বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লির একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
চাপে পড়লে এমনই হয় বুঝি!
হচ্ছিল স্মার্ট সিটি নিয়ে কথা। আচমকাই তার মধ্যে জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ টেনে আনলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী! বিরোধীরা বলছেন, এ সব বলে প্রধানমন্ত্রী আজ সুষমা-বসুন্ধরা-স্মৃতি-পঙ্কজা বিতর্কের মুখ ঘোরাতে চাইলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেই উদ্দেশ্য সফল হল কই! একের পর এক অভিযোগ, তথ্য আর ছবির ধাক্কায় জাতীয় রাজনীতিতে আরও ঝড়ের মুখে পড়ে গেল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বিশেষ করে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বসুন্ধরা রাজের ইস্তফার দাবিতে আজ সরকারের ওপর চাপ বেড়েছে অনেকটাই।
ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করা ললিত মোদীর একটি হলফনামা আজ প্রকাশ করেছে কংগ্রেস। ওই হলফনামায় বসুন্ধরার উল্লেখ রয়েছে। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সখ্য কতটা, তা-ও হলফনামায় ব্যাখ্যা করেছেন ললিত। তা ছাড়া একটি নতুন ছবিও আজ সামনে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বসুন্ধরা যে সময়ে ললিত মোদীর জন্য হলফনামা পেশ করতে বিলেত গিয়েছিলেন, ঠিক সেই সময়েই লন্ডনে ছিলেন বিজেপির আরও দুই নেতা-নেত্রী— নিতিন গডকড়ী এবং স্মৃতি ইরানি! যদিও বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, দলের লন্ডন শাখার একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিতিন-স্মৃতি গিয়েছিলেন সেখানে। এর সঙ্গে ললিত-যোগ নেই।
মুখে যা-ই বলুক, বসুন্ধরার ধাক্কায় যথেষ্টই উথালপাথাল শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিজেপি তথা সরকারের মধ্যে যে ‘জরুরি অবস্থা’ তৈরি হয়েছে, তা আজ ধরা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কথাতেই। না হলে ‘স্মার্ট সিটি’ প্রকল্প আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু করার সম্মেলনে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে জরুরি অবস্থার কথা টেনে এনে তিনি বলতেন না, ‘‘চল্লিশ বছর আগে এমন দিনে স্রেফ ক্ষমতার সুখের জন্য জরুরি অবস্থা প্রয়োগ করে গোটা দেশকে জেলখানা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’ সকলেই বুঝতে পারছেন, রাজনৈতিক তর্কের মুখ ঘোরাতে মরিয়া প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু চল্লিশ বছর আগের একটি ঘটনা উস্কে দিয়ে কি এই বিতর্ক চাপা দেওয়া যাবে?
এবং প্রশ্নটা সেখানেই। দলের একের পর এক নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এত আঙুল ওঠার পরেও প্রধানমন্ত্রী কি চুপ করে থাকবেন? অভিযুক্ত মন্ত্রীদের ইস্তফার দাবি থেকে মুখ ফিরিয়ে বির্তক ঘোরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন? নাকি সত্যিই এ বার ইস্তফা দিতে বলা হবে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজেকে?
বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, মোদী-অমিত শাহরা বুঝতে পারছেন, বসুন্ধরার বিরুদ্ধে অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিজেপি নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আপাতত বসুন্ধরার পাশেই রয়েছেন। তাদের বক্তব্য হল, বসুন্ধরাকে ইস্তফা দিতে বলা মানেই বিরোধীরা বিদেশমন্ত্রীর পদ থেকে সুষমাকে সরাতে চাপ বাড়াবে। তার পর তালিকায় আছেন স্মৃতি ইরানি, পঙ্কজা মুণ্ডেরা। আইনি যুক্তিতে বসুন্ধরা বা সুষমার বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণিত হোক বা না হোক, এই দু’জনের কোনও একজন ইস্তফা দিলেই দুর্নীতির কাদা লেগে যাবে শাসক দলের ওপর। বসুন্ধরা-সুষমার ‘সৌজন্যে’ একবার সেই বার্তা গেলে দুর্নীতি প্রশ্নে মোদীর এত দিনের যাবতীয় বক্তব্যই মাঠে মারা যাবে! এই অবস্থায় এই অবস্থায় বিদেশ সফর সেরে আজই ফিরেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সূত্রের খবর, দলের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করতে আজ রাতে জেটলির সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী। জেটলি ইতিমধ্যেই বসুন্ধরার সঙ্গে কথা বলেছেন। বসুন্ধরার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘কেউই দাগী নয় ‘এই সরকারে’।’’
কিন্তু অনেক প্রশ্ন তবু উঠছে। বসুন্ধরার বিরুদ্ধে নিত্য-নতুন অভিযোগের পরেও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁর পাশে দাঁড়ানোয় বিজেপি বুঝতে পারছে, এর খেসারত দিতেই হবে বাদল অধিবেশনে। সংসদ চালানো তো কঠিন হয়ে যাবেই, সেই সঙ্গে শিকেয় উঠবে একগুচ্ছ সংস্কারের বিল পাশের ব্যাপারটিও। এই অবস্থায় বিজেপি নেতৃত্বের একটি অংশ বলছেন, বাদল অধিবেশন শুরু হতে এখনও প্রায় এক মাস বাকি। তত দিনে কিছুটা হলেও থিতিয়ে যাবে সুষমা-বসুন্ধরা বিতর্ক। আর তা যদি না হয়, কংগ্রেসকে প্যাঁচে ফেলার মতো নতুন কিছু তত দিনে নিশ্চয়ই হাতে এসে যাবে। দলের অন্য অংশটি কিন্তু এখনই এতটা নিশ্চিত হতে পারছেন না।
এই অবস্থায় বসুন্ধরা শিবিরও তাদের কৌশল বদলেছে। প্রকাশ্যে না বললেও, বসুন্ধরা শিবিরের তরফে আজ বলা হয়, ললিত মোদীর সমর্থনে হলফনামায় তিনি সই করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তা নিছক বন্ধু হিসেবে। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হিসেবে নয়। তাই এটা কোনও অপরাধ নয়! বিজেপি নেতৃত্বের একাংশও বলছেন, এটা নিছকই মানবিকতা আর বন্ধুত্বের প্রশ্ন। কোনও অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি তো নয়! এই অবস্থায় আচমকা লটারি পেয়ে যাওয়ার মতোই অবস্থা কংগ্রেসের। নতুন করে অক্সিজেন পেয়ে গিয়েছে মাঝে ঝিমিয়ে পড়া দলটি। দলের এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, ‘‘ইস্তফা দেওয়া নিয়ে বিজেপি যত দেরি করবে, তত দিনই তাদের বিরুদ্ধে কাদা ছেটানোর সুযোগ পাব আমরা। বিশেষ করে স্বচ্ছ প্রশাসন নিয়ে মোদীর বেলুনটা চুপসে দেওয়া যাবে।’’ ঠারেঠোরে এ কথাটাই বুঝিয়ে রাজস্থানের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সচিন পায়লট আজ ললিত মোদীর হলফনামাটি প্রকাশ করেন। সেটিতে সাক্ষী হিসেবে তিন জনের উল্লেখ রয়েছে। প্রথম জন হলেন, মোদীর ভারতীয় কৌঁসুলি মেহমুদ আবদি। দ্বিতীয় নামটিই বসুন্ধরার!
সচিন পায়লট এ দিন জানান, বসুন্ধরা ইস্তফা না দিলে কাল থেকেই লাগাতার আন্দোলন শুরু হবে রাজস্থানে। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পরে মোদীজি বার বার প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও পারদর্শিতার কথা বলতেন। তা কায়েম করার সাহস এখন কেন দেখাতে পারছেন না তিনি? বসুন্ধরা যা করেছেন, তা কোনও সাধারণ মানুষ করলে এতক্ষণে পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যেত।’’ এই সঙ্গেই তাঁর কটাক্ষ, ‘‘তা হলে কি সাধারণ মানুষের জন্য এক আইন আর বিজেপির মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের জন্য আলাদা আইন? এখনও চার বছর সরকার চালাতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি কি সেটা ভুলে যাচ্ছেন!’’
বসুন্ধরার হলফনামা আর ছবি নিয়ে বিজেপি নেতাদের বিড়ম্বনার মধ্যেই আজ ঝড় তুলল অন্য তিনটি ঘটনা। স্মৃতি ইরানিকে নিয়ে আজ হইহই করে মাঠে নামে কংগ্রেস। তাদের যোগ্য সহযোগিতা করেছে অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টি (আপ)। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে মিথ্যা হলফনামা দেওয়ার অভিযোগে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর পদ থেকে স্মৃতির ইস্তফার দাবিতে আজ রাজধানীতে তোলপাড় ফেলে দুই দল। মহিলা কংগ্রেসের সমর্থকরা বিজেপি সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখান তো আপ-এর মহিলা বাহিনী স্মৃতির বাড়ি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করেন। ক’দিন আগে এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে দিল্লিতে আপ সরকারের আইনমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ তোমরকে গদি হারিয়ে জেলে ঢুকতে হয়েছে। পাল্টা দিতে আপ আজ ৭২ ঘণ্টার চরমসীমা দিয়েছে বিজেপিকে। পাশাপাশি শোরগোল শুরু হয়েছে বিজেপি নেত্রী তথা মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী পঙ্কজা মুণ্ডেকে নিয়েও। এ সবের মধ্যে আজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানাল কংগ্রেস! অভিযোগ, রাজ্যসভা ভোটের সময় তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর-এর কথা হলফনামায় গোপন করেছিলেন পর্রীকর।
ছবি: পিটিআই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy