায়ণে উদ্যোগী হচ্ছেন না কেন?”
গঙ্গা দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সরব পরিবেশ বিজ্ঞানী ও নদী বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এ নিয়ে বিস্তর মামলাও হয়েছে। এই সব মামলার জেরেই ১৯৮৬ সালে রাজীব গাঁধীর জমানায় প্রথম ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’ গঠিত হয়। দু’দফায় সেই কাজে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা জলে গেলেও গঙ্গার হাল বিশেষ ফেরেনি বলে অভিযোগ। উল্টে দিনের পর দিন গঙ্গার জলে দূষণ বেড়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, গঙ্গার জলে দূষণ বা রোগজীবাণুর অস্তিত্ব মাপা হয় ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়ার মাত্রা দিয়ে। ফিক্যাল কলিফর্ম যত বেশি হবে, রোগজীবাণুর পরিমাণও তত বেশি হয়। মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র গঙ্গার জলে মিশলে এই ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রা বাড়ে।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত গঙ্গার জলে এই ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ বেশি। পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ জায়গায় ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি! দিন দিন গঙ্গাজলে দূষণের মাত্রা বাড়ছে, বাড়ছে জনস্বাস্থ্যের অবনতির আশঙ্কাও।
কেন বাড়ছে দূষণ?
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, গঙ্গার তীরবর্তী শহর-গ্রামের নিকাশি এবং শিল্পাঞ্চলে বর্জ্য থেকেই বেশি দূষণ ছড়ায়। গঙ্গার তীরবর্তী চাষের খেত থেকে জলে ধুয়ে আসা কীটনাশকও দূষণ বাড়াচ্ছে। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের মন্তব্য, “গঙ্গাকে দূষিত করছি আমরা। আবার আমরাই সেই দূষণের শিকার।” রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইনি অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, এ রাজ্যে গঙ্গা-দূষণ কমাতে হলে পুরসভা-পঞ্চায়েতগুলিকেও সামিল করতে হবে। কারণ গঙ্গায় নিকাশি ফেলা বন্ধ না করলে দূষণ কমবে না।
গঙ্গাকে পুনরুজ্জীবিত করতে আইআইটি-র কয়েক জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে ২০০৯ সালে একটি কমিটি গড়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। চার বছর সমীক্ষা চালিয়ে একটি অন্তবর্তী রিপোর্ট জমা দিয়েছে সেই কমিটি। তাতেও গঙ্গার দূষণ মুক্তির কথা বলা হয়েছে। গঙ্গার স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত না-করার কথাও বলেছে ওই কমিটি।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশের অভিযোগ, গঙ্গা দূষণে আগের সরকারের ব্যর্থতাকে লোকসভা ভোটে হাতিয়ার করেছিল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল গঙ্গাতীরের প্রাচীনতম জনপদ বারাণসীকে। মোদী বলেছিলেন, গঙ্গা তাঁর মা। দূষণে রুগ্ণ সেই মাকে মুক্তি দিতে চান তিনি। গঙ্গা পুনরুজ্জীবন নামে আলাদা দফতরও তৈরি করেছে সরকার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ। পরিবেশবিদদের একাংশ বলছেন, আইআইটি-র বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টের একেবারেই উল্টো পরিকল্পনা করছে সরকার। নাব্যতা বাড়াতে যে ভাবে নদী বাঁধ তৈরির কথা বলা হচ্ছে, তাতে গঙ্গার স্বাভাবিক গতিই রুদ্ধ হবে। এই প্রসঙ্গে নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের মন্তব্য, “গঙ্গা নিয়ে আবেগ নিশ্চয়ই ভাল। তবে বিজ্ঞানটা বোঝা আরও জরুরি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy